আজকের শিরোনাম :

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন

বকেয়া টাকা নিয়ে গ্রামীণ-রবি-বিটিআরসি দ্বন্দ্ব কতদূর গড়াতে পারে?

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০১৯, ১১:০৯

বকেয়া টাকা নিয়ে গ্রামীণফোন ও রবি- বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দুই মোবাইল ফোন কোম্পানির সঙ্গে টেলিযোগাযোগ কর্তৃপক্ষ বিটিআরসির দ্বন্দ্ব নতুন মাত্রা পেয়েছে।

বিটিআরসি দাবি করছে, তারা অডিট করে দেখেছে যে, ২০ বছরে এই দুটি কোম্পানির কাছে সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। আর এ পাওনা টাকা আদায়ের জন্য চাপ দিতে বিটিআরসি তাদের দেয়া অনাপত্তিপত্র বা এনওসি প্রদান বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

কিন্তু মোবাইল কোম্পানি দুটো বলছে, টাকার অঙ্ক নিয়ে তাদের আপত্তি রয়েছে। এ নিয়ে বৃহস্পতিবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলন করেছে গ্রামীণফোন। তারা বলছে- যেসব কারণ দেখিয়ে বিটিআরসি এই অর্থ দাবি করছে তা অযৌক্তিক এবং অনাপত্তিপত্র স্থগিত রাখাকে তারা ‘জোর করে অর্থ আদায়ের কৌশল’ বলে বর্ণনা করেছে।

গ্রামীণফোন বলছে, তারা বকেয়া টাকা নিয়ে টানাপড়েন সালিশের মাধ্যমে সমাধান করতে চায়। কিন্তু আইনি কারণ দেখিয়ে সালিশে রাজি নয় বিটিআরসি।

বিটিআরসি বলছে, এ টাকা জনগণের টাকা, যেটা কমিশন শুধু আদায় করে দিচ্ছে। কমিশন আইনে যেহেতু সালিশের কোনো বিধান নেই, তাই এ টাকা তাদের দিতে হবে, এখানে সালিশের কোনো সুযোগ নেই।

তবে গ্রামীণফোন বলছে, তারা সবসময় সরকারের প্রাপ্য টাকা ঠিকমতোই দিয়ে আসছে। এখানে যে অর্থ দাবি করা হচ্ছে, সেটা বিটিআরসির ভুলে হতে পারে। কিন্তু সেজন্য গ্রামীণফোন জরিমানা দিতে পারে না। আর এখানে গ্রাহকদের স্বার্থ বিবেচনায় রাখা হয়নি।

গত ২৩ জুলাই গ্রামীণফোন এবং রবি আজিয়াটার ক্ষেত্রে অনাপত্তি প্রদান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত জানায় বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন। ফলে কোম্পানি দুটি কোনোরকম সম্প্রসারণ, উন্নয়ন, সংস্কার করতে পারবে না। পাশাপাশি নতুন ট্যারিফ বা প্যাকেজ ঘোষণাও করতে পারবে না।

নিরীক্ষা করে গত ২০ বছরে এই দুটি কোম্পানির কাছে ১০ হাজার কোটি টাকা পাওনা হয়েছে বলে বিটিআরসির দাবি। প্রয়োজনে তারা আরও কঠোর হবে ইঙ্গিত দিয়েছে।

বাংলাদেশে ১৬ কোটির বেশি মোবাইল ফোন গ্রাহক রয়েছে। তার তিন-চতুর্থাংশ রয়েছে এই দুটি কোম্পানির।

কী বলছে গ্রামীণ ফোন ও রবি
ভারপ্রাপ্ত প্রধান কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার হোসেন সাদাত বলছেন, ‘আমাদের সেসব বক্তব্য আমরা বিটিআরসির কাছে তুলে ধরেছি, কিন্তু তারা সেগুলো আমলে নেয়নি। যেমন ধরুন, বিটিআরসি প্রতিবছর অডিট করে আমাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে গেছে। কিন্তু এখন এসে তারা বলছে, তাদের সেই অডিট ঠিক ছিল না, তারা আরও টাকা পাবে। সেই টাকার সঙ্গে চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ যোগ করেছে। কিন্তু তাদের ভুলের কারণে আমরা কেন সুদ দেব? এসব নিয়ে আলোচনার দরকার আছে। তাই আমরা সালিশের প্রস্তাব করেছি।’

এ জন্য তারা দেশের শীর্ষ কয়েকটি আইনি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও আলোচনা করেছেন। গ্রামীণফোন আশা করছে, দেশে যেহেতু সালিশের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির আইন রয়েছে, সেই আইনের মাধ্যমেই এ সমস্যার সমাধান করা যাবে।

গ্রামীণফোনের সিইও মাইকেল ফোলি পুনর্ব্যক্ত করেন, ‘ব্যবসায়িক কোন্দল নিরসনের উপায় হিসেবে কখনই গ্রাহকদের স্বার্থ, জাতীয় অর্থনীতি কিংবা দেশের ভাবমূর্তিকে জিম্মি করা উচিত নয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থার এহেন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অন্যান্য পক্ষের ওপর যে প্রভাব পড়েছে তা সত্যিই দুঃখজনক।’

রবি আজিয়াটা লিমিটেডের চিফ কর্পোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার শাহেদ আলম বলছেন, ‘আমাদের সাথে যদি নিয়ন্ত্রক সংস্থার কোনো বিষয়ে বিরোধ থাকে সে জন্য গ্রাহক সেবা বিঘ্নিত হওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত।’

কী বলছে বিটিআরসি
বাংলাদেশে টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন বলছে, অডিটের মাধ্যমেই এই অর্থের বিষয়টি এসেছে। এখানে জোর করে কোন অর্থ আদায় করা হচ্ছে না। ফলে মোবাইল কোম্পানিগুলোকে এই অর্থ প্রদান করতে হবে।

প্রতিষ্ঠানটির জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক জাকির হোসেন খান বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘এ টাকার অঙ্কটি কিন্তু বিটিআরসি ধার্য করে দেয়নি। এটা অডিটের মাধ্যমে বেরিয়ে এসেছে। প্রামীণফোন এবং রবি জনগণের কাছ থেকেই এ অর্থ নিয়েছে, যেটা সরকারকে দেয়ার কথা। আমরা সেটাই দিতে বলছি। তারা যত তাড়াতাড়ি এই অর্থ দিয়ে দেবে, সেটা তাদের জন্যই মঙ্গল, কারণ সুদ তো বাড়ছে।’

কিন্তু এত বছর পরে অডিটের ভুলের অর্থ কেন কোম্পানিগুলো দেবে, জানতে চাইলে তিনি বলছেন, ‘যেটা সরকারের প্রাপ্য সেটা তো তাদেরকে দিতেই হবে। আগে হয়তো এটা টের পাওয়া যায়নি। কিন্তু এখন যখন সেটা সনাক্ত হয়েছে , সেটা তো আদায় করা কমিশনের দায়িত্ব।’

এ জন্য গ্রাহকদের কোনো সমস্যা হলে তিনি দুঃখপ্রকাশ করেন।

কোম্পানিগুলোর সালিশের মাধ্যমে সমাধানের প্রস্তাবটি কমিশন কেন গ্রহণ করছে না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বর্তমান টেলিযোগাযোগ আইনে সালিশের মাধ্যমে সমাধানের কোনো বিধান নেই। তাই এ ক্ষেত্রে এ সুযোগ নেই।

কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা
টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞ আবু সায়িদ খান বলছেন, ‘গ্রাহকদের স্বার্থ নিয়ে সরকার বা কোম্পানিগুলো, কারো আসলে কোন মাথাব্যথা নেই, যদিও এই টানাপড়েনে গ্রাহকরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সরকারি মালিকানাধীন দুটি প্রতিষ্ঠান, টেলিটক এবং বিটিসিএলের কাছেও কিন্তু বিটিআরসি অনেক টাকা পায়। কিন্তু সেই টাকা নিয়ে তারা একটি শব্দও উচ্চারণ করে না। অথচ এই দুটি মোবাইল কোম্পানির ওপর প্রথমে ব্যান্ডউইথ কমিয়ে দেয়া, এর পর এনওসি দেয়া বন্ধ করে দেয়া অনৈতিক সিদ্ধান্ত বলে আমি মনে করি।’

তিনি বলেন, ‘কোম্পানিগুলোর গ্রাহক বাড়বে, কিন্তু তারা সেবা বাড়াতে পারবে না, মান বাড়াতে পারবে না। ফলে শেষ পর্যন্ত কিন্তু ক্ষতির শিকার হবে গ্রাহকরাই।’

তার মতে, এই ঘটনার প্রভাব আন্তর্জাতিকভাবেও পড়তে পারে, যেহেতু এসব কোম্পানি বিদেশি বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত।

যেহেতু এখানে অনেক বড় অঙ্কের অর্থের বিষয়টি জড়িত, সে ক্ষেত্রে দেশের ভেতরে সমাধান না হলে শেষপর্যন্ত বিষয়টি যদি আন্তর্জাতিক কোন আদালতেও গড়াতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন।

গ্রামীণ ও রবির আপত্তি কোথায়?
বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি প্রতিষ্ঠান দুটির কর্মকর্তারা। তবে জানা গেছে, গ্রামীণফোন এবং রবি অডিটের শুরু থেকেই এর প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

তারা যেটি বলার চেষ্টা করেছেন তা হলো- টেলিযোগাযোগ আইন অনুযায়ী প্রতি বছর অডিট করার কথা থাকলেও বিটিআরসি সেটি করেনি।

বিটিআরসি ২০১১ সালে জিপি অডিট করে ৩০৩৪ কোটি টাকা দাবি করে । পরে জিপি পাওনা অস্বীকার করে এবং অডিট প্রত্যাখ্যান করে আদালতে যায়। পরবর্তীতে আদালত নতুনভাবে অডিট করার নির্দেশনা দেয়।

২০১৭ সালে নতুনভাবে অডিট শুরু করে গ্রামীণফোনের কাছে ১২৫৭৯ কোটি টাকা পাওনা দাবি করে। এর মধ্যে প্রায় ৬১৯৪ কোটি মুল টাকার উপর সুদ ধরা হয়েছে।

বাকি পাওনার মধ্যে ৪০৮৬ কোটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পাওনা- যেটাও জুড়ে দেয়া হয়েছে।

উল্লেখ্য, গত ২ এপ্রিল গ্রামীণফোনকে একটি নোটিশের মাধ্যমে বিটিআরসিকে ৮ হাজার ৪৯৪ কোটি ১ লাখ টাকা আর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে ৪ হাজার ৮৫ কোটি ৯৪ লাখ টাকা প্রদান করার নির্দেশ দেয় বিটিআরসি।

বিটিআরসির নিয়োগ করা একটি অডিট ফার্ম ১৯৯৭ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়ে এ বকেয়া তৈরি হয়েছে বলে প্রতিবেদন দেয়।

এবিএন/সাদিক/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ