আজকের শিরোনাম :

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন

দক্ষিণ এশিয়ার বন্যা ও নদীর রাজনীতি

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৭ জুলাই ২০১৯, ১০:৪৯

পানি সম্পদের বিষয়টি যখন সামনে আসে তখন নেপাল ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক কখনই সহজ ছিল না। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বর্ষাকালে, জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত, দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক আরও খারাপ হতে শুরু করেছে।

দুই প্রতিবেশীর মধ্যে সম্পর্কে আরও উত্তাপ ছড়িয়েছে বন্যা পরিস্থিতি। সীমান্তের দুই পাশের বাসিন্দারা নিজেদের দুঃখ-কষ্টের জন্য পরস্পরকে দায়ী করছে।

চলতি বছর বন্যা পরিস্থিতি এ অঞ্চলে বেশ খারাপ আকার ধারণ করেছে। নেপাল ও বাংলাদেশে কয়েক ডজন মানুষ মারা গেছে এবং ভারতের উত্তর এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ৩০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

ভারত ও নেপালের মধ্যে প্রায় ১ হাজার ৮০০ কিলোমিটার অভিন্ন সীমান্ত রয়েছে। নেপাল থেকে ভারতের উত্তরাঞ্চলে প্রায় ৬০০০ নদী ও জলধারা প্রবাহিত হয়েছে।

শুষ্ক মৌসুমে ভারতের গঙ্গা নদীতে প্রায় ৭০ শতাংশ পানি আসে নেপাল থেকে প্রবাহিত এসব নদী এবং জলধারা থেকে। যখন এসব নদীতে পানি বেড়ে যায়, তখন নেপাল ও ভারতে বন্যা দেখা দেয়। গত কয়েকবছর ধরে নেপালের সীমান্তে তীব্র ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। এর কারণ হচ্ছে, নেপাল থেকে ভারতের দিকে যে বন্যার পানি প্রবাহিত হয় সেটিকে আটকে দেওয়ার জন্য ভারতের সীমান্তে নদীর ভেতরে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে।

দুই বছর আগে নেপালের পূর্বাঞ্চলে গিয়ে বিবিসি দেখতে পেয়েছে যে, শুধু বন্যার পানি আটকে দেওয়ার জন্য ভারতীয় অংশে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এ বাঁধ নিয়ে নেপালের দিক থেকে আপত্তি তোলার পর ২০১৬ সালে সীমান্তে উভয় দেশের মানুষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছিল।

নেপাল বলছে এ ধরনের ১০টি বাঁধ রয়েছে যেগুলো নেপালের ভেতরে হাজার হাজার হেক্টর জমি প্লাবিত করছে।

ভারতীয় কর্মকর্তারা বলছেন, সীমান্তে যেসব স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে সেগুলো রাস্তা। কিন্তু নেপালের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব স্থাপনা প্রকৃত পক্ষে বাঁধ, যার মাধ্যমে ভারতের গ্রামগুলোকে বন্যার হাত থেকে রক্ষা করা হচ্ছে।

নেপালের দক্ষিণাঞ্চলে গাউর নামক এলাকা গত বেশ কয়েকদিন ধরে পানিতে প্লাবিত। কর্মকর্তারা আশংকা করছেন এনিয়ে যে কোনো সংঘাতের সূচনা হতে পারে।

নেপালের আর্মড পুলিশের এক শীর্ষ কর্মকর্তা কৃষ্ণা ধাকাল বলেছেন, ‘অনেক আতঙ্কের পর ভারতীয় অংশে বাঁধের কয়েকটি গেট খুলে দেয়া হয়েছে এবং এতে আমরা উপকৃত হয়েছি।’

ভারতীয় কর্মকর্তারা কোনো প্রশ্নের জবাব দেননি। দুই দেশের কর্মকর্তারা এ বিষয়টি নিয়ে বছরের পর বছর ধরে আলোচনা করে যাচ্ছেন। কিন্তু তাতে কোনো ফলাফল আসেনি।

নেপালের আলোচক ও কূটনীতিকরা নিজ দেশের ভেতরে বেশ সমালোচনার মুখে পড়েছেন। অনেকে মনে করেন নেপালের কর্মকর্তারা ভারতের কাছে বিষয়টি কার্যকরভাবে তুলে ধরতে পারছেন না। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে ভারতীয় অংশে কোন বন্যা হচ্ছে না। ভারতের বিহার রাজ্যে প্রায় ২০ লাখ মানুষ এ বছর বন্যার কারণে বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

কোসি এবং গ্যান্দাকি- এই দুটো নদীতে যখন পানি বৃদ্ধি পায় তখন বিহারে বন্যা পরিস্থিতি নাজুক আকার ধারণ করে। এই দুটো নদী গঙ্গায় গিয়ে পড়েছে। ভারতীয় অংশে বন্যার জন্য নেপালকে দায়ী করা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সীমান্তে নদীতে যে বাঁধ দেয়া হয়েছে সেটি পরিচালনা করে ভারত সরকার। এই বাঁধ যদি নেপালের অংশেও হয়, তবুও ভারত সরকার এটি পরিচালনা করে।

১৯৫৪ এবং ১৯৫৯ সালে কোসি এবং গ্যান্দাকি নদী নিয়ে ভারত এবং নেপালের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছে সেটির আওতায় বাঁধ পরিচালনা করে ভারত। এই বাঁধগুলো প্রধানত নির্মাণ করেছে ভারত। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সেচ কাজ এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন। কিন্তু নেপালের মানুষ মনে করছে এতে তাদের কোনো উপকার হচ্ছে না।

অন্যদিকে ভারত সরকার এসব বাঁধকে একটি ভালো উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করছে।

তারা দেখানোর চেষ্টা করছে, অভিন্ন নদীর পানির কতটা ভালোভাবে এবং সহযোগিতার মাধ্যমে কাজ লাগানো যায়। কোসি নদীতে যে বাঁধ দেয়া হয়েছে সেখানে ৫৬ টি বন্যা নিয়ন্ত্রণ গেট রয়েছে।

নেপালের তরফ থেকে অভিযোগ রয়েছে, বর্ষাকালে এ নদীতে যখন পানি বিপদসীমায় পৌঁছে যায়, তখন ভারত সেসব গেট খুলে দেয় না। ফলে নেপালে বন্যার আশঙ্কা তৈরি হয়।

এই কোসি নদী দীর্ঘ সময় ধরে ‘বিহারের দুঃখ’ হিসেবে পরিচিত ছিল। এর আগে কয়েকবার এ নদীর পানিতে বন্যা পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ২০০৮ সালে যখন এই নদীর বাঁধ ভেঙে যায়, তখন কয়েক হাজার মানুষ মারা যায় এবং ভারত ও নেপালে ৩০ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়।

যেহেতু এই নদীতে নির্মিত বাঁধ ৭০ বছরের পুরনো সে জন্য এটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বড় ধরণের বন্যার আশঙ্কা রয়েছে।

নেপালের অনেক নদী চুর পর্বতমালার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এই পর্বতমালার প্রতিবেশ এরই মধ্যে হুমকির মধ্যে পড়েছে।

এক সময় এই পর্বত নদীর পানি নিয়ন্ত্রণ করতো এবং ভারত ও নেপাল অংশে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা কমিয়ে আনত। কিন্তু বন উজাড় হয়ে যাওয়া এবং খনিজ সম্পদ উত্তোলনের কারণে পাহাড়ের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।

ভারতের উত্তর প্রদেশ ও বিহারে ব্যাপক আকারে নির্মাণ কাজের কারণে চুর পাহাড়ের প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস হচ্ছে।

কর্মকর্তারা বলছেন, প্রাকৃতিকভাবে ভারসাম্য রক্ষার বিষয়গুলো না থাকার কারণে বর্ষাকালে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নেই। এই অঞ্চলের পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার বিষয়টি শুধু নেপালের সমতল ভূমির জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়। ভারতের উত্তর প্রদেশ ও বিহারের জন্যও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

গাছপালা রক্ষা না করা এবং খনিজ সম্পদ আহরণ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার কারণে ভারত নেপালের সমালোচনা করছে। এখন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ বর্ষাকাল সম্পর্কে আগে থেকে ধারণা করা মুশকিল।

বিশেষজ্ঞরা আশংকা করছেন, পানি নিয়ে ভারত এবং নেপাল- এই দুই প্রতিবেশীর মধ্যে বিষয়টি আরও জটিল আকার ধারণ করতে পারে।

এবিএন/সাদিক/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ