আজকের শিরোনাম :

ভারত-শাসিত ‘কাশ্মীরে স্থানীয়রাই এখন বেশি অস্ত্র তুলে নিচ্ছে’

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৫ আগস্ট ২০২১, ১৩:০১

এ বছরের ২৭ জুন। বশির ভাটের ভাই, ফয়েজ আহমদ ভাট, যিনি ছিলেন কাশ্মীর পুলিশের সদস্য, রাতে ঘুমাতে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ঠিক এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল। তিনি দেখতে গেলেন কে এসেছে। পেছনে ছিলেন তার স্ত্রী ও কন্যা। রাতের বেলায় দরজা খোলার ঝুঁকি তিনি খুব ভাল করেই জানতেন। দরজা খুলতেই সন্দেহভাজন দুজন জঙ্গির গুলিতে প্রাণ হারালেন তিনি, তার স্ত্রী ও মেয়ে।

কাশ্মীর পুলিশে বেশ কম বেতনে চাকরি করতেন ৪৫ বছর বয়সী ফয়েজ। তিনি ছিলেন বিশেষ বাহিনীর অফিসার - এসপিও। তার পোস্টিং ছিল কাছেরই এক শহরে।

ফয়েজকে যখন গুলি করা হয়, বশির কাছেই নিজের বাসাতেই ছিলেন। ভাইয়ের বাসা থেকে বন্দুকের আওয়াজ শুনে তিনি ছুটে যান। ঘরে ঢুকে যা দেখেন তাতে তার রক্ত হিম হয়ে যায়। ভাই ফয়েজ দরজার মুখে মৃত পড়ে আছেন, পাশেই বৌ ও মেয়ের লাশ। তিনটি রক্তাক্ত লাশ, চোখেমুখে যন্ত্রণার ছাপ।

“একটা প্রস্ফুটিত বাগান যেন বুলেটের আঘাতে এক মিনিটে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে,” তার ভাইয়ের পরিবারের উল্লেখ করে বলছিলেন বশির ভাট। “ওদের কী দোষ ছিল বলুন? ওরা তো কিছুই করেনি।”

ফয়েজের ছেলে ভারতের ইন্ডিয়ান টেরিটোরিয়াল আর্মির সৈনিক। তার পরিবারকে যেদিন হত্যা করা হয়, তিনি সেদিন তিনি বাইরে ছিলেন।

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ভারতশাসিত কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা বিলোপ করে রাজ্যটিকে কেন্দ্রশাসিত দুটি অঞ্চলে বিভক্ত করার পর দুবছর কেটে গেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যুক্তি দেখিয়েছিলেন- বিশৃঙ্খলা প্রতিহত করতে এটার প্রয়োজন ছিল।

জঙ্গিদের টার্গেট ‘পুলিশের চর’
কিন্তু দুই বছর পরেও নিরাপত্তা বাহিনীতে কর্মরত স্থানীয়দের এবং বেসামরিক মানুষকে এখনও সন্দেহভাজন জঙ্গিরা লক্ষ্যবস্তু করে হামলা চালাচ্ছে।

‘তারা এদের বলছে পুলিশের চর বা পুলিশের সহাযোগী। স্থানীয় এই ব্যক্তিরা ও তাদের পরিবারের সদস্যরা তাই তাদের টার্গেট,” বলছেন দিল্লিতে কনফ্লিক্ট ম্যানেজমেন্ট ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক অজয় সাহনি। “তারা সবসময়ই ঝুঁকিতে এবং এর ফলে প্রথম টার্গেট তারাই।”

কাশ্মীরে এবছরের জুলাই মাস পর্যন্ত ১৫ জন নিরাপত্তা কর্মী এবং ১৯ জন বেসামরিক মানুষ জঙ্গী হামলায় প্রাণ হারিয়েছে বলে বিভিন্ন রিপোর্টে জানা যাচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ২০১৯-২০ বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, কাশ্মীরে ১৯৯০-এর দশকে জঙ্গি কার্যকলাপ শুরু হবার পর থেকে ২০১৯-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১৪ হাজার ৫৪ জন বেসামরিক মানুষ এবং ৫ হাজার ২৯৪ জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য প্রাণ হারিয়েছে। কিন্তু প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা বলা হয় এর থেকে অনেক বেশি।

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরে ১৯৮৯ সাল থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা দিল্লির বিরুদ্ধে তাদের সহিংস আন্দোলন শুরু করে। পরমাণু শক্তিধর দুই প্রতিবেশি দেশ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মীর নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের এবং এই ভূখণ্ডকে কেন্দ্র করে দুটি দেশের মধ্যে তিনবার যুদ্ধও হয়েছে।

ভারত কাশ্মীরে অশান্তি উস্কে দেবার জন্য বরাবরই পাকিস্তানকে দায়ী করলেও পাকিস্তান এই অভিযোগ সবসময়ই অস্বীকার করেছে।

কাশ্মীরের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো বলছে, কাশ্মীর উপত্যকায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জঙ্গী পাঠানোর যে অভিযোগ ছিল, সীমান্ত সংঘাত বন্ধে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হওয়ার পর থেকে সেটা কমে গেছে, কিন্তু সহিংসতা থামেনি।

“গত কয়েকদিনে টার্গেট করা হয়েছে নিরাপরাধ বেসামরিক মানুষ ও পুলিশদের, যারা ছুটিতে রয়েছেন। মসজিদে নামাজ আদায় করতে যাবার সময় তাদের টার্গেট করা হচ্ছে। জঙ্গীরা একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি করতে চাইছে। তারা এখানে শান্তি ও স্থিতিশীলতা চায় না,” জুন মাসে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন কাশ্মীর পুলিশের ইন্সপেক্টার জেনারেল ভিজয় কুমার।

বন্দুক যুদ্ধে নিহত জঙ্গিদের বেশিরভাগই কাশ্মীরি
সরকার কাশ্মীর এলাকার আংশিক-স্বায়ত্তশাসনের সাংবিধানিক অধিকার বিলোপ করার পর স্থানীয় বিচ্ছিন্নতাকামীদের মৃত্যুর হার খুব বেশি বেড়ে গেছে বলে মৃত্যুর পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে।

গত কয়েক মাসে সশস্ত্র বাহিনী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে বন্দুক যুদ্ধের ঘটনা খুবই বেড়েছে। জম্মু ও কাশ্মীরে এ ধরনের লড়াইয়ে এবছরের জানুয়ারি মাস থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৯০ জন সন্দেহভাজন জঙ্গির মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

এদের মধ্যে ৮২ জনই স্থানীয় জঙ্গি এবং এদের মধ্যে এমনকি ১৪ বছর বয়সীরাও আছে। খবরে জানা গেছে নিহতদের মধ্যে কেউ কেউ বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীতে যোগ দিয়েছিল মৃত্যুর মাত্র তিনদিন আগে।

পিটিআই সংবাদ সংস্থার এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে জম্মু ও কাশ্মীরে ২০৩ জন বিচ্ছিন্নতাবাদীকে হত্যা করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ১৬৬ জনই স্থানীয়। ২০১৯ সালে হত্যা করা হয় ১৫২ জন জঙ্গীকে, যাদের মধ্যে ১২০ জনই ছিল স্থানীয় কাশ্মীরি।

‘কাশ্মীরিদের মধ্যে জঙ্গীবাদ আরও বাড়বে’
ঊর্ধ্বতন একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেছেন কাশ্মীরে এই মুহূর্তে সক্রিয় জঙ্গির সংখ্যা ২০০-এর বেশি। এদের মধ্যে প্রায় ৮০ জন বিদেশি এবং ১২০ জনের বেশি স্থানীয় কাশ্মীরি।

এই কর্মকর্তা তার নাম প্রকাশে অসম্মতি জানিয়েছেন এবং বলেছেন এই বিষয়ে গণমাধ্যমের সাথে কথা বলার অনুমতি তার নেই।

তিনি বলছেন, কাশ্মীরে সক্রিয় জঙ্গিদের তালিকায় এবছর বিদেশি কোনো জঙ্গির যোগদানের নজির নেই। যেসব বিদেশি জঙ্গি সেখানে সক্রিয় রয়েছে, তারা আগে থেকেই সেখানে তৎপর বলে ধারণা করা হচ্ছে। বরং এখন প্রতিদিন স্থানীয়রা বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীতে যোগ দিচ্ছে।

“এ বছর জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত প্রায় ৭৬ জন কাশ্মীরি হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে এবং এই সংখ্যা বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে,” বলছেন ওই কর্মকর্তা।

নিরাপত্তা সংস্থাগুলো যদিও আগের বছরগুলোর তথ্য উপাত্তের সাথে তুলনা করে বলছে- কাশ্মীরে জঙ্গি তৎপরতা কমেছে, বিশেষজ্ঞরা কিন্তু মনে করছেন কাশ্মীরে জঙ্গি কার্যকলাপে স্থানীয়দের অংশগ্রহণ বাড়ছে। ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের এ ঘটনা উদ্বেগের বলে তারা মনে করছেন।

ভারত সবসময়ই কাশ্মীরে জঙ্গিবাদের উত্থান ও প্রসারের জন্য পাকিস্তানকে দোষারোপ করে বলে এসেছে এসব প্রশিক্ষিত জঙ্গি ও অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করছে পাকিস্তান। পাকিস্তান এ অভিযোগ সবসময়ই প্রত্যাখান করেছে।

দিল্লিভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অজয় সাহনি মনে করেন কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির বিরোধিতাই বেশি সংখ্যায় স্থানীয় কাশ্মীরিদের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দলে যোগদানের কারণ হতে পারে।

“জম্মু ও কাশ্মীরের ব্যাপারে কেন্দ্রের নীতিমালার প্রতি কিছু বিরোধিতার বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে সম্প্রতি। সেটা অবশ্যই একটা ফ্যাক্টর। যদিও এধরনের বিরোধিতার বহিঃপ্রকাশ কমছে। তবে পাকিস্তান যেহেতু এখন কাশ্মীরিদের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে স্পষ্টতই একটা স্থানীয় আন্দোলন হিসাবে তুলে ধরছে, ফলে স্থানীয়দের এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ এখন ক্রমশ বাড়ছে,” তিনি বলেন।

সীমান্ত নিরুত্তাপ কিন্তু কাশ্মীরে উত্তাপ
কাশ্মীরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলওসি) রয়েছে, সেখানে দুই দেশের সৈন্যরা একটা যুদ্ধবিরতি বলবৎ রাখতে সম্মত হবার পর ফেব্রুয়ারি মাস থেকে সীমান্ত এলাকা শান্ত রয়েছে। কিন্তু কাশ্মীরের ভেতর জঙ্গি হামলা এবং বন্দুকযুদ্ধে কোন ভাঁটা পড়েনি।

শ্রীনগরে ভারতীয় একজন সেনা কর্মকর্তা বলেছেন এলওসিতে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবার পর থেকে যুদ্ধবিরতি লংঘনের একটাও ঘটনা ঘটেনি।

“কাশ্মীর সীমান্ত দিয়ে কোন অনুপ্রবেশ ঘটেনি, আমরা যতদূর জানি," বলেছেন লেফটেনান্ট জেনারেল দেভেন্দ্রা প্রতাপ পাণ্ডে, যিনি শ্রীনগরে চিনার কোর বাহিনীর প্রধান।

এই যুদ্ধবিরতি কাশ্মীরে জঙ্গী কার্যকলাপের ওপর প্রভাব তো ফেলেইছে, এমনকি সীমান্ত সংলগ্ন গ্রামগুলোতে গত পাঁচ মাস ধরে একটা শান্তি ও স্বস্তির পরিবেশ তৈরি করেছে, যেটা ওই অঞ্চলের জন্য বিরল একটা ঘটনা বলে বলা হচ্ছে।

নিয়ন্ত্রণ রেখার ধারে কাছে যারা বসবাস করেন অতীতে তাদের কঠিন মূল্য দিতে হয়েছে।

শাজিয়া মাহমুদ-এর বাসায় পাকিস্তান থেকে ছোঁড়া গোলার আঘাতে তার মা মারা গেছেন ১৯৯৮ সালে। ২০২০-এর নভেম্বর মাসে সীমান্তে গোলাগুলির মধ্যে পড়ে তার স্বামী প্রাণ হারিয়েছেন।

তিনি বলছেন, দুই তরফে যখন গোলাগুলি শুরু হয়েছে, তখন একদিন সকাল প্রায় ১১টা নাগাদ তিনি তার স্বামীকে ফোন করেছিলেন। তিনি তখন কাজে ছিলেন। “আমার স্বামী আমাদের লুকিয়ে থাকতে বললেন, বললেন আমার জন্য অপেক্ষা করো,” মিসেস মাহমুদ বলছিলেন।

তিনি আর ফিরে আসেননি। একটা গোলা এসে আঘাত করে শাজিয়া মাহমুদ-এর স্বামী তাহির মাহমুদ মীরকে, তিনি মারা যান। “আমাদের ছোট মেয়ের বয়স তখন ছিল মাত্র ১২ দিন। সে বড় হয়ে আমাকে তার বাবার কথা জিজ্ঞেস করলে আমি তাকে কী বলব?” মিসেস মাহমুদ বলেন।

নিয়ন্ত্রণ রেখায় এখন হয়ত পরিস্থিতি শান্ত এবং স্বাভাবিক। কিন্তু ২০০৩ সালে যে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে দুই দেশ সই করেছে তা তারা মেনে চলবে কিনা তা নিয়ে একটা সংশয় মানুষের মনে রয়েছে।

তবে সীমান্ত থেকে অনেকটা দূরে কাশ্মীরের গ্রাম ও শহরগুলোতে পরিস্থিতি মোটেও শান্ত নেই। সেখানে বশির আহমদ ভাটের মত বহু মানুষের জীবন ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। শান্তির স্বপ্ন তারা এখনও দেখতে পারছেন না।

“ভারত ও পাকিস্তান, দুই দেশের শাসকরাই আমাদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন; তাদের সংলাপে বসা উচিত। আমি শুধু এটুকুই বলতে চাই- মানবিকতাকে বাঁচান। এই সংঘাতের একটা সমাধান হওয়া উচিত, যাতে কাশ্মীরিরা না মরে, যেন মনুষ্যত্ব রক্ষা পায়,” বলেন বশির আহমদ ভাট।
খবর বিবিসি বাংলা

এবিএন/সাদিক/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ