আজকের শিরোনাম :

অব্যবস্থাপনা ও অসচেতনতায় শৃঙ্খলা ফিরছেই না সড়কে

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:১০ | আপডেট : ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:৪১

সম্প্রতি সড়কে দুর্ঘটনার প্রতিবাদে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর নানামুখী ও কড়াকড়ি বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। ট্রাফিক পুুলিশকে সহায়তা করতে সাথে যোগ করা হয় রোভার স্কাউট, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (বিএনসিসি), রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি ও গার্ল গাইড এর কর্মীদের। গত ৫ তারিখ থেকে এই চারটি সংগঠনের কর্মীদের রাস্তায় দেখা যায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে। স্কুল-কলেজে পড়ুয়া এই রোভার ও স্কাউটদের দেখা যায় জেব্রা ক্রসিং দিয়ে পথচারীদের রাস্তা পারাপারে নির্দেশ দিতে, উল্টো পথে আসা গাড়ির চালককে সঠিক পথে আসতে বাধ্য করতে, গণপরিবহনগুলোকে রাস্তায় নিয়মমাফিকভাবে যাত্রী তোলা ও নামানোর বিষয়ে নির্দেশনা দিতে।

‘রাস্তা পারাপারে ফুট ওভারব্রিজ ও জেব্রাক্রসিং ব্যবহার করুন, গাড়ি চলাচলের সময় রাস্তা পার হবেন না।’- হ্যান্ডমাইকে এমন আহ্বান জানাচ্ছেন রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির স্বেচ্ছাসেবকরা। তবে তাদের এমন আহ্বানে সাড়া দিতে অনাগ্রহী বেশিরভাগ পথচারী। পথচারীরা যেমন আইন মানতে চান না, তেমনই প্রবণতা যানচালকদের মধ্যেও। স্টপেজ ছাড়াও বাস থামিয়ে যাত্রী তোলা হচ্ছে। এক স্টপেজ থেকে অন্য স্টপেজ পর্যন্ত দরজা বন্ধ রাখছেন না অনেকেই।

রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ ১১টি পয়েন্টে রেড ক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবকরা প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ।

সরেজমিনে দেখা যায়, ট্রাফিক পুলিশকে সহায়তা করার পাশাপাশি রাস্তা পারাপারের বিষয়ে পথচারীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করছেন এ স্বেচ্ছাসেবকেরা। একইসঙ্গে ট্রাফিক আইন মেনে চলার নিয়ম-কানুন সম্বলিত লিফলেটও পথচারীদের মধ্যে বিতরণ করছেন তারা।

ঢাকা মেট্রোপলিটিন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ সূত্রে জানানো হয়, নিরাপদ সড়ক ও ট্রাফিক সপ্তাহ পালন উপলক্ষে ডিএমপি ট্রাফিক বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ ইন্টারসেকশনে' ট্রাফিক পুলিশকে সহায়তা ও রাস্তা পারাপারে পথচারীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করছে রেড ক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবকরা।

গত ১২-১৪ আগস্ট ট্রাফিক সপ্তাহ উপলক্ষে ঢাকা মহানগরী এলাকায় ট্রাফিক আইনে বিদ্যমান বিভিন্ন ধারা অনুযায়ী রুট পারমিটবিহীন, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, ড্রাইভিং লাইসেন্সবহীন যানবাহন, ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্সধারী যানবাহন এবং চালকের বিরুদ্ধে ১৯৮৩ সালের মোটরযান অধ্যাদেশ অনুযায়ী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সে কাজের অংশ হিসেবেই ট্রাফিক বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ ইন্টারসেকশনে পুলিশকে সহায়তা করছে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবকরা।

চালক, যাত্রী ও পথচারীদের ট্রাফিক আইন মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ করতে রাজধানীতে ছুটির দিনেও তৎপর থাকে ট্রাফিক পুলিশ। তাদের সঙ্গে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, বিএনসিসিসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও জনসাধারণকে সচেতন করেন। মাসব্যাপী ট্রাফিক সচেতনতা কর্মসূচিতে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে বলে আশাবাদী ট্রাফিক বিভাগ।

আবার অনেকেই সক্ষমতা থাকার পরও জেনে বুঝে নানা খোঁড়া যুক্তি দিয়ে পার পেতে চাইছেন পথচারীরা। হাত ফসকে বের হয়ে যেতে চাইলেও ট্রাফিক নিয়ম মেনে চলতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির সদস্যরা।

হতাশা থাকলেও জনসাধারণকে জেব্রা ক্রসিং, ফুটওভারব্রিজ ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করতে পেরে আনন্দিত তারা।

রাস্তায় মোটরসাইকেল আরোহীদের হেলমেট পরার সংখ্যা বেড়েছে ব্যাপক হারে। এরপরও যারা না পরেই রাস্তায় নেমে পড়েছেন তাদের মধ্যেও ছিল অনুশোচনা বা নিয়ম মানার আশ্বাস। মাসব্যাপী কর্মসূচির মধ্য দিয়ে মোড়ে মোড়ে অটোমেটিক ট্রাফিক সিগন্যাল কার্যকর করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছে ট্রাফিক বিভাগ।

ট্রাফিক পুলিশের ৪টি জোনের ১৫০টি চেকপোস্টে একযোগে পরিচালিত হচ্ছে এই অভিযান। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সদস্যের অনুপস্থিতিতে পথচারী বা চালকদের ট্রাফিক নিয়ম মানার তাগিদই সত্যিকারের সফলতা আনবে বলে বিশ্বাস ট্রাফিক বিভাগের।

অবশ্য ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসছে মানুষের মধ্যে। অনেকেই ট্রাফিক নির্দেশনা মেনে চলার চেষ্টা করছেন। নিজের ভুলের জন্য দুঃখ প্রকাশ করছেন। আশা করা হচ্ছে, একসময় সবাই সচেতন হবেন। শৃঙ্খলা ফিরবে সড়কে।

সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে গত ৪ সেপ্টেম্বর মাসব্যাপী ট্রাফিক সচেতনতা কার্যক্রমের ঘোষণা দেন ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। প্রথম দিনের অভিযানে ঢাকায় ৪০ লাখ ৫৬ হাজার ৩২৫ টাকা জরিমানা আদায়সহ ৫ হাজার ২১১টি মামলা করা হয়। এসময় ৪৭টি গাড়ি ডাম্পিং ও ৯০৭টি গাড়ি রেকার দিয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়।

ট্রাফিক সচেতনতা মাসে জিরোপয়েন্ট থেকে জাহাঙ্গীর গেট পর্যন্ত সড়কে 'মডেল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা’র কথা জানিয়েছিল ডিএমপি। এর অংশ হিসেবে অটো সিগন্যালে চলবে গাড়ি। তবে ফার্মগেট, শাহবাগ ও পল্টনসহ বিভিন্ন পয়েন্টে দেখা গেছে আগের মতোই ট্রাফিক সদস্যের হাতের ইশারায় যান চলছে।

রাজধানীর বিভিন্ন মোড়ে ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, রোভার স্কাউট ও গার্ল গাইডসের সদস্যরা। তাদের অভিজ্ঞতা মধুর নয়।

তবে দীর্ঘ যানজট ও মানুষের প্রচন্ড ভীড়েও দেখা যায়নি আগের মতো বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য। চোখে পড়েনি বেপরোয়া রাস্তা পারাপার। বিভিন্ন পয়েন্টে দেখা গেছে, পুলিশের পাশাপাশি সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কাজ করছে রোভার স্কাউট, স্কাউট, বিএনসিসি ও গার্লস গাইডসহ শিক্ষার্থী ও স্বেচ্ছাসেবীরা। তারা মূলত জেব্রা ক্রসিং ও ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহার করে রাস্তা পারাপারে সহযোগিতা করছিল পথচারীদের। ট্রাফিক আইন মানতে নানা দিক নির্দেশনা দিয়ে সচেতন করছিল নগরবাসীকে।

গত কয়েকদিন শাহবাগ, কারওয়ানবাজার, মতিঝিল ও সাইন্সল্যাবসহ নগরীর বিভিন্ন পয়েন্ট সরেজমিনকালে সড়কে শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ, শিক্ষার্থী ও স্বেচ্ছাসেবীদের এমন যুগপদ প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা গেছে। কোনো মানুষ জেব্রা ক্রসিং বাদ দিয়ে মূল সড়ক দিয়ে হাটতে গেলে তাকে জেব্রা ক্রসিং দিয়ে হাটতে অনুরোধ করছিল শিক্ষার্থীরা। 

ডিএমপির ট্রাফিক সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ডিএমপির পক্ষ থেকে সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে- সমন্বিতভাবে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, নিয়মিত যানবাহনের ফিটনেস পরীক্ষা, রেজিস্ট্রেন ও লাইসেন্স পরীক্ষা, যাত্রী ও পথচারীদের ট্রাফিক আইন সম্পর্কে সচেতনতা, গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে ফুটওভার ব্রিজ ও আন্ডারপাস নির্মাণ ছাড়াও নির্দিষ্ট জায়গায় যাত্রী ওঠা-নামা করানোর জন্য ট্রাফিক আইন সংক্রান্ত বিভিন্ন সাইন বসানোরা কাজ চলছে।

এ বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার বলেন, নাগরিকদের আইন মানতে কঠোরভাবে বাধ্য করার আগে অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে। তিনি বলেন, নগরীর প্রতিটি পয়েন্টে পর্যাপ্ত ফুটওভার ব্রিজ, আন্ডার পাস, জেব্রা ক্রসিং ও সড়ক বিভাজন তৈরির পাশাপাশি বিকল্প সড়ক তৈরি করতে হবে। এসবের পর আইন না মানলে তখন কঠোর হওয়া যাবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

ঢাকার রাস্তায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সহযোগী হয়ে কাজ করা এই চারটি সংগঠনের কর্মীরা বলছেন, সড়ক পথের অব্যবস্থাপনা, চালক ও সাধারণ মানুষের অসচেতনতাই সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ। পথচারীদের আইন না মানার প্রধান কারণ সময় বাঁচানোর চেষ্টা এবং অলসতা বলে মন্তব্য করেন স্কাউটরা।

স্কাউটরা বলছেন, যারা ট্রাফিক আইন ভাঙে তাদের অনুসরণ করার প্রবণতা মানুষের মধ্যে থাকলেও নিয়ম মেনে চলা মানুষদের খুব কম সংখ্যক লোকই অনুসরণ করে। বেশির ভাগ পথচারীই বলছে, তার হাঁটুতে ব্যথা, কোমরে ব্যথা। তাই সে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করতে পারবে না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর আব্দুল্লাপুর, বিজয় সরণী, বনানী কাকলী, মোহাখালী, সোনারগাঁও সংলগ্ন কারওয়ান বাজার, শাহবাগ মোড়, হাইকোর্ট মোড়, পল্টন মোড়, মতিঝিল ও কাকরাইল বিজয় মোড়ে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ৩২২ জন রোভার স্কাউট কাজ করছে। সোনারগাঁও, শাহবাগ, উত্তরা হাউজ বিল্ডিং ও কাকলী কাজ করছে বিএনসিসি’র ১২০ সদস্য। তাদের পাশাপাশি কাজ করছে রেড ক্রিসেন্ট ও গার্ল গাইডের সদস্যরাও। চলতি মাসের ৩০ তারিখ পর্যন্ত তারা কাজ করবেন। তবে তাদের কোনো পারিশ্রমিক দেয়া হচ্ছে না। দুপুরে পুলিশের পক্ষ থেকে খাওয়ানো হচ্ছে।

অন্যদিকে মাঠপর্যায়ে কাজ করা ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা বলছেন, এই চারটি সংগঠনের কর্মীরা রাস্তায় কাজ করায় সড়ক শৃঙ্খলা আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে। তাদের অনেক সহায়তা করছে এই স্কাউটরা।

এতো অব্যবস্থাপনা, অসংগতির পরেও আমাদের নিজেদের একটু সচেতনতা এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দায়িত্বশীলতাই সড়কে মৃত্যুর এই মিছিলকে কমাতে পারে।  নিজেদের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে নিজে বদলায়, অন্যকে বদলে যেতে অনুপ্রাণিত করি।

এবিএন/মাইকেল/জসিম/এমসি

এই বিভাগের আরো সংবাদ