আজকের শিরোনাম :

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন

বঙ্গভ্যাক্স : বনের বানর দিয়ে টিকা ট্রায়ালের ঝুঁকি ও নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৭ জুলাই ২০২১, ১৩:০৯

‘বঙ্গভ্যাক্স’ নামে করোনাভাইরাস প্রতিরোধী যে বাংলাদেশি টিকাটির গবেষণা চলছে, সেটির ট্রায়ালের জন্য জঙ্গল থেকে বানর ধরতে গিয়ে উৎপাদক প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেক লিমিটেডের লোকজন স্থানীয় মানুষজনের রোষের মুখে পড়েছিলেন- সম্প্রতি বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এমন একটি খবর বেশ সাড়া ফেলেছে।

কিন্তু টিকার গবেষণার জন্য বন্যপ্রাণীর ব্যহার কতটা গ্রহনযোগ্য তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনই বা এ বাবদে কী বলে?

গাজীপুরে যা ঘটেছিল
শ্রীপুর উপজেলার বরমী বাজার এলাকায় বানর ধরতে গ্লোব বায়োটেকের পক্ষে যারা গিয়েছিলেন, তাদের বানর ধরে খাঁচায় ভরতে দেখে এলাকার মানুষজন ঘেরাও করে। পরে পুলিশ তাদের উদ্ধার করেছে বলে জানিয়েছেন শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা খন্দকার ইমাম হোসেন।

তিনি বলেন, ‘আমরা গিয়ে দেখি তাদের এলাকার কয়েকশ মানুষ ঘিরে ধরেছে। ওনারা বলতে থাকেন যে তাদের কাছে বন অধিদপ্তরের অনুমতি সম্বলিত কাগজপত্র আছে। আমরা পরে তাদের থানায় নিয়ে আসি এবং কাগজপত্র দেখে ছেড়ে দেই’

গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্ন
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বন্যপ্রাণী ধরে ল্যাবরেটরিতে নিয়ে তার ওপর টিকার কার্যকারিতার গবেষণা চালালে তা আন্তর্জাতিকভাবে কতটা গ্রহণযোগ্য হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকাল রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক ঔষধ প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বিষয়টি নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।

তিনি বলেছেন, প্রাণীর ওপরে কীভাবে পরীক্ষা করা যাবে সে সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি প্রটোকল রয়েছে। সেই অনুযায়ী পরীক্ষা না করলে, এভাবে উৎপাদিত টিকা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গ্রহণ করা হবে না বলে তিনি মনে করেন।

তিনি বলেছেন, ‘এটা নিয়ম না। নিয়ম হল ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করার জন্য প্রাণীকে লালনপালন করতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গুড ল্যাবরেটরি প্রাকটিস নামে যে প্রটোকল আছে, সেখানে বলা আছে, তাকে কিভাবে রাখতে হবে, কি খাওয়াতে হবে, কেমন তাপমাত্রায় রাখতে হবে, কিসের সংস্পর্শে সে আসতে পারবে বা পারবে না ইত্যাদি। যাতে করে তার শরীর পরিবেশের কোন কিছু দ্বারা প্রভাবিত না থাকে। ধরুন আমার ঘরে ইঁদুর আছে কিন্তু সেটাকে ধরে নিয়ে ল্যাবে পরীক্ষা করলে হবে না।’

তিনি বলছেন, ‘সরাসরি ওয়াইল্ড থেকে নিয়ে পরীক্ষা করলে সমস্যা আছে। যেমন ওই বানরের শরীরে কোন জীবাণু থাকতে পারে। দেখা গেল এতে আমার ট্রায়ালের ফল বদলে গেল। তাদের শরীরে হয়ত জঙ্গলের খাবার ও পরিবেশের যে প্রভাব রয়েছে, তাতে ট্রায়ালে এমন সিম্পটম হয়ত প্রাণীটির শরীরে দেখা গেল যেটা ওই টিকার প্রভাবে হয়নি। এতে কনফিউশন তৈরি হবে। এতে ট্রায়ালে নিখুঁত ফল পাওয়া যাবে না।’

তিনি বলছেন, পরীক্ষার জন্য প্রাণীটি এমন হতে হবে যেন তার শরীরে অন্য কিছুর প্রভাব না থাকে যা ট্রায়ালকে প্রভাবিত করবে।

প্রটোকল অনুযায়ী ল্যাবে পরীক্ষার জন্য যে প্রাণী ব্যাবহার করা হবে তাকে একটি নির্দিষ্ট পরিবেশে শুধু দুই-চার দিন রাখলে হবে না।

প্রটোকলে সেটিরও একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা বলা আছে। বিশ্বব্যাপী ঔষধ নিয়ে যারা কাজ করে তারা নিজেরা লালনপালনের মাধ্যমে প্রাণী সংরক্ষণ করে থাকে, বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক ফারুক।

অনুমতি ছিল গ্লোব বায়োটেকের
গাজীপুরে গ্লোব বায়োটেক লিমিটেডের পক্ষে যারা বানর ধরতে গিয়েছিলেন তাদের কাছে বন অধিদপ্তরের অনুমতিপত্র ছিল।

প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী বলেছেন, কোম্পানিটির পক্ষ থেকে জুন মাসে অনুমতি নেয়া হয়েছে। তোরা ৫৬টি বানর ধরার জন্য অনুমতি নিয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন, ২০১২ যেটা সেখানে নির্দিষ্ট একটি ধারা রয়েছে। যেখানে বলা আছে, কোন গবেষণার জন্য অনুমতি দেয়া যাবে। সেই ধারা অনুযায়ী ওনারা আমাদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছে। গাজীপুরে আমাদের যে সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রয়েছে, ওনার তত্ত্বাবধানে এই বানর ধরার জন্য তাদের অনুমতি দেয়া হয়েছে।’

বন্যপ্রাণী কিভাবে আটক করতে হবে, কিভাবে বহন করতে হবে সে ব্যাপারেও আন্তর্জাতিক আইন রয়েছে।

এক্ষেত্রে প্রাণীর প্রতি নৈতিকতার বিষয়টি মেনে চলার ব্যাপারে জোর দেয়া হয়। কিন্তু কারোর সাথে যোগাযোগ না করে নিজেরাই বানর ধরতে চলে যান কোম্পানিটির কর্মীরা।

সে ব্যাপারে জানতে চাইলে, প্রধান বন সংরক্ষক বলেন, ‘আমাদের মাঠ পর্যায়ের যারা আছে, ডিভিশনাল যে ফরেস্ট অফিসার আছে তাদেরকে আমরা জানিয়ে রেখেছিলাম যে বঙ্গভ্যাক্সের (পরীক্ষার) জন্য গ্লোব বায়োটেক, তাদের রিসার্চ কার্যক্রমের জন্য বানর ধরার অনুমতি দেয়া হয়েছে।’

নৈতিকতার প্রশ্ন
গবেষণার জন্য বন্যপ্রাণী কীভাবে আটক করতে হবে, কীভাবে বহন করতে হবে, তাকে শারীরিক কষ্ট না দিয়ে গবেষণার কাজে কতটুকু ব্যাবহার করা যাবে এবং আবারও কীভাবে প্রকৃতিতে ছেড়ে দিতে হবে এই সব ব্যাপারে নৈতিকতার বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে গবেষকরা অনুসরণ করেন।

প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজার্ভেশন অব নেচার বা আইইউসিএন।

এর সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোঃ নিয়ামুল নাসের বলছেন, ‘এটা পুরোটাই আনএথিকাল (নীতিবহির্ভূত) এবং অদ্ভুতও। এভাবে অবশ্যই গবেষণা করা যাবে না। বিশ্বব্যাপী গবেষণার জন্য অনেক দেশ বানর লালনপালন করে বিক্রি করে। উচিত কাজ হত যদি কোম্পানিটি দেশের বাইরে থেকে বানর কিনে আনত। বাংলাদেশে বিদেশ থেকে বানর আমদানির সুযোগ আছে। বাংলাদেশের চিড়িয়াখানাগুলো মাঝে মাঝে বানর বিদেশ থেকে কিনে আনে।’

‘তাছাড়া বানর খুবই সামাজিক প্রাণী। তাদের পরিবার থাকে, নেতা থাকে, তারা বড় দলে বসবাস করে। এখন কয়েকটাকে ধরে নিয়ে গেলে তাদের প্রতি অবিচার হবে।’

অধ্যাপক নাসের মনে করেন, বন্যপ্রাণীকে গবেষণায় ব্যাবহারের কথা বাংলাদেশের আইনে বলা হলেও সেই প্রাণীকে ঔষধ বা টিকা প্রস্তুতের ক্ষেত্রে ‘ক্লিনিকাল ট্রায়ালে’ ব্যাবহার করা যাবে কিনা সেটি এক্ষেত্রে স্পষ্ট নয়।

আইনটি নিয়ে আরও চিন্তা করা দরকার বলে তিনি মনে করেন। তার ভাষায়, গবেষণা এবং ক্লিনিকাল ট্রায়াল, এই দুটি বিষয় এক নয়।

‘যেমন আমরা গবেষণার জন্য বানর ধরে তার রক্ত নিলাম। তারা শরীরে কি ধরনের জীবাণু বহন করে সেটা নিয়ে গবেষণার জন্য। আবার জিনোমিক পরীক্ষার জন্য সুন্দরবনের শুকরের লোম নিয়েছি। ট্রাংকুয়ালাইজার দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে বাঘের শরীরের লোম নিয়েছি। প্রাণীটিকে ধরে কিন্তু আমরা আবার ছেড়ে দিচ্ছি। এই ধরনের গবেষণার জন্য বন্যপ্রাণী ধরা যেতে পারে কিন্তু ক্লিনিকাল ট্রায়ালের জন্য নয়।’

বন্যপ্রাণীর শরীরে প্রচুর ‘ডিজিজ’ থাকে বিশেষ করে বানর অনেক বেশি ভ্রাম্যমাণ হয় বলে তারা অনেক অসুখ বহন করে ছড়িয়ে দিতে পারে।

সে জন্যও প্রকৃতি থেকে সরাসরি নিয়ে বানরের শরীরে ‘ক্লিনিকাল ট্রায়াল’ হওয়া উচিৎ নয় বলে মন্তব্য করেছেন অধ্যাপক নাসের। এতে সঠিক ফল নাও পাওয়া যেতে পারে।

বঙ্গভ্যাক্সের ট্রায়াল কি বানরে এসে আটকে গেলো?
গ্লোব বায়োটেক লিমিটেডের সিনিয়র ম্যানেজার ডা. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন জানিয়েছেন মডার্না এবং ফাইজার টিকা আবিষ্কারে যে এমআরএনএ প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে তারাও সেই প্রযুক্তি ব্যবহার করেছেন যাতে বানরের ওপরে ট্রায়াল করার প্রয়োজন নেই।

তবুও সেই বাধ্যবাধকতা তাদের দিয়েছে বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল।

মহিউদ্দিন বলছেন, এই বছরের জানুয়ারি মাসে তারা কাউন্সিলের কাছে ‘এথিকাল ক্লিয়ারেন্সের’ জন্য আবেদন করেছেন কিন্তু তাদেরকে ছয়মাস পর জুন মাসে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে যে বানরের ওপর ট্রায়াল করতে হবে।

বাংলাদেশে ‘ক্লিনিকাল ট্রায়ালের’ জন্য প্রাণী সংরক্ষণ করে এ রকম স্থাপনা রয়েছে খুবই কম। যেগুলো রয়েছে তাতে ইঁদুর ও খরগোশ ইত্যাদি প্রাণী থাকলেও বানর নেই।

মহিউদ্দিন জানিয়েছেন, ‘তারা ছয় মাস সময় কেন নিলো আমাদের এটা জানাতে? ট্রায়াল করার জন্য জুন মাসে আমরা ইউরোপ, আমেরিকা, ভারত অনেকগুলো দেশের বিজ্ঞানীদের সাথে যোগাযোগ করি আমাদের জন্য ট্রায়ালটি করে দেবার জন্য। তারা সবাই আমাদের জানালো যে এমআরএনএ প্রযুক্তিতে বানরের উপর ট্রায়াল লাগে না, তাই অপ্রয়োজনীয় ট্রায়াল তারা করতে পারবে না। কারণ তাহলে প্রাণী অধিকার সংস্থা পেটা (পিপল ফর দ্যা এথিকাল ট্রিটমেন্ট অফ অ্যানিম্যাল) তাদের বাধা দেবে। ভারতে গেলাম সেখান থেকে বলা হল তারা ট্রায়াল করে দেবে কিন্তু সরকারিভাবে জিটুজি পদ্ধতিতে আসতে হবে।’

তিনি জানিয়েছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগে তারা এই ব্যাপারে সহযোগিতার জন্য চিঠি দিয়েছিলেন। এরপর স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগ স্বাস্থ্য সেবা বিভাগকে একটি চিঠি দিলেও বিষয়টি আর এগোয়নি।

গ্লোব বায়োটেকের এই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তারা এক পর্যায়ে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেন।

সেখান থেকে তাদের ছাড়পত্র দেয়া হয় এবং গাজীপুর সাফারি পার্ক থেকে বানর সংগ্রহের অনুমতি দেয়া হয়।

এর পর সেখান থেকে বেশ কিছু বানর তারা সংগ্রহ করেছেন এবং সেগুলো কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। কোয়ারেন্টিন শেষ হলে তবেই তাদের ওপর টিকার ট্রায়াল করা হবে।

তিনি বলছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের মডার্না তাদের রেগুলেটরি অথরিটির কাছ থেকে কয়দিনে অনুমতি পেয়েছে? তারা কিন্তু ১৪ দিন ইঁদুরের উপর ট্রায়াল করে মানুষের উপর ট্রায়াল করেছে, ফাইজার কোন ধরনের অ্যানিম্যাল ট্রায়াল ছাড়াই হিউম্যান ট্রায়ালের ফেজ ওয়ান ও টু সম্পন্ন করেছে। দুটো কোম্পানিই ফেজ থ্রিতে এসে বানরের উপর ট্রায়াল করেছে।’

‘মডার্না আমাদের এক মাস আগে, গত বছরের মার্চে কাজ শুরু করেছে এবং ডিসেম্বরে তাদের টিকা বাজারে চলে এসেছে। আর আমরা এখনো ট্রায়ালই করতে পারিনি। বানরে এসে আটকে গেছি।’

এবিএন/সাদিক/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ