আজকের শিরোনাম :

আফগানিস্তানে ২০ বছর : এই যুদ্ধে কি আদৌ কোনো লাভ হয়েছে

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৯ এপ্রিল ২০২১, ১৩:০৪

দীর্ঘ ২০ বছর পর আমেরিকান এবং ব্রিটিশ সৈন্যরা আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এ মাসেই প্রেসিডেন্ট বাইডেন ঘোষণা করেছেন যে প্রায় ২৫০০ থেকে ৩৫০০ মার্কিন সৈন্য আফগানিস্তানে এখনো রয়েছে, তারা ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে দেশে ফিরে যাবে। একই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্রিটেন। তাদের অবশিষ্ট ৭৫০ জন সৈন্যও একই সময়ে আফগানিস্তান থেকে চলে আসবে।

সব সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য যে দিনটি ঠিক করা হয়েছে তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ২০ বছর আগে ঐ দিনই আল কায়েদা আমেরিকায় সন্ত্রাসী হামলা চালায় যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল আফগানিস্তানে। ঐ হামলার নেতৃত্বও দেয়া হয় সেখান থেকে।

ঐ সন্ত্রাসী হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এক কোয়ালিশন আফগানিস্তানে হামলা চালিয়ে তালেবানকে ক্ষমতাচ্যুত করে। আল কায়েদাকেও সাময়িকভাবে সেদেশ থেকে বিতাড়িত করে।কিন্তু গত ২০ বছর ধরে আফগানিস্তানে সামরিক এবং নিরাপত্তা তৎপরতার জন্য বিশেষ করে আমেরিকাকে চড়া মূল্য দিতে হয়েছে।

এখন পর্যন্ত ২৩০০ মার্কিন সেনা আফগানিস্তানে মারা গেছে। জখম হয়েছে ২০,০০০। সেই সাথে ৪৫০ জন ব্রিটিশ সৈন্য মারা গেছে। আরো কয়েকটি দেশের কয়েকশ সৈন্য প্রাণ হারিয়েছে দুই দশকের এই যুদ্ধে।

তবে এই যুদ্ধে বহুগুণ বেশি হতাহত হয়েছে আফগানরা। আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর ৬০ হাজারেরও বেশি সদস্য মারা গেছে। সাধারণ বেসামরিক আফগানের মৃত্যুর সংখ্যা তার দ্বিগুণ।

আর অর্থ-কড়ি ব্যয় হয়েছে পাহাড় সমান। এখন পর্যন্ত আফগান যুদ্ধের জন্য মার্কিন করদাতাদের প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার যোগাতে হয়েছে।

সুতরাং অপ্রিয় হলেও এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে যে এই প্রাণহানি আর বিপুল অর্থ খরচের আদৌ কি কোন প্রয়োজন ছিল? তবে এই প্রশ্নের সহজ কোনো উত্তর মেলা শক্ত।

প্রথমত দেখতে হবে যে কেন পশ্চিমা দেশগুলো আফগানিস্তানে গিয়েছিল? কি লক্ষ্য তারা অর্জন করতে চেয়েছিল?

১৯৯৬ থেকে পরের পাঁচ বছর ধরে ওসামা বিন লাদেনের নেতৃত্বে আল কায়েদা আফগানিস্তানে গেড়ে বসেছিল। সেখানে তারা সন্ত্রাসী প্রশিক্ষণ শিবির গড়ে তোলে। কুকুরের ওপর বিষাক্ত গ্যাসের পরীক্ষা শুরু করে। বিভিন্ন দেশ থেকে কম-বেশি ২০,০০০ জিহাদি স্বেচ্ছাসেবী জোগাড় করে আফগানিস্তানে তাদের প্রশিক্ষণ দেয়। ১৯৯৮ সালে আল কায়েদা কেনিয়া এবং তাঞ্জানিয়াতে মার্কিন দূতাবাসে সন্ত্রাসী হামলা চালায় যাতে ২২৪ জন নিহত হয়।

আল কায়েদা সে সময় আফগানিস্তানে কোনো বাধা ছাড়াই তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে পারছিল, কারণ তাদের পেছনে সমর্থন ছিল ক্ষমতাসীন তালেবানের যারা সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহারের পর শুরু হওয়া রক্তাক্ত এক গৃহযুদ্ধে জয়ী হয়ে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে।

যুক্তরাষ্ট্র তাদের মিত্র সৌদি আরবের মাধ্যমে তালেবানকে রাজী করানোর চেষ্টা করে তারা যেন আল কায়েদাকে আফগানিস্তান থেকে তাড়ায়। কিন্তু তালেবান তা প্রত্যাখ্যান করে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার পর সন্দেহভাজনদের ধরে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য আমেরিকা এবং তার মিত্র দেশগুলো তালেবানকে চাপ দেয়। তখনও তা মানতে অস্বীকার করে তারা।

এর পর আমেরিকান এবং ব্রিটিশ সৈন্যদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় নর্দার্ন আ্যালায়ান্স নামে তালেবান বিরোধী একটি আফগান মিলিশিয়া গোষ্ঠী অভিযান চালিয়ে তালেবানকে ক্ষমতাচ্যুত করে। আল কায়েদা পালিয়ে পাকিস্তান-আফগান সীমান্তে আশ্রয় নেয়।

নির্ভরযোগ্য নিরাপত্তা সূত্রগুলো এ সপ্তাহে বিবিসিকে বলেছে তার পর থেকে বিশ্বের কোথাও একটিও সফল কোন সন্ত্রাসী হামলা হয়নি যার পরিকল্পনা হয়েছে আফগানিস্তানে। ফলে, শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস-বিরোধী তৎপরতার বিবেচনায় আফগানিস্তানে পশ্চিমা সামরিক এবং নিরাপত্তা তৎপরতা কাজে দিয়েছে।

কিন্তু তার যে করুণ পরিণতি গত ২০ বছরে আফগান জনগণকে- সামরিক এবং বেসামরিক- ভোগ করতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে- সে বিবেচনায় ঐ নিরাপত্তা সাফল্য ম্লান হতে বাধ্য।

অ্যাকশন অন আর্মড ভায়োলেন্স নামে একটি গবেষণা সংস্থার হিসাব মতে, ২০২০ সালেও বিশ্বের যে কোনো দেশের চেয়ে আফগানিস্তানে বিভিন্ন বিস্ফোরকের আঘাতে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে। আল কায়েদা, ইসলামিক স্টেট সহ আরো অনেক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সেদেশে নির্মূল হয়নি। বরঞ্চ তাদের শক্তি ধীরে ধরে বেড়েছে এবং অবশিষ্ট পশ্চিমা সৈন্যের প্রত্যাহারের সম্ভাবনায় তাদের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে।

২০০৩ সালে, পাটকিয়া প্রদেশে মার্কিন সেনাবাহিনীর ১০ম মাউন্টেন ডিভিশনের একটি প্রত্যন্ত ঘাঁটিতে বসে বিবিসির সিনিয়র সহকর্মী ফিল গুডউইন আফগান যুদ্ধের চূড়ান্ত পরিণতি নিয়ে আমার কাছে গভীর সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি তখন বলেছিলেন, ‘২০ বছরের মধ্যে আফগানিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলের অধিকাংশ জায়গায় তালেবান আবারো ক্ষমতা নিয়ে নেবে।’

সত্যিই তালেবান এখন আবারো পুরো আফগানিস্তানের ভবিষ্যতের প্রধান নিয়ন্তা হয়ে উঠেছে।

তার পরও ব্রিটেনের সেনা প্রধান জেনারেল স্যার নিক কার্টার, যিনি কয়েকবার আফগানিস্তানে গেছেন, মনে করেন গত বিশ বছরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আফগানিস্তানে এমন একটি নাগরিক সমাজ গঠনে সক্ষম হয়েছে যার সাথে ভবিষ্যতে তালেবানকে আপস করতে হবে।

তিনি বলেন, ‘২০০১ সালের তুলনায় আফগানিস্তান এখন ভালো একটি দেশ এবং তালেবান এখন অপেক্ষাকৃত অনেক খোলা মনের একটি গোষ্ঠী।’

আফগান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে কতটা মূল্য দিতে হয়েছে?
গবেষণা প্রতিষ্ঠান এশিয়া প্যাসিফিক ফাউন্ডেশনের ড. সজ্জন গোহেল অবশ্য তালেবানের ব্যাপারে সন্দিহান। তিনি বলেন, ‘বড় ধরনের উদ্বেগ রয়েছে যে ১৯৯০ দশকের মত আফগানিস্তান আবারো সন্ত্রাসীদের আবাসভূমি হয়ে উঠতে পারে।’ পশ্চিমা অনেক দেশের গোয়েন্দা সংস্থার ভেতরেও এই ভয় রয়েছে।

ড. গোহেল বিশ্বাস করেন পশ্চিমা অনেক দেশে থেকে নতুন করে অনেক সন্ত্রাসী প্রশিক্ষণের জন্য দলে দলে আফগানিস্তানে হাজির হবে।। ‘পশ্চিমা দেশগুলো এটা সামলাতে পারবেনা কারণ এরই মধ্যে তারা আফগানিস্তানকে পরিত্যাগ করেছে।’

তবে এই বিপদ যে অবধারিতভাবে ঘটবেই তা বলা কঠিন। এই পরিণতি হবে কিনা তা নির্ভর করবে দুটো বিষয়ের ওপর : প্রথমত, তালেবান তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় আল কায়েদা এবং ইসলামিক স্টেটকে সহ্য করবে কিনা, এবং দ্বিতীয়ত, তেমন কিছু দেখা গেলে পশ্চিমা দেশগুলো তখন কি ভূমিকা নেবে।

ফলে সামনের দিনগুলোতে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি কি দাঁড়াবে তা অনেকটাই অনিশ্চিত, অস্বচ্ছ। তবে এটাও ঠিক ২০০১ সালের পর কে ভেবেছিল এই যুদ্ধ ২০ বছরেও শেষ হবে না।

আমেরিকান, ব্রিটিশ বা আমিরাতের সৈন্যদের ছায়ায় থেকে খবর সংগ্রহের জন্য কয়েকবার আমি আফগানিস্তানে গেছি। অনেক স্মৃতির মধ্যে একটি অমি কখনই ভুলি না- পাকিস্তানের সীমান্ত থেকে মাত্র তিন মাইল দূরে মার্কিন বাহিনীর ছোট একটি ঘাঁটির ভেতর মাটির দেয়াল ঘেরা ঘরের ভেতর গুলির বাক্সের ওপর আমরা বসে আছি। রাতের স্বচ্ছ আকাশ তারায় ভরা। জার্মানি থেকে আসা স্টেক দিয়ে কিছুক্ষণ আগে আমরা রাতের খাবার সেরেছি।

রাতে আরো পরের দিকে ঐ ঘাঁটির ১৯ বছরের মার্কিন এক সৈন্য বলেছিল সেখানে অবস্থানকালে বেশ কজন সঙ্গীকে সে হারিয়েছে। ‘আমারও মৃত্যুর সময় আসতে পারে, আসলে আমার করার কিছু নেই।’

তারপর সৈন্যদের একজন একটি গিটার বের করে গান গাইলো। গানের শেষ কথাগুলো ছিল- ‘আমি এই নরকে বসে কি করছি? এই জায়গার সাথে আমার তো কোনো সম্পর্ক নেই।’

আমার নিজেরও সেদিন মনে হয়েছিল, ‘সত্যিই তো, এই জায়গার সাথে আমাদের তো কোনো সম্পর্ক নেই!’
খবর বিবিসি বাংলার

এবিএন/সাদিক/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ