চ্যাটজিপিটি কেন সবার আগ্রহের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে?

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৩:৩৮

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই অ্যাপলিকেশনটি আপনার যেকোনো প্রশ্নের উত্তর হাজির করতে পারে। সবচেয়ে অভিনব হলো, প্রচলিত কম্পিউটার সফটওয়্যার বা অ্যাপলিকেশনের বাইরে গিয়ে সেখানে সে নিজের মতো বুদ্ধিমত্তা বা মানবিকতার ছোঁয়াও দিতে পারে।

গত বছরের নভেম্বরে তৈরি হওয়ার পর সারা বিশ্বেই এখন চ্যাটজিপিটি নিয়ে একটা আগ্রহ তৈরি হয়েছে। শুধু জানুয়ারি মাসেই বিশ্বের প্রায় ১০ কোটি মানুষ চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করেছে।

কিন্তু এটি নিয়ে আগ্রহের পেছনে কারণগুলো কী? কেন চ্যাটজিপিটি অনেকের আশঙ্কার কারণও হয়ে উঠেছে?

চ্যাটজিপিটি কী?
চ্যাটজিপিটির পুরো নাম চ্যাট জেনারেটিভ প্রি-ট্রেইনড ট্রান্সফর্মার। এটি হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এমন একটি অ্যাপলিকেশন যাকে বলা হয় ‘লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল টুলস’।

এটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একটি চ্যাটবট সিস্টেম বা আলাপচারিতা করার অ্যাপলিকেশন। এটি ইন্টারনেটে থাকা নানা তথ্য-উপাত্ত নিয়ে লিখিত প্রশ্নের জবাব হাজির করে। সে ফরম্যাট বা যেভাবে চাওয়া হয়, অনেকটা সেভাবেই সে এসব উত্তর দেয়।

প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির বলছেন, ‘এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যতোগুলো ইঞ্জিন আমরা এর আগে দেখেছি, তার মধ্যে এটাই সবচেয়ে স্মার্টেক্স। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার যে এমন স্মার্টলি করে, যেটা মানুষজন এর আগে ভাবেনি। এ কারণেই এটা নিয়ে সবার এতো আগ্রহ তৈরি হয়েছে।’

একে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের একটি ছোটখাটো বিপ্লব বলে তিনি বর্ণনা করছেন।

এর আগেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। গুগল বা এক্সপ্লোরারের মতো সাইটগুলোয় কোন অনুসন্ধান করলে সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটের লিংক হাজির করে।

কিন্তু চ্যাটজিপিটি যেভাবে সরাসরি সুনির্দিষ্ট উত্তর দিয়ে দেয়, এমনটা আর দেখা যায়নি।

সে রচনা লিখতে পারে, চাকরির বা ছুটির আবেদন, চুক্তিপত্র, কোন ঘটনা সম্পর্কে ব্যাখ্যা, ছোটখাটো প্রতিবেদন তৈরি করে দিতে পারে।

এমনকি এটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম, গান বা কবিতাও লিখতে পারে।

উত্তর পছন্দ না হলে তাকে বললে সে আবার আরও ভালো করে উত্তর তৈরি করে।

সুমন আহমেদ সাবির বলছেন, চ্যাটজিটিপিকে প্রশ্ন করলে হয়তো একটা লিগ্যাল ডকুমেন্ট লিখে দিচ্ছে, প্রোগ্রাম লিখে দিচ্ছে, একটা রিপোর্ট তৈরি করে দিচ্ছে। ফলে অনেকের কাজ বেশ সহজ হয়ে গেছে। সেটাও এর জনপ্রিয়তার একটা কারণ।

‘এমনকি আপনি যদি এর সাথে ছোটখাটো রসিকতাও করেন, সেটাও কিন্তু সে বুঝতে পারে,’’ বলছেন সাবির।

এই প্রোগ্রামের সুবিধা হলো, ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে এটি আরও বেশি শিখতে থাকে। ব্যবহারকারীর প্রশ্নের ধরন বা তথ্য থেকেও সে নিজেকে সমৃদ্ধ করে তোলে।

তবে একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, চ্যাটজিপিটি আসলে নিজে থেকে কিছু জানে না। তাকে এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে বা তৈরি করা হয়েছে যে, সে ইন্টারনেটে থাকা তথ্য-উপাত্ত খুঁজে উত্তরটি তৈরি করে।

তবে চ্যাটজিপিটি এখনো লাইভ কাজ করে না। ইন্টারনেটে ২০২১ সাল পর্যন্ত যেসব তথ্য রয়েছে, শুধু সেগুলোই তার তথ্যভাণ্ডারে রয়েছে।

কারা তৈরি করেছে?
যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রানসিসকোর ‘ওপেনএআই’ নামের একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান চ্যাটজিপিটি উদ্ভাবন করেছে।

২০১৫ সালে কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইলন মাস্ক এবং স্যাম অ্যাল্টম্যানসহ আরও কয়েকজন। যদিও ইলন মাস্ক ২০১৮ সালে বোর্ড থেকে পদত্যাগ করেন।

এই প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য হলো ‘নিরাপদ এবং সুবিধার’ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবস্থা তৈরি করা।

গত বছর ৩০ নভেম্বর কোম্পানিটি চ্যাটজিপিটি তৈরির ঘোষণা করে।

এর আগে এই প্রতিষ্ঠানটি জিপিটি-৩ নামের একটি অ্যাপলিকেশন তৈরি করেছিল। সেটি এমন বার্তা লিখতে পারতো যা দেখে মনে হবে কোন মানুষ লিখেছে।

এরপর ডেল-ই নামের একটি অ্যাপ তৈরি করেছিল। সেখানে কারও লেখা বার্তা দিয়ে চিত্র তৈরি করতে পারত।

জিপিটি-৩ এবং পরবর্তী সময়ে তৈরি করা জিপিটি-৩.৫ মিলেই আজকের চ্যাটজিপিটি তৈরি করা হয়েছে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সক্ষমতা বাড়াতে সম্প্রতি এই প্রতিষ্ঠানে কয়েক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে মাইক্রোসফট। ২০১৯ সালে এই কোম্পানিতে এক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছিল মাইক্রোসফট।

ব্যবহারের জন্য টাকা লাগে?
এখন পর্যন্ত চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করতে কোনো টাকা লাগে না। তবে গত জানুয়ারি মাসে এই কোম্পানিটি একটি পেইড ভার্সন বা টাকার বিনিময়ে ব্যবহারের একটি ভার্সন চালু করেছে। পেইড ভার্সনটি আরও দ্রুত কাজ করে।

যখন পিক টাইমে অন্যরা চ্যাটজিপিটিতে ঠিক মতো প্রবেশ করতে পারেন না, সেই সময়েও কাজ করে।

আপাতত শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে মাসিক ২০ ডলার করে সার্ভিস চার্জ ধরা হয়েছে। বাকিরা এই ভার্সনটি ব্যবহার করতে চাইলে কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে বিনামূল্যের সেবাও চালু থাকছে।

চাকরির বাজার খর্ব করবে?
বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, একদিকে যেমন এটা অনেকের কাজ সহজ করে দেবে, তেমনি অনেক মানুষের জন্য চাকরির একটা ঝুঁকিও তৈরি করবে।

সুমন আহমেদ সাবির বলছেন, ‘মিডলেভেল কাজ যারা করেন, তাদের চাকরি হয়তো এখনি চ্যাটজিপিটির কারণে চলে যাবে না। কিন্তু এগুলোর দক্ষতা যখন আরও বাড়বে, এরকম আরও অ্যাপলিকেশন তৈরি হবে, একসময় কিন্তু সাধারণ অনেক কাজের জন্য আর প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মী রাখতে চাইবে না।’

‘এখন পর্যন্ত চ্যাটজিপিটির ব্যবহার এক ধরনের অ্যামেচার পর্যায়ে রয়েছে। কিন্তু খুব দ্রুত বাণিজ্যিক কাজে এটার ব্যবহার শুরু হবে, অনেক মানুষ এটার ব্যবহার করতে শুরু করবে। তখন জব মার্কেটে সেটার একটা ইমপ্যাক্ট পড়তে বাধ্য।’

সুমন আহমেদ সাবির ‘ছোটখাটো অনেক কাজের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলো হয়তো তখন ভাববে, এআই দিয়েই তো আমি দ্রুত কাজ করতে পারছি, খরচ বাঁচাতে পারছি। সেই চিন্তাভাবনা কিন্তু এক সময় আসবে।’

সারা বিশ্বেই গবেষক, শিক্ষার্থী এবং ব্যবসাসহ নানা পেশার মানুষজন চ্যাটজিপিটির সহায়তা নিতে শুরু করেছেন।

আবু জাফর আহমেদ তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘নানা কাজে অ্যাসাইনমেন্ট রিপোর্ট লেখার সময় পাচ্ছিলাম না। চ্যাটজিপিটিকে বললাম, মিনিটের মধ্যে লিখেছিল। একটু এডিট করে চমৎকার একটা রিপোর্ট হয়ে গেল।’

প্রতিরোধের উপায় কী?
ঢাকা বসেই যুক্তরাষ্ট্র এবং ক্যানাডার কয়েকটি কোম্পানির জন্য লেখালেখি এবং কনটেন্ট তৈরির কাজ করেন আরিফুল হাসান।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কনটেন্ট তৈরি করা, প্রতিবেদন লেখা, গ্রাহক সেবার মতো অনেক কাজের জন্য মানুষ এই প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে পারে।

তবে চ্যাটজিপিটি নিয়ে এখনি উদ্বিগ্ন হতে রাজি নন আরিফুল হাসান।

‘সবাই এখন এটা নিয়ে কথা বলছে, আমিও ব্যবহার করে দেখেছি। চ্যাটজিপিটি কিন্তু পুরোপুরি নির্ভুল উত্তর দিতে পারে না। তার কাছ থেকে যে উত্তরটা পাওয়া যায়, সেটাও কিন্তু আরেকবার যাচাই করে দেখার দরকার হয়। ফলে এখানে একটা হিউম্যান টাচ দিতেই হবে,’ বলছেন হাসান।

তবে এই প্রযুক্তি আরও উন্নত হলে তাদের মতো কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের জন্য একটা ঝুঁকি তৈরি হতে পারে, সেই আশঙ্কাও আছে তার মনে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব অ্যাপলিকেশন নিজেদের পেশার জন্য ভবিষ্যতে ঝুঁকি তৈরি করতে পারে বলে যারা মনে করছেন, তাদের উচিত এখনি নিজেদের দক্ষতা আরও বাড়ানো এবং ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করে তোলা।

সমালোচনা এবং উদ্বেগ
সারা বিশ্বে যখন চ্যাটজিপিটি মানুষের আগ্রহ তৈরি করেছে, তেমনি অনেকে এর মধ্যে নেতিবাচক অনেক কিছুও আবিষ্কার করেছেন।

আরিফুল হাসান বলছেন, ‘ইন্টারনেটে তো নানা ধরনের বিভ্রান্তিকর তথ্যও রয়েছে। আপনি চ্যাটজিপিটিকে জিজ্ঞেস করলে সে এসব ভুল তথ্যও হাজির করে। সত্যিটা জানা না থাকলে আপনি কিন্তু বিভ্রান্ত হতে পারেন।’

বিবিসির প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক জোই কিলম্যান লিখেছেন, চ্যাটজিপিটিকে বলা হয়েছিল বিবিসি ওয়েবসাইটের জন্য একটি নিবন্ধ লিখতে। যে সাংবাদিক সেটা নিয়ে কাজ করেছেন, তিনি বলেছেন, বিবিসি যে ধরনের লেখা প্রকাশ করে, তার কাছাকাছি হওয়ার জন্যও লেখাটার অনেক পর্যালোচনা ও সম্পাদনার দরকার আছে। সেটা করার পরেও প্রকাশের উপযুক্ত করা যায়নি চ্যাটজিপিটির লেখাটিকে।

এ নিয়ে কাজ করা সাংবাদিকরা বলেছেন, যদিও এটা খুব দ্রুত লেখাটি তৈরি করেছে, কিন্তু সেটা যাচাই-বাছাই করতে গিয়ে অনেক সময় নষ্ট হয়েছে।

সুমন আহমেদ সাবির বলছেন, সব প্রযুক্তির কিছু ভালোমন্দ দিক থাকে। চ্যাটজিপিটিও তার বাইরে নয়।

‘এটার একটা খারাপ ব্যবহারের সম্ভাবনা আছে। যেহেতু সে অনেকটা মানুষের মতো আচরণ করে, ফলে এটা অনেক সময় প্রতারণার কাজে ব্যবহার করা হতে পারে। তথ্য চুরি, কাজে ফাঁকি দেয়ার মতো কাজে ব্যবহার করা হতে পারে,’ তিনি বলছেন।

‘সাইবার ক্রাইম নিয়ে এখন যেভাবে আমরা চিন্তাভাবনা করি বা কাজ করি, সেখানেও আমাদের ভিন্নভাবে ভাবতে হবে।’

চুরি ঠেকাতে নিউইয়র্কের সরকারি স্কুলে ছাত্র ও শিক্ষকদের জন্য চ্যাটজিপিটি ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে সেখানকার কর্তৃপক্ষ।

তবে ওপেনএআই এক ঘোষণায় জানিয়েছে, তারা নতুন একটি সফটওয়্যার টুল তৈরি করেছে, যা চ্যাটজিপিটির মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার তৈরি করা লেখা শনাক্ত করতে পারবে।
তথ্যসূত্র : বিবিসি বাংলা

এবিএন/এসএ/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ