আজকের শিরোনাম :

সোশ্যাল মিডিয়া না থাকলে জীবন কেমন হবে?

  অতনু বিশ্বাস

২৩ অক্টোবর ২০২১, ০৯:১৫ | অনলাইন সংস্করণ

অক্টোবরের ৪ তারিখ ‘গেল গেল’ আর্তনাদ উঠল পৃথিবীময়। ঘণ্টা ছয়েকের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম। অগণিত সাধারণ মানুষ প্রথমে ঠিক বুঝে উঠতে পারেননি। তার পর প্রতিযোগী সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে উপচে পড়ে নেট-নাগরিকদের ভিড়। ফেসবুক কিংবা হোয়াটসঅ্যাপ-নির্ভর অসংখ্য ব্যবসা-বাণিজ্য থমকে যায় মুহূর্তেই।

কেমন হবে যদি শুধু কয়েকটি প্রধান মাধ্যম নয়, উধাও হয়ে যায় সব সোশ্যাল মিডিয়া? চিরতরে, কেবল কয়েক ঘণ্টার জন্য নয়। ধরে নিচ্ছি যে, সোশ্যাল মিডিয়া না থাকলেও গুগল, ইউটিউব কিংবা ইমেল ব্যবহার করা যাবে আগের মতোই। সোশ্যাল মিডিয়া উধাও হয়ে গেলে কি ভাল হবে, না কি মন্দ? বলা কঠিন। কার ভাল, সেটাও একটা প্রশ্ন বটে। তবে এটা ঠিক যে, আজকের প্রযুক্তি এবং জ্ঞানকে সঙ্গে নিয়ে পৃথিবী যদি কোনও ভাবে পৌঁছতে পারে কয়েক দশক আগেকার সেই অতীতের আবহে, তৈরি হবে এক নতুন স্বাভাবিকতা। কোভিড অতিমারির চাইতেও হয়তো অনেক বেশি প্রভাবশালী হতে পারে সেই ‘নিউ নর্মাল’।

পৃথিবীর ৯০ শতাংশের বেশি সংস্থা আজ সোশ্যাল মিডিয়ার সাহায্য নেয় চাকরি দেওয়ার ক্ষেত্রে। সোশ্যাল মিডিয়া উধাও হয়ে গেলে সংস্থাগুলোকে নিয়োগকার্যেও খুঁজতে হবে নতুন মডেল। প্রায় ৪০ লক্ষ ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞাপন দেয় ফেসবুকে, পাঁচ কোটি প্রতিষ্ঠান ফেসবুকে যোগাযোগ রাখে ক্রেতাদের সঙ্গে। তাই সোশ্যাল মিডিয়া ‘ভ্যানিশ’ হয়ে গেলে বহু ব্র্যান্ডই যে টিকে থাকতে পারবে না, সে কথা বলা বাহুল্য। কাজ হারাবেন লক্ষ লক্ষ মানুষ, শেয়ার বাজারে ধস নামবে, এ সব অনুমান করা যায় সহজেই। বিশ্বব্যাপী এক চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে পারে। সৃষ্টি হতে পারে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অবসাদের মুহূর্ত।

প্রাথমিক ঘোর কাটলে অবশ্য শুরু হবে নতুন স্বাভাবিকতার নির্মাণ। আসক্তি থেকে মুক্তি পেয়েও খাঁচায় ঢোকার জন্য ছটফট করবেন অগণন মানুষ, অন্তত প্রাথমিক ভাবে তো বটেই। ক্রমে মানুষের বাইরে বার হওয়ার প্রবণতা বাড়বে, বাড়বে উৎপাদনশীলতাও। স্মার্টফোনে আসক্তি সম্ভবত কমবে, ফলে ভাল হবে চোখের স্বাস্থ্যও। সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যাপক ব্যবহার যে অনেক ক্ষেত্রেই হতাশা বাড়ায়, অন্যের জীবনের সঙ্গে ক্রমাগত তুলনা যে আমাদের নিজেদের জীবনের সন্তুষ্টি কমিয়ে দেয়, সে বিষয়ে অনেকেই একমত। সোশ্যাল মিডিয়া না থাকলে কমবে এই অবাঞ্ছিত তুলনার সুযোগ। বহু মানুষের পোশাক কিংবা গৃহসজ্জা যাবে বদলে। অনেকেরই গৃহসজ্জার ডিজ়াইন যে আজ হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘ইনস্টা-ইন্টেরিয়র’।

ব্যক্তিগত তথ্য হাটের মাঝে উজাড় করে দেওয়ার দুর্বার প্রবণতা কি কমবে সোশ্যাল মিডিয়া না থাকলে? কে জানে! মনে করা যাক ১৯৯৮-এর বাণিজ্য-সফল হলিউড ছবি দ্য ট্রুম্যান শো-এর কথা। ট্রুম্যানের ভূমিকায় জিম কেরি, যে চরিত্রটিকে তার জন্মের আগেই বিক্রি করে দেওয়া হয় এক রিয়্যালিটি টেলিভিশন শো-এর জন্যে। ‘সিহাভেন’ নামের দৈত্যাকৃতি গম্বুজের মধ্যেই ট্রুম্যানের বেড়ে ওঠা, ৩০ বছর ধরে তার জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপ গোটা পৃথিবীর দর্শকের কাছে পৌঁছচ্ছিল হাজার হাজার ক্যামেরার সাহায্যে। গম্বুজের মধ্যেকার অভিনেতাদের সবাই জানত এই রিয়্যালিটি শোয়ের কথা, কেবল ট্রুম্যান ছাড়া। সোশ্যাল মিডিয়া এবং প্রাইভেসির সঙ্গে ছবিটিকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে বার বার, যদিও সে সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ার রমরমা বিশেষ হয়নি। লিঙ্কড্‌ইন শুরু হয় ২০০৩-এ, ফেসবুক ২০০৪-এ, ২০০৬-এ টুইটার, টাম্বলার ২০০৭-এ, আর হোয়াটসঅ্যাপ আর ইনস্টাগ্রামের সূত্রপাত ২০১০-এ। পর্দার ট্রুম্যান কিন্তু তার প্রাইভেসি-হীনতার কথা, বন্দিদশার বৃত্তান্ত জানতে পেরেই ফেটে পড়েছে বিদ্রোহে। অন্য দিকে, আজ অগণন বিশ্ব-নাগরিক সোৎসাহে তাঁদের প্রতিটি পদক্ষেপকে সোশ্যাল মিডিয়ার মধ্য দিয়ে উন্মুক্ত করতে চাইছেন চেনা-অচেনা সকলের সামনে। তাই আমরা সত্যিই প্রাইভেসি বলতে কী বুঝি, কিংবা কতটা মূল্য দিই প্রাইভেসিকে, বলা মুশকিল।

দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় সাম্প্রতিক এক প্রবন্ধে ফেসবুককে বলা হয়েছে আধুনিক পৃথিবীর সিগারেটের নেশা। কিন্তু, কোভিডকালে লকডাউন বা বিধিনিষেধের পৃথিবীতে যোগাযোগ বজায় রাখতে সোশ্যাল মিডিয়ার উপযোগিতা আমরা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছি। একশো বছর আগেকার স্প্যানিশ ফ্লু-র সঙ্গে আজকের দিনের অতিমারির সবচেয়ে বড় তফাত বোধ হয় এই সোশ্যাল মিডিয়াই। আজকের পৃথিবীতে, বিশেষ করে অতিমারি-বিধ্বস্ত দুনিয়াতে, শিক্ষাব্যবস্থা যে অনেকখানি সোশ্যাল মিডিয়া-নির্ভর হয়ে পড়েছে, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। অতিমারির মেঘ কেটে গেলেও এই নির্ভরতা কাটিয়ে পুরনো মডেল জাপটে ধরা সহজ নয় একেবারেই। সামাজিক সহায়তার হাত বাড়াতেও জুড়ি নেই সোশ্যাল মিডিয়ার। সোশ্যাল মিডিয়া উধাও হয়ে গেলে বিশ্বময় এই বন্ধন স্থাপন, ‘বন্ধু’ খুঁজে ফেরার কাজটা হয়ে যাবে অন্য রকম।

সদ্য শান্তির নোবেল পাওয়া সাংবাদিক মারিয়া রেসা ফেসবুকের খবরকে বলেছেন পক্ষপাতদুষ্ট। ও-দিকে ২০২১-এর পিউ সার্ভে-র এক রিপোর্ট বলছে, আমেরিকার ৮৬% প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ খবর সংগ্রহ করেন সোশ্যাল মিডিয়া থেকে। ছাপানো উৎস থেকে খবর নেন মাত্র ৫%। আশা করা যেতে পারে, সোশ্যাল মিডিয়া না থাকলে মানুষ বেশি করে সংবাদপত্র পড়বেন। পড়বেন বই, দেখবেন সিনেমা, বন্ধু বা সতীর্থদের সঙ্গে সামনাসামনি সময় কাটাবেন অনেক বেশি, স্মার্টফোন হাতে না রেখেই। হাতে লেখা চিঠির পুনর্জন্ম হওয়ার মতো আকাশকুসুম কিছু না হলেও, নতুন করে প্রাণ ফিরে পাবে ইমেল, এটা নিশ্চিত। আসলে সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ হয়ে গেলে বেঁচে যাবে অনেকটা সময়। আজ বিশ্ব জুড়ে মানুষ নাকি গড়ে দৈনিক প্রায় আড়াই ঘণ্টা খরচ করেন সোশ্যাল মিডিয়ার পিছনে। পৃথিবীর ২.৮৯ বিলিয়ন মানুষ সক্রিয় ভাবে ব্যবহার করেন ফেসবুক।

ও-দিকে আবার সোশ্যাল মিডিয়া না থাকলে দাঙ্গা সৃষ্টিকারী গুজব বা মিথ্যে খবর ছড়াবে অনেক ধীরে। সেই সঙ্গে এটাও ঠিক যে, আরব বসন্তের জুঁইয়ের সুবাস ছড়ানো হয়ে পড়বে অনেক কঠিন। দানা বাঁধা কঠিন হয়ে পড়বে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার, ওয়াল স্ট্রিট দখল, হংকংয়ের আন্দোলন কিংবা সৌদি মেয়েদের গাড়ি চালানোর আন্দোলন।

সোশ্যাল মিডিয়ার দুর্বার ব্যবহার কি বাড়িয়ে দিচ্ছে আমাদের একাকিত্ব? তা না থাকলে কি কমবে আমাদের নিজস্ব নির্জনতার অনুভব? কষ্টকল্পনার সোশ্যাল মিডিয়া-উত্তর সেই পৃথিবীতে ‘বন্ধু’ শব্দটাই যে পুনর্সংজ্ঞায়িত হবে, সে কথা বলা বাহুল্য।

আমরা যখন আগামী দিনের প্রেক্ষিতে গত কালের আগের দিনের রূপকথার পুনর্নির্মাণের কল্পিত গল্পকথা নিয়ে ভাবছি, সে সময়ে স্মরণ করা যাক দ্য নেশন পত্রিকায় প্রকাশিত কিংবদন্তি আমেরিকান কল্পবিজ্ঞান লেখক রে ব্র্যাডবেরি-র ১৯৫৩ সালের এক বহুচর্চিত প্রবন্ধের কথা। ব্র্যাডবেরি সেখানে বলেছেন ‘আগামী কালের পরের দিনের’ কথা, তাঁর সে দিনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই। এক রাতে বেভারলি হিলসে ব্র্যাডবেরির চোখে পড়ে এক স্বামী-স্ত্রী, যাঁরা বেরিয়েছেন তাঁদের কুকুরকে সঙ্গে নিয়ে। মহিলাটির এক হাতে একটি ছোট সিগারেট-প্যাকেটের আকৃতির রেডিয়ো, যেখান থেকে সরু তামার তার বেরিয়ে শেষ হয়েছে তাঁর ডান কানের ভিতরে। মহিলা যেন সেখানে আছেন স্বামী এবং কুকুরটির অস্তিত্ব বিস্মৃত হয়েই। শুনে চলেছেন বহু দূরের ফিসফাস এবং সোপ-অপেরার অনুরণন। যেন হাঁটছেন ঘুমের ঘোরে। তাঁর স্বামী তাঁকে উঁচু-নিচু রাস্তায় হাঁটতে সাহায্য করছেন বটে, কিন্তু ব্র্যাডবেরির মনে হল, সেই ভদ্রলোকের অস্তিত্বও যেন সেখানে নেই। সোশ্যাল মিডিয়ার বহু আগেকার, সাত দশক পুরনো এই খণ্ডচিত্র বুঝিয়ে দেয় যে, মানুষের স্ব-আরোপিত একাকিত্ব বোধ হয় চিরন্তন। তার প্রকাশভঙ্গি কেবল বদলায় সময়ের সঙ্গে, প্রযুক্তির হাত ধরে। নতুন পৃথিবীতে নতুন রূপে একক মানুষের একাকিত্বের নবনির্মাণই হয়তো সভ্যতার আবহমান ইতিহাস। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ উধাও হয়ে গেলে যেখানে নতুন আঙ্গিকে হয়তো তৈরি হবে এক অজানা, নতুন সোশ্যাল মিডিয়ার প্ল্যাটফর্ম। এক নতুনতর সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম।

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা।

 

সৌজন্যে: দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা।

এবিএন/জনি/জসিম/জেডি

এই বিভাগের আরো সংবাদ