মেসি-মায়ার আর্জেন্টিনা স্বর্গে ‘দেবদূত’-এর নাম দি মারিয়া!

  অর্পণ দাস

১৫ জুলাই ২০২৪, ১২:১৪ | অনলাইন সংস্করণ

বিশ্বের সেরা টুর্নামেন্টগুলোর ফাইনালে গোল আছে দি মারিয়ার
আর্জেন্টিনাতে একটি চার্চ আছে। যার নাম ইগ্লেসিয়া মারাদোনিয়া। আক্ষরিক অর্থেই মারাদোনার নামে তৈরি চার্চ। সেখানের ঈশ্বরের নাম দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা। ফুটবল ভক্তদের কাছে ঈশ্বরের সাক্ষাৎ রূপ। কে বলতে পারে, ভবিষ্যতে মেসি কিংবা রোনাল্ডোর নামেও তৈরি হবে কোনও মন্দির। যেখানে পূজিত হবেন সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দুই ফুটবলার। কিন্তু তার বাইরেও তো রথের রশি বয়ে নিয়ে যাওয়ার মানুষ থাকেন। সেই ‘ভগবান’-এর গ্রহেই থাকেন একজন লুকা মদরিচ। কিংবা জাভি-ইনিয়েস্তারা। আর থাকেন একজন ‘দেবদূত’—অ্যাঞ্জেল দি মারিয়া।

ফুটবল বিশ্বে যে ট্রফিগুলি সম্ভব, তার সবকটিতেই রয়েছে তাঁর স্পর্শ। আর্জেন্টিনার জার্সিতে ফুটবল কেরিয়ার ‘কমপ্লিট’। অলিম্পিকস, বিশ্বকাপ, কোপা আমেরিকা, ফাইনালিসিমা, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। সব ট্রফি জয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দি মারিয়ার নাম। আর সবকটির মধ্যে একটা মিলও আছে। প্রতিটা টুর্নামেন্টের ফাইনালের গোলদাতার তালিকায় আছে তাঁর নাম। এরকম বিরল রেকর্ড আর কারই-বা আছে? তিনি তো নিজেই তারকা, তবে মেঘে ঢাকা। সাফল্য-ব্যর্থতার হাজারও পথ অতিক্রম করে দি মারিয়া সেই ‘অ্যাঞ্জেল’-এর নাম, যিনি ভক্তদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দেন ফুটবলের ‘ভগবান’দের।

২০১৪-র বিশ্বকাপ ফাইনাল। মারাকানার সেই রাত আজও হৃদয় ভেঙে দেয় নীল-সাদা জার্সির সমর্থকদের। ১১৩ মিনিটে মারিও গোটজের শট যখন গোলে ঢুকছে, তখন অসহায়ের মতো হাত কামড়ানো ছাড়া কিছুই করার ছিল না দি মারিয়ার। চোটের জন্য খেলা হয়নি সেই ম্যাচ। শোনা যায়, বেপরোয়াভাবে চেষ্টা করেছিলেন মাঠে নামার। কিন্তু তাঁর তৎকালীন ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ থেকে নাকি বাধা এসেছিল! সেই জল্পনায় ঢুকে লাভ নেই। বরং দ্রুত পাতা উলটে চলে যাওয়া যায় পরের বছরগুলোতে। ২০১৫-র কোপা আমেরিকা, পরের বছর ফের শতবর্ষের কোপার আসর, আন্তর্জাতিক জার্সিতে মেসির অবসর, তাঁর প্রত্যাবর্তন, ২০১৮-র বিশ্বকাপ এবং শেষ পর্যন্ত ২০১৯-র কোপা। টানা হার, লাগাতার ব্যর্থতা। কোপার ফাইনালে হেরে চোখের জলে ভাসছেন লিওনেল মেসি। সতীর্থদের মাঝে মাথা নিচু করে বসে আছেন।

২০২২-র পর সেই ছবিগুলো দেখলে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। আজ আর্জেন্টিনা ভক্তদের কাছে সব পেয়েছির দেশের দরজা খুলে গিয়েছে। সাফল্যের সবকটি শৃঙ্গ ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখেছেন মেসি। আর ২০১৪-র বিশ্বকাপ হারের রাত্রি থেকে ২০২৪-র কোপা আমেরিকা। দুটো ১৪ জুলাইয়ের মধ্যে কেটে গিয়েছে দশ বছর। মেসি আর দি মারিয়া, দুই বন্ধু একসঙ্গে কেঁদেছেন, হেসেছেন। জীবনযুদ্ধে মার খেতে খেতে ফের উঠে দাঁড়ানোর নাম জীবন। তীব্র অ্যাড্রিনালিন রাশের মধ্যে ঠান্ডা মাথায় গোলের পাস বাড়িয়ে দেওয়ার নাম বন্ধুত্ব।

অলিম্পিকসের সময়ে মেসি-দি মারিয়া।

দি মারিয়ার আন্তর্জাতিক কেরিয়ারে এখন বেলাশেষের গান। সায়াহ্নে এসে দাঁড়িয়েছেন মেসিও। ‘লিটল বয় ফ্রম রোসারিও’ আজ মহীরুহ। তাঁর পাশেই শেষবার নীল-সাদা জার্সি গায়ে দিলেন দি মারিয়া। যাঁর জন্য কোপা জিততে চেয়েছিল গোটা আর্জেন্টিনা দল। কোনও আক্ষেপ নেই, অভিমান নেই। বিদায় নেওয়ার আগেই বলেছিলেন, “জীবনে যা চেয়েছি, তার থেকে অনেক বেশিই পেয়েছি।” সত্যিই তো, কজনের নামের পাশে লেখা রয়েছে বিশ্বের সেরা টুর্নামেন্টগুলোর ফাইনালের গোলের রেকর্ড? অলিম্পিকের ফাইনালে গোল। রিয়াল মাদ্রিদের জার্সিতে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালেও গোল। যা স্পেনের ক্লাবকে এনে দিয়েছিল লা ডেসিমা। অর্থাৎ, দশম ইউরোপ সেরা খেতাব। ২০২১-র কোপায় রড্রিগো ডে’পলের বাড়ানো বল ধরে ব্রাজিলের গোলকিপার এডারসনের মাথার উপর দিয়ে গোল। পরের বছর ফাইনালিসিমায় নাকানি-চোবানি খাইয়ে গোল করলেন ইউরোপ সেরা ইটালির বিরুদ্ধে। অবশেষে ২০২২-র বিশ্বকাপে সেই ‘গ্লোরিয়াস গোল’। দুহাতে হৃদয়ের চিহ্ন এঁকে ভক্তদের হৃদয়ে চিরস্থায়ী জায়গা করে নিলেন ‘ফিদেও’।

বিশ্বকাপ ফাইনালে গোলের পর দি মারিয়া।

বন্ধুরা ভালোবেসে এই নাম দিয়েছিল। যার ইংরেজি অর্থ ‘নুডল’। বক্সের আশেপাশে ছটফটানি। কোমরের দোলায় বিপক্ষের ডিফেন্ডারকে চরকিপাক খাওয়ানো। গোল আর অ্যাসিস্টে তাঁর ঝুলি ভর্তি। আর্জেন্টিনার জার্সিতে ১৪৪টি ম্যাচে ৩১টি গোল। আশ্চর্যের বিষয়, এই সংখ্যার থেকে মাত্র ৪টি বল বেশি দিয়ে একদিন এল টোরিতো থেকে কিনে নিয়েছিল রোসারিও সেন্ট্রাল। হ্যাঁ, ৩৫টি ফুটবল! এটাই ছিল তাঁর প্রথম ‘ট্রান্সফার ফি’। তখন মাত্র ৬ বছর বয়স দি মারিয়ার। কে জানত, একদিন তিনি নীল-জার্সিতে বিশ্ব মাতাবেন! অথচ সেই সময় সাদা রঙের বড্ড অভাব ছিল তাঁর জীবনে। বাবা কাজ করতেন কয়লাখনিতে। নিজেও সাহায্য করতেন চারকোল তৈরির কাজে। বাড়ির সাদা দেওয়ালটা ক্রমশ রং পালটে ধূসর থেকে কালো হয়ে গেল একদিন। জীবনধারণের ওই একটাই উপায় ছিল সেদিন। আসলে কয়লার মধ্যে থেকে পলকাটা হিরে তৈরি হচ্ছিল সঙ্গোপনে।

আজও কি চোখের মধ্যে এসে পড়ছে কয়লার গুঁড়ো? চোখ জ্বালা করছে, কাঁদছেন। সাফল্য আর ব্যর্থতার সমানুপাতিক সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে হয়তো ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে ছোটবেলায়। যখন দুরন্ত, অবাধ্য এক শিশুর অফুরন্ত প্রাণশক্তিকে সঠিক পথে নিয়ে আসার জন্য ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল ফুটবলে। বাকি ইতিহাসটা তৈরি হয়েছে নিজের পথে, নিজের ছন্দে। রোনাল্ডো-মেসির পাশে খেলা। ফাইনালে গোল। বিশ্বজয়। সব ভিড় করে আসতে পারে চোখের তারায়। কোপা আমেরিকা (Copa America 2024) জয় দিয়েই আন্তর্জাতিক কেরিয়ার শেষ হল দি মারিয়ার। মেসি চোট পেয়ে উঠে যাওয়ার পর হাতে ক্যাপ্টেনের আর্মব্যান্ড।

বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে।

কোপার ট্রফি তোলার জন্য মেসি ডেকে নিলেন ওটামেন্ডি আর দি মারিয়াকে। শেষবার ট্রফিটাকে চুমু খেলেন দি মারিয়া। যেমনটা করেছিলেন বিশ্বকাপ ফাইনালে। ১০ নম্বর জার্সি পরা রোসারিওর এক ব্যক্তি ট্রফিটাকে শিশুর মতো আগলে এগিয়ে যাচ্ছেন সেলিব্রেশনের পোডিয়ামের দিকে। ১১ নম্বর জার্সি গায়ে রোসারিও আরেক ব্যক্তি আলোর নিচে অপূর্ব সেই আলোর মতো অপেক্ষা করছেন। পিছনে বাজছে পিটার ড্রুরির ধারাভাষ্য, “Lionel Messi has shaken hands with paradise. The little boy from Rosario, Santa Fe has just pitched in heaven.” মেসিদের সেই স্বর্গে কিন্তু একজন ‘অ্যাঞ্জেল’ দি মারিয়াও থাকেন।

এই বিভাগের আরো সংবাদ