আজকের শিরোনাম :

বিবিসির প্রতিবেদন

ইরানের দিক থেকে ইসরায়েলে পাল্টা হামলার সম্ভাবনা কতটা?

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪:১৯

সিরিয়ার দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেটে ইসরায়েলি হামলায় ১৩ জন নিহত হওয়াার পর ইরানের জন্য জন্য একটি কঠিন সময় যাচ্ছে। একদিকে এই হামলার জবাব দিতে চাইছে দেশটি। অন্যদিকে ইরান এমন কোন কাজ করতে চায় না যার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে পারে।

ইসরায়েল ও আমেরিকার কর্মকর্তারা মনে করেন, ইরান পাল্টা আঘাত করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমেরিকার গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে দেশটির সংবাদমাধ্যম সিবিএস নিউজ জানিয়েছে, ইরান ড্রোন এবং ক্রুস মিসাইল হামলার পরিকল্পনা করছে।

তবে কখন এবং কোন জায়গায় এই আঘাত করা হবে সেটি নিশ্চিত নন আমেরিকার কর্মকর্তারা। এই হামলা এখন থেকে শুরু করে রমজান মাসের শেষ সপ্তাহে যে কোন সময় হতে পারে বলে ধারণা করছেন কর্মকর্তারা।

ড্রোন ও মিসাইল হামলা ইরাক ও সিরিয়ার মাটি থেকে নাকি ইরানের ভেতর থেকে পরিচালনা করা হবে সেটিও এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি মার্কিন গোয়েন্দারা।

এদিকে ইসরায়েলও বলেছে যে ইরান যদি পাল্টা আঘাত করে তাহলে তারা আবারো হামলা চালাবে। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি যুদ্ধের সংকেত বেজে উঠতে পারে।

ইরানের শক্তি আছে?
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনো কড়া সামরিক জবাব দিতে গেলে সেটি যুদ্ধকে ইরানের দোরগোড়ায় টেনে আনবে। কারণ, ইরানের বিষয়ে ইসরায়েলও ছেড়ে কথা বলবে না।

অন্যদিকে ইসরায়েলি হামলার যথাযথ জবাব দিতে না পারলে ইরানের সামরিক সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। ফলে ভবিষ্যতে ইসরায়েল ইরানকে আরো দুর্বল ভাববে এবং তাদের ওপর চেপে বসবে।

ইরানকে প্রমাণ করতে হবে যে তারা দুর্বল নয়। যে কোনো হামলার জবাব দেওয়ার ক্ষমতা তাদের রয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যে বড় ধরনের কোনো যুদ্ধের সূত্রপাত না করে ইরান কিভাবে ইসরায়েলকে জবাব দিতে পারে সেটি নিয়ে এক ধরনের দোদ্যুল্যমানতা তৈরি হয়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে ইসরায়েলকে পাল্টা আঘাত করার মতো সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সামর্থ্য ইরানের রয়েছে কী না?

মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশ্লেষক ও লেখক আলী সাদরাজদেহ বিবিসিকে বলেন, ইসরায়েলের সাথে সংঘাতে জড়ানোর মতো সামর্থ্য ইরানের নেই।

‘কিন্তু দেশের ভেতরে জনগণকে দেখানোর জন্য হলেও ইরানকে একটি জবাব দিতে হবে। এছাড়া নিজেদের মিত্রদের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা টিকিয়ে রাখার জন্যও ইরানকে একটি পদক্ষেপ নিতে হবে,’ বলেন সাদরাজদেহ।

ইসরায়েলের কাছে ইরান যতই অপদস্থ হোক না কেন, এর কড়া জবাব দেবার সম্ভাবনা খুবই কম। এর পরিবর্তে ইরানকে ‘কৌশলগত কারণে ধৈর্য’ ধরতে হবে।

কারণ, ইরানের এখন অগ্রাধিকার হচ্ছে পারমাণবিক বোমা তৈরি করা। কিছু ব্যালিস্টিক মিসাইল ছুঁড়ে ১০০ জন ইসরায়েলিকে হত্যা করার চেয়ে পারমাণবিক বোমা তৈরির পথে এগিয়ে যাওয়া যুক্তিযুক্ত। এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে শুধু ইসরায়েল নয়, আমেরিকার হামলা ঠেকাতেও সক্ষম হবে ইরান।

হেজবুল্লার অবস্থান কী?
গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে সিরিয়া, ইরাক, লেবানন ও ইয়েমেনে ইরান সমর্থিত বিভিন্ন গোষ্ঠী ইসরায়েলি স্বার্থে আঘাত হানছে। কিন্তু তাদের সে তৎপরতাও সীমিত আকারে। এসব গোষ্ঠী ইসরায়েলের সাথে পুরোপুরি যুদ্ধে লিপ্ত হতে চায় না।

‘ইরান সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর কাছে ইসরায়েলের দূতাবাসে হামলার বিষয়টি চিন্তা করাটা বেশ কঠিন,’ বলছিলেন সাদরাজদেহ।

হেজবুল্লাহ হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে সংগঠিত সশস্ত্র গ্রুপ। রাষ্ট্রীয় বাহিনী না হয়েও তাদের বিশ থেকে পঞ্চাশ হাজারের মতো যোদ্ধা রয়েছে। তাদের বেশিরভাগই বেশ প্রশিক্ষিত। সিরিয়া যুদ্ধে অংশ নেবার মাধ্যমে যুদ্ধের ময়দানে লড়াই করার অভিজ্ঞতাও তাদের তৈরি হয়েছে।

ইরান-সমর্থিত হেজবুল্লাহর প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার রকেট ও মিসাইল রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

তারপরেও বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইরানের পক্ষ নিয়ে হেজবুল্লাহ এখন ইসরায়েলের সাথে সরাসরি যুদ্ধে জড়াবে না।

‘হেজবুল্লাহ ইসরায়েলের ফাঁদে পা দিতে চায় না। কারণ তারা ভালো করেই জানে যে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং তার যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা এই যুদ্ধকে বিস্তৃত করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। কারণ নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই যুদ্ধ কতদিন চলবে তার ওপর,’ বলছিলেন গার্গেস।

প্রতীকী জবাব দেয়া
পর্যবেক্ষকসাদরেজাদেহ মনে করেন, ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে না গিয়ে ইরান একটি প্রতীকী জবাব দেবার উপায় খুঁজছে।

কয়েক বছর আগে ইরানের শীর্ষ কমান্ডার কাশেম সোলাইমানিকে ইরাকে হত্যা করার পর ইরানের তরফ থেকে ‘কড়া প্রতিশোধের’ হুমকি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে সেটি ঘটেনি।

সোলাইমানি হত্যার জবাবে ইরান ব্যালিস্টিক মিসাইল হামলা চালিয়েছিল ইরাকে অবস্থিত আমেরিকার সামরিক ঘাঁটিতে। কিন্তু সেই হামলায় আমেরিকার কোনো সৈন্য হতাহত হয়নি। বরং হামলার আগে আমেরিকার সেনাবাহিনীকে মিসাইল নিয়ে সতর্ক করে দেয়া হয়েছিল।

ভার্জিনিয়া টেক স্কুল অব পাবলিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স-এর ইউসুফ আজিজি বিবিসিকে বলেন, ইরানের ভেতরে পর্দার অন্তরালে দুটো শক্তির মধ্যে মতভেদ চলছে। একটি পক্ষ চাইছে ইরান পারমানবিক শক্তি অর্জন করার মাধ্যমে ইসরায়েলি অগ্রাসন রুখে দাঁড়াক। আরেকটি অংশ চায় ইসরায়েলে সরাসরি হামলার মাধ্যমে এর জবাব দেয়া হোক।

এক্ষেত্রে ধৈর্য ধারণ করে পারমাণবিক লক্ষ্য অর্জন করার বিষয়টি হয়তো অগ্রাধিকার পাবে।

পাল্টা জবাব দিতেই হবে?
মধ্যপ্রাচ্যে বড় ধরনের কোন যুদ্ধ শুরু হোক সেটি ইরান চায় না। তেহরানের হাতে দুটি বিকল্প আছে। একটি হচ্ছে – আমেরিকার সৈন্য এবং তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট স্থাপনার ওপর হামলার জন্য ইরান সমর্থিত গ্রুপগুলোকে মদদ দিতে পারে।

দ্বিতীয়টি হচ্ছে – ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি জোরদার করে এগিয়ে নেয়া।

যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্ররা তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচির রাশ টেনে ধরতে চাইছে।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমেরিকার কর্মকর্তারা ইরানের গতিবিধি খুবই সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করছে। ইরান সমর্থিত বিভিন্ন গোষ্ঠী ইরাক এবং সিরিয়াতে অবস্থিত মার্কিন সৈন্যদের ওপর হামলান সম্ভাবনা আছে কী না সেদিকে সতর্ক নজর রাখছে ওয়াশিংটন।

তবে সিরিয়া ও ইরাকে আমেরিকার সৈন্যদের ওপর ইরান-সমর্থিত গ্রুপগুলোর হামলার বিষয়ে মার্কিন গোয়েন্দাদের দিক থেকে এখনো পর্যন্ত তথ্য পাওয়া যায়নি।

শুক্রবার ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জামশিদি ‘এক্স’ প্লাটফর্মে লিখেছেন, নেতানিয়াহু যে ফাঁদ তৈরি করেছে আমেরিকার নেতারা যাতে নিজেদের সেখানে টেনে না আনে।

‘আপনারা দূরে থাকুন যাতে আঘাত না লাগে,’ লিখেছেন জামশিদি। তিনি দাবি করেন, তার এই বার্তার পর আমেরিকা ইরানকে বলেছে তারা যাতে আমেরিকার স্থাপনার ওপর আঘাত না করে।

সিবিএস নিউজ নিশ্চিত হয়েছে যে ইরানের কাছ থেকে আমেরিকা লিখিত বার্তা পেয়েছে। স্টেট ডিপার্টমেন্টের একজন মুখপাত্র সিবিএস নিউজকে জানিয়েছেন, ইরানের চিঠির জবাবে আমেরিকাও পাল্টা হুশিয়ারি দিয়ে চিঠির উত্তর দিয়েছে।

স্টেট ডিপার্টমেন্ট লিখেছে – ইসরায়েলের হামলার বিষয়টিকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে আমেরিকার স্বার্থে যাতে কোন আঘাত না করা হয়।

ইরান একদিকে চাইছে যে এমন একটি জবাব দিতে যাতে ভবিষ্যতে ইসরায়েল এ ধরনের হামলা করতে সাহস না পায়। অন্যদিকে ইরান এটাও চায় না যে তাদের জবাবের মধ্য দিয়ে যাতে আবার মধ্যপ্রাচ্যে বড় ধরনের কোন যুদ্ধের সূত্রপাত হয়ে যায়। এ বিষয়টি নিয়ে এক ধরনের দোলাচলে রয়েছে ইরান।

এই উত্তেজনা তৈরির মাধ্যমে ইসরায়েল দেখাতে চেয়েছে যে ইরান আসলে ‘একটি কাগুজে বাঘ’। বিবিসিকে বলছিলেন লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স-এর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক অধ্যাপক ফাওয়াজ গের্গস।

‘এক্ষেত্রে ইরান যদি কোন জবাব না দেয় তাহলে এটা এমন একটা বার্তা দেবে যে ইরান শুধু একটি কাগুজে বাঘ, জবাব দেবার কোন ক্ষমতা তাদের নেই,’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেছেন রয়টার্সকে।

ইরানের সামনে পথ কী?
সেক্ষেত্রে ইরান হয়তো বিদেশে অবস্থিত ইসরায়েলি দূতাবাস এবং বিভিন্ন ইহুদি স্থাপনার ওপর হামলা চালাতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এলিয়ট আব্রামস রয়টার্সকে বলেন, ইরান ইসরায়েলের সাথে সর্বাত্মক যুদ্ধে লিপ্ত হতে চায় না বলে তার বিশ্বাস। তবে ইসরায়েলের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন জায়গায় তারা হামলা চালাতে পারে।

ইরান আরেকটি উপায়ে জবাব দিতে পারে। সেটি হচ্ছে – তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি তরান্বিত করা। ইউরেনিয়াম আরও সমৃদ্ধ করে সেটিকে পারমাণবিক বোমা তৈরির উপযোগী করে তোলা। অথবা প্রকৃত পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির নকশা পুনরায় শুরু করা।

কিন্তু এসব পদক্ষেপ ইরানের জন্য উল্টো ফল বয়ে আনতে পারে বলে পর্যবেক্ষকদের অনেকে মনে করেন। ইরান এসব কাজ করতে গেলে আমেরিকা ও ইসরায়েলের হামলাকে আমন্ত্রণ জানানো হবে।

ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংক ট্যাঙ্ক সিএসআইএসের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ জন অল্টারম্যান মনে করেন ইসরায়েলের দূতাবাসে হামলার মতো পদক্ষেপ ইরান নেবে না।

‘ইসরায়েলকে শিক্ষা দেবার ব্যাপারে ইরান ততটা আগ্রহী নয়। বরং ইরান তাদের মিত্রদের দেখাতে চায় যে তারা দুর্বল নয়,’ রয়টার্সকে বলেন অল্টারম্যান।

ইরান এখন কোন পথে হাঁটবে? এ বিষয়টি নির্ভর করছে দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লাহ আলি খামেনির সিদ্ধান্তের ওপর।

এবিএন/এসএ/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ