আজকের শিরোনাম :

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন

একাত্তরের ২৬ মার্চ ঢাকা শহরের চিত্র যেমন হয়েছিল

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২০২৪, ১৫:৩৮

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইপিআর সদর দপ্তর ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনসসহ কয়েকটি জায়গায় একযোগে হত্যাযজ্ঞ চালানোর পরদিন অর্থাৎ ২৬ মার্চের ঢাকা ছিল স্তম্ভিত, শোকার্ত ও ভয়াল এক নগরী।

শহরে ছিল কারফিউ কিন্তু তার মধ্যেই ঢাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষজন অলিগলি পাড়ি দিয়ে শহর ছাড়তে শুরু করেছিল।

সেদিন ঢাকাতেই ছিলেন এমন কয়েকজন জানিয়েছে, শহরের যেকোনো জায়গা থেকেই আগুন আর ধোঁয়া থেকেই রাতের আক্রমণের তীব্রতা বোঝা যাচ্ছিল।

‘কারফিউ ছিল এবং শহরে কোন ধরনের পরিবহন ছিলো না, মানুষ স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিলো। কারও সাথে দেখা হলেও মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিলো না,’ বলছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক ও লেখক আফসান চৌধুরী।

ঢাকার মগবাজারের দিলু রোডে আফসান চৌধুরীদের বাসায় তখন আশ্রয় নিয়েছিল অনেক মানুষ।

‘দুপুরের মধ্যেই সবার জানা হয়ে গেছে পাকিস্তান বাহিনীর নৃশংসতার খবর। মানুষ শহর ছাড়তে শুরু করল,’ বলছিলেন তিনি।

২৫ মার্চের রাতে ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনী যে অভিযান চালিয়েছিলো তাতে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল এবং এটি বাংলাদেশে ‘কালরাত বা কালরাত্রি’ হিসেবেই পরিচিত।

দিনটিকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের একটি প্রস্তাব বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ২০০৭ সালে অনুমোদিত হয়।

এর আগে মার্চের শুরু থেকেই রাজনৈতিক উত্তেজনা তুঙ্গে ছিল।

সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সাতই মার্চের ভাষণের পরই পরিস্থিতি পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকে এবং তখনকার পূর্ব পাকিস্তান কার্যত চলতে থাকে শেখ মুজিবের নির্দেশে।

এরপর মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক শুরু হলেও তার আড়ালেই ঢাকায় সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নিতে থাকে পাকিস্তান সরকার। সে অভিযানেরই আনুষ্ঠানিক নাম দেয়া হয় ‘অপারেশন সার্চলাইট’।

১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করা সিদ্দিক সালিক তার ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ শিরোনামের একটি বইয়ে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নিয়ে লিখেছেন।

এতে তিনি তিনি লিখেছেন যে সামরিক অভিযানের প্রাথমিক উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল, ‘শেখ মুজিবের ডিফ্যাক্টো শাসনকে উৎখাত করা এবং সরকারের (পাকিস্তানের) কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।’

আর সেই অভিযানের নামে আসলে চালানো হয় গণহত্যা এবং গ্রেফতার করা হয় শেখ মুজিবুর রহমানকে।

কিন্তু গ্রেফতারের আগেই অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের ৯ মাস ব্যাপী স্বাধীনতার লড়াই।

২৬ মার্চের ঢাকা কেমন ছিল?
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক লেখক, গবেষক ও ঢাকায় থাকা মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন, ২৫ মার্চের রাতের গণহত্যার জের ধরে ২৬ মার্চের দিনের বেলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা ও রাজারবাগের পুলিশ লাইনস এলাকায় আগুনের কুণ্ডলী দেখা যাচ্ছিল।

এর মধ্যেও পরিচিতদের খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছেন অনেকে। যদিও কারফিউ থাকায় বের হওয়ার সুযোগ ছিল সীমিত।

তেজগাঁও এলাকায় রাইফেল হাতে পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে ব্যারিকেড তৈরি করেছিলেন এখনকার ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান এম এ হাসান।

‘আমরা সেদিন তেজগাঁও এলাকায় অবস্থান নিয়েছিলাম। ইপিআরের ৩ নম্বর গেটেও ভালো প্রতিরোধের খবর পাচ্ছিলাম। পিলখানা ও রাজারবাগে যে প্রতিরোধ রচনা করেছিলো পঁচিশে মার্চের রাতে, তা চলছিলো ছাব্বিশে মার্চের সকাল পর্যন্ত। যদিও শেষ পর্যন্ত আক্রমণের মুখে টিতে পারেনি ইপিআর ও পুলিশ’, তিনি বলছিলেন।

এমন পরিস্থিতিতে ২৬ মার্চের দুপুর থেকেই আসলে শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ দলে দলে পালাতে শুরু করে। দু-একটি এলাকায় টেলিফোন সচল থাকলেও অধিকাংশ এলাকায় তা-ও ছিল না।

দুপুরের পর থেকে অনেকে পরিচিত বা স্বজনদের, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় ও আশেপাশের এলাকায় যাদের স্বজনরা ছিলো, নানাভাবে তাদের খোঁজে বের হওয়ার চেষ্টা করেন।

হাসান পরদিন ২৭ মার্চে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখতে পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জ্যোতির্ময়গুহ ঠাকুরতাসহ অনেককে। পরে তিনি জগন্নাথ হল এলাকা থেকেও এক নিকটাত্মীয়কে উদ্ধার করে নিয়ে আসতে সক্ষম হন।

‘পুরো এলাকা ছিল ধ্বংসযজ্ঞের নমুনা। যেখানে সেখানে পড়ে ছিল মৃতদেহ,’ বলছিলেন তিনি।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রতিষ্ঠাতা আহবায়ক জাহানারা ইমাম তার একাত্তরের দিনগুলো বইতে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের বর্ণনা লিখেছেন।

তিনি লিখেছেন, “...অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ। যা তাণ্ডব হচ্ছে চারদিকে, কারফিউ না দিলেও বাইরে বের হয় কার সাধ্যি! গোলাগুলির শব্দ থামেই না। মাঝে মাঝে কমে শুধু। আগুনের স্তম্ভ দেখার জন্য এখন আর ছাদে উঠতে হয় না। দোতলার জানালা দিয়েই বেশ দেখা যায়। কালো ধোঁয়ায় রৌদ্রকরোজ্জ্বল নীল আকাশের অনেকখানি আচ্ছন্ন।”

আরেক জায়গায় তিনি লিখেছেন, “....... টেলিফোন বিকল, রেডিও পঙ্গু, বাইরে কারফিউ- গোলাগুলির শব্দের চোটে প্রাণ অস্থির, বাইরে কি হচ্ছে কিছুই জানবার উপায় নেই।”

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক আফসান চৌধুরী বলছেন, বস্তিগুলো থেকে মানুষ তখন পালাচ্ছিলো, আবার কেউ কেউ অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল।

ছাব্বিশে মার্চের পরিস্থিতি নিয়ে একই ধরনের কথা উঠে এসেছে সুফিয়া কামালের একাত্তরের ডায়েরি বইতেও। সেদিন দশটার পর তিনি দিনের ঘটনাবলী তার ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করেছিলেন।

“গতকাল রাত পৌনে ১২টায় হঠাৎ চট্টগ্রাম ফোন এল, ঢাকায় কোন গণ্ডগোল হচ্ছে কি না। ততক্ষণ পর্যন্ত ঢাকা শান্ত। ফোনটা রাখা মাত্র পুলের উপর মা বলে একটি আর্তনাদ শোনা গেলো, পরপর মেশিনগানের শব্দ ও জয়বাংলা শব্দের পর অবিরাম রাইফেল বোমা স্টেনগান মেশিনগান এর শব্দ, সাত মসজিদ, ইপিআর এর দিক থেকে গোলা কামানের শব্দ, জয় বাংলা আল্লাহ আকবর এর আওয়াজ ২টা পর্যন্ত হল, তারপর থেকে শুধু কামান গোলার শব্দ, রাত সাড়ে তিনটায় মিলিটারি ভ্যান বাড়ীর সামনে এসে আবার চলে গেলো।”

তিনি আরও লিখেছেন, “কাল থেকে কারফিউ জারি। শোনা যাচ্ছে, মুজিব বন্দী। ও দিক থেকে আগুনের আভা দেখা যাচ্ছে। আজ রাত দশটা পর্যন্ত। রেডিওতে ইয়াহিয়া ভাষণ দিল। আওয়ামী লীগ বন্ধ। মুজিব শর্তে আসেননি, সামরিক শাসন অমান্য করেছেন বলা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত মেশিনগানের শব্দ আসছে। মানুষের শব্দ কোথাও নেই, ঘর থেকে বের হতে পারছি না।”

অর্থাৎ ভয়াল এক নগরী যেখানে ঘর থেকে বের হওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না মানুষের। এর মধ্যেও তরুণদের অনেকের চেষ্টা ছিল অলিগলি ঘুরে নিজেদের পরিচিতজনদের কাছে যাওয়ার।

তবে যেখানে টেলিফোন সক্রিয় ছিল, সেখানেই ছাব্বিশে মার্চের কারফিউর মধ্যেও অনেক মানুষ চেষ্টা করছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কী হয়েছে, শেখ মুজিবের কী অবস্থা, কত মানুষ মারা গেছে-এসব খবরাখবর নিতে।

মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু কাকরাইল-পল্টন এলাকায় ছিলেন। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলছিলেন যে, সেই প্রথম তারা কাকরাইলে তাদের এলাকার মসজিদ থেকে প্রথম বারের মতো ফজরের আজান শুনেননি।

‘পঁচিশে মার্চের রাতে বন্ধুর বাসায় ছিলাম। সকালে বেরিয়ে পল্টন এলাকায় অলিগলি দিয়ে বেরিয়ে দেখার চেষ্টা করেছি। ডেডবডি পড়েছিলো এখানে সেখানে, এমনকি ড্রেনেও। আগুন জ্বলছিল এদিক সেদিক।’

তিনি বলেন, পাকিস্তানি সেনারা এদিক সেদিক ফাঁকা গুলি ছুড়ছিল বাড়ি ঘর লক্ষ্য করে। জানালায় দাঁড়িয়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন এমন ঘটনাও ঘটেছে সেদিন।

‘এমন বিচ্ছিন্ন অনেক ঘটনা ঘটেছে। তবে ২৮ মার্চ জিঞ্জিরায় গিয়ে শুনি ২৬ মার্চেই সেখানকার অনেকে মেয়েকে তুলে নিয়ে গেছে এবং অনেককে নির্যাতন করেছে পাক সেনারা,’ বলছিলেন তিনি।

অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের দিন ঢাকা শহরে কারফিউর জন্য মানুষ বের হতে না পারলে ২৫ মার্চ রাতের হত্যাযজ্ঞের খবর নিতে অনেকেই নানাভাবে চেষ্টা করেছে।

ভয় আর আতংকের পাশাপাশি জীবন বাঁচাতে ছাব্বিশে মার্চের দুপুরের পর থেকেই মূলত বিভিন্ন পথে ঢাকা ছাড়া শুরু হয় মানুষের।

অন্যদিকে শহরের রাস্তায় ছিলো পাকিস্তানি বাহিনীর টহল। যত্রতত্র শোনা যাচ্ছিলো গুলির শব্দ আর শহরজুড়ে এখানে সেখানে পড়ে ছিল মৃতদেহ।

এভাবেই সূচনা হয় একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের, যার সমাপ্তি হয় সেই বছরের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে।

এবিএন/এসএ/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ