বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন
কূটনীতিকের নিরাপত্তায় দেশে-বিদেশে কোন ধরনের নিয়ম প্রচলিত আছে?

প্রকাশ: ১৭ মে ২০২৩, ১৪:০৭

ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটেন, আমেরিকা, সৌদি আরব ও ভারতের কূটনীতিকদের জন্য পুলিশের বাড়তি নিরাপত্তা প্রত্যাহারের বিষয়টি নিয়ে বেশ আলোচনা তৈরি হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের সচিব মাসুদ বিন মোমেন মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার প্রেক্ষাপটে কূটনীতিকদের জন্য বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
‘পররবর্তীতে দেখা গেছে যে এটা আসলে মূলত ট্রাফিক ক্লিয়ারেন্সের কাজটাই করত। তাদের যে আসল নিরাপত্তার ব্যবস্থা সেটা অপরিবর্তীত আছে।’
মোমেন বলেন, এখন বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বেশ ভালো আছে। এজন্য বাড়তি নিরাপত্তার প্রয়োজন দেখছে না বাংলাদেশ সরকার।
‘বিদেশি যেসব দূতাবাস এবং রাষ্ট্রদূতরা আছেন, তাদের যে বেসিক নিরাপত্তা আছে সেটা আমরা কখনোই কম্প্রোমাইজ করব না। এটুকু আমরা নিশ্চয়তা দিচ্ছি।’
বাংলাদেশে কূটনীতিকদের নিরাপত্তা ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ীই দেয়া হচ্ছে এবং তাদের নিরাপত্তায় আনসারের স্পেশাল ব্যাটালিয়ন তৈরির কথা জানান তিনি।
এর আগে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় এবং সৌজন্যমূলক আচরণের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, সৌদি আরবসহ কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূতদের বাড়তি প্রটোকল হিসেবে পুলিশি এসকোর্ট সুবিধা দেয়া হতো।
অর্থাৎ রাষ্ট্রদূত বা কূটনীতিকরা যাতে দ্রুত চলাচল করতে পারে, এজন্য একটি গাড়িতে পাঁচ থেকে আট জন পুলিশের মাধ্যমে রাস্তা ট্রাফিক মুক্ত রাখার বাড়তি সুবিধা দেয়া হতো।
সোমবার এক বিবৃতির মাধ্যমে এই বাড়তি নিরাপত্তা সুবিধা প্রত্যাহার করার কথা জানায় দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে কোন দূতাবাস এই বাড়তি সুবিধা চাইলে অর্থের বিনিময়ে তা নিতে পারবে।
বাড়তি নিরাপত্তা প্রত্যাহারের বিষয়টি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে কোনো প্রভাব ফেলবে না বলেও জানান পররাষ্ট্র সচিব।
কূটনীতিক প্রতিক্রিয়া
এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ভারতের দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় বিবিসি বাংলার তরফ থেকে। যুক্তরাজ্যের দূতাবাসের পক্ষ থেকে ই-মেইলে জানানো হয় যে, ‘তারা তাদের কর্মীদের নিরাপত্তা এবং কূটনৈতিক সুবিধাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।’ তবে তারা অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা-সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করবেন না বলে জানান। অন্যদিকে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস থেকে কোন জবাব মেলেনি। তবে ওয়াশিংটনে স্টেট ডিপার্টমেন্টের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে অন্যতম মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল এ-সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। প্যাটেল বলেছেন, ভিয়েনা কনভেনশন অনুসারে যে কোনো স্বাগতিক দেশ সব কূটনৈতিক মিশন এবং তাদের কর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বাধ্য থাকবে এবং কর্মীদের উপর যে কোনো আক্রমণ প্রতিরোধে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। ‘আমাদের কূটনৈতিক কর্মীদের নিরাপত্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ,’ বলেন প্যাটেল। ঢাকায় ভারতীয় দূতাবাসের তরফ থেকেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। বিবিসির তরফ থেকে দিল্লিতে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কোনো প্রতিক্রিয়া মেলেনি।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতরা কী সুবিধা পায়?
বিভিন্ন দেশে নিয়োজিত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে , বাংলাদেশে নিযুক্ত বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা যে ধরনের ‘বিশেষ সুবিধা’ পেয়ে থাকেন, বিদেশে নিযুক্ত বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূতরা সে সুবিধা পান না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, পৃথিবীর কোনো দেশেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে বাড়তি নিরাপত্তা ও চলাচলের ক্ষেত্রে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো সুবিধা দেয় না। সাধারণত স্বাগতিক দেশের ওপরেই কূটনীতিকদের নিরাপত্তাসহ অন্যান্য বিধিবিধান নির্ভর করে বলে জানান যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির। তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রদূতদের নিরাপদে কাজ করার জন্য স্বাগতিক দেশের যতটুকু সুবিধা দেয়া দরকার তারা সেটা দেয়। এ নিয়ে স্বাগতিক দেশগুলো নিজেদের নিরাপত্তা পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে থাকে। কি ধরণের পরিবেশ তৈরি করলে সবাই নিরাপদে থাকবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়।’ পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও উজবেকিস্তানে রাষ্ট্রদূত হিসেবে এবং আরও অন্তত দশটি দেশে কূটনীতিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন সোহরাব হোসেন। ‘কূটনীতিক হিসেবে অনেক দেশে কাজ করেছি, বাংলাদেশ স্বাগতিক দেশ হিসেবে বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের যে নিরাপত্তা দেয় তা আর কোথাও দেখিনি। কখনও কোথাও আমি বিশেষ এসকোর্ট পাইনি, পশ্চিমা দেশে গাড়িতে পতাকা ওড়ানো যেতো না,’ বলেন রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির। ‘এ ছাড়া বিভিন্ন দেশে নিয়োজিত বাংলাদেশের দূতাবাসের বাইরে বা রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে কোন নিরাপত্তা বাহিনীর প্রহরা থাকে না। বাড়তি নিরাপত্তারক্ষী বা গানম্যান থাকা দূরের কথা। গাড়িতে শুধু চালক ও কূটনীতিক থাকেন।’ এ বিষয়ে হুমায়ুন কবির বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বা অন্যান্য দেশ মনে করে যে তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা যথেষ্ট ভালো। আলাদা করে পুলিশ এসকোর্টের দরকার নেই। আন্তর্জাতিক আইনে এ নিয়ে কিছু বলা নেই। তাই তারা এটা কাউকেই দেয় না। ‘তারা কীভাবে নিরাপত্তা দেবে সেটা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেয়। আমার কখনও মনে হয়নি বাড়তি নিরাপত্তা দরকার, তাই কখনও চাইনি। তবে চাইলে হয়তো পেতাম,’ বলেন রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির। তবে বাড়তি নিরাপত্তা দেওয়ার ক্ষেত্রে সব দেশের সরকারের একটি স্ট্যান্ডার্ড প্রটোকল আছে বলে জানান সোহরাব হোসেন। কোন দেশের কূটনীতিক স্বাগতিক দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফোন দিয়ে তাদের চলাচলের কথা জানালে পররাষ্ট্র দফতর থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্ক করে দেয়া হয়। কিন্তু কোনো বাড়তি নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগ দেয়া হয় না। তবে টাকার বিনিময়ে নিরাপত্তা প্রটোকল পাওয়া যায়। নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে সোহরাব হোসেন বলেন, ‘একবার আমি ইসলামাবাদ থেকে আরেক শহরে যাওয়ার আগে নিরাপত্তা চেয়েছিলাম। কিন্তু এ জন্য আমার কাছে পয়সা দাবি করা হয়। তখন আর নেইনি।’ তার মতে, কূটনীতিকদের কেমন নিরাপত্তা দেয়া হবে সেটা স্বাগতিক দেশের ওপর নির্ভর করে। যেমন আফগানিস্তান, পাকিস্তানে কিছুটা নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকে। আবার রাজধানীর বাইরে গেলে ঝুঁকি বাড়তে পারে। ‘কোন বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি হলে আলাদা কথা। না হলে কোন দেশেই বাড়তি কোন সুবিধা দেয়া হয় না। তবে বাড়তি নিরাপত্তা চাইলে তারা ব্যবস্থা করে তবে সেজন্য মোটা অংকের পয়সা গুনতে হয়।’
ভিয়েনা সনদে কী আছে?
ভিয়েনা সনদ আর্টিকেল ২০-এ বলা হয়েছে, রাষ্ট্রদূত তার বাড়িতে, অফিসে, গাড়িতে সেই দেশের পতাকা ওড়াতে পারবেন এবং তাদের মনোগ্রাম বা এমব্লেম ব্যবহার করতে পারবে। এগুলো ব্যবহার করা না করার ব্যাপারে কূটনীতিকরা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কিন্তু এ বিষয়ে হোস্ট দেশ কোনো বাধা দিতে পারবে না। তবে বিভিন্ন দেশে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতরা পতাকা ওড়ানোর ক্ষেত্রেও একেক দেশে একেক নিয়ম দেখেছেন। এশিয়ার দেশগুলোয় তারা গাড়িতে পতাকা ওড়াতে পারলেও, পশ্চিমা দেশে ওড়াননি। কূটনীতিকদের গাড়িতে পতাকা ওড়ানো বন্ধ হচ্ছে কি না, এ প্রশ্নে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘এটা নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। নিউইয়র্ক বা জেনেভায় কখনই পতাকা ওড়ানোর কোনো পদ্ধতি নেই। অনেক দেশে আছে, রাষ্ট্রীয় যত মিটিং হয় তখন পতাকা উড়িয়ে যাওয়া যায়। এটা মিশন প্রধানদের নিজেদের ওপর থাকে।’ ভিয়েনা সনদ অনুযায়ী স্বাগতিক দেশকে অবশ্যই সব কূটনৈতিক মিশন ও কূটনীতিকদের সুরক্ষার বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করতে হবে। সে হিসেবে কূটনীতিক এবং অবকাঠামোর সুরক্ষা ও নিরাপত্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এবং আর্টিকেল ৪৭ অনুযায়ী এসব নিরাপত্তা ও সুবিধা দেয়ার ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্যমূলক আচরণ করা যাবে না। বাংলাদেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতদের এই বিশেষ নিরাপত্তা দেওয়ার কারণ হিসেবে হুমায়ুন কবির জানান, সাধারণত অভিজ্ঞতার আলোকে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের বিশেষ নিরাপত্তা দেয়া হয়।
২০১৬ সালে হলি আর্টিজানে সন্ত্রাসী হামলার পর পুরো কূটনৈতিক কমিউনিটির নিরাপত্তার বিষয়ে বাড়তি পদক্ষেপ নেয় সরকার। সে সময় বাংলাদেশ তাদের নিরাপত্তা পরিস্থিতি মূল্যায়ন করেই সেই বাড়তি সুবিধা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
মূলত সেই সময় থেকেই কয়েকজন বিদেশি কূটনীতিককে অলিখিতভাবে গাড়িসহ নিয়মিত ট্রাফিক মুভমেন্টের সহায়তার জন্য বাড়তি কিছু লোকবল দেয়া হয়েছিল।
বর্তমানে বাংলাদেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক নিয়ন্ত্রণাধীন আছে। তাই তাদেরকে বাড়তি নিরাপত্তা প্রদানের কোন আবশ্যকতা নেই বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র দফতর।
অন্য নিরাপত্তা থাকবে
ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে পুলিশের বাড়তি প্রোটকল তুলে দেয়া হলেও রাষ্ট্রদূতসহ কূটনীতিকরা বাকি সব ধরনের নিরাপত্তা সুবিধা আগের মতোই পাবেন। বাংলাদেশের তরফ থেকে বলা হয়েছে, প্রতিটি দূতাবাস, কূটনীতিকদের বাসভবন এবং ক্লাবে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের নিরাপত্তা অব্যাহত থাকবে সেইসাথে রাষ্ট্রদূতদের পুলিশ প্রদত্ত গানম্যান নিয়োজিত থাকবে। এই সশস্ত্র সদস্যদের বিশেষ পরিস্থিতিতে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের অনুমোদন দেয়া আছে। ঢাকায় কূটনৈতিক জোনে ৫৩টি দেশ রয়েছে। প্রতিটি দেশের কূটনীতিকদের নিরাপত্তা দিতে বিশাল সংখ্যক নিরাপত্তারক্ষী মোতায়েন থাকে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সোমবার একটি বেসরকারি টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে বলেছেন, সৌদি আরবের ক্লাব, দূতাবাস, বাসভবনসহ কূটনীতিকদের নিরাপত্তায় ৪৮ জন পুলিশ মোতায়েন আছে। ব্রিটিশ হাইকমিশনের নিরাপত্তায় ২৯ জন দায়িত্ব পালন করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ১৫৮ জন নিরাপত্তায় নিয়োজিত আছেন। তাদের এসব নিরাপত্তা অব্যাহত থাকবে। শুধুমাত্র ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে পুলিশের বাড়তি সুবিধা প্রত্যাহার হবে, বলেন শাহরিয়ার আলম।
সুবিধা পেতে ‘ফি’ দিতে হবে
এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সোমবার গণমাধ্যমকে বলেছেন, এখন থেকে এই বাড়তি সুবিধা নিতে হলে নির্দিষ্ট ফি দিতে হবে। কোন দূতাবাস এই সুবিধা অব্যাহত রাখতে চাইলে বা বাড়তি সুবিধা নিতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে জানালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বিদেশি কূটনীতিকরা তাদের খরচে এ সুবিধাটি গ্রহণ করতে পারবেন। এদিকে কূটনীতিকদের নিরাপত্তা দিতে পুলিশের পরিবর্তে আনসার ব্যাটালিয়নের সহায়তায় বিশেষ গার্ড রেজিমেন্ট গঠন করার কথা জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, যাদের মূল দায়িত্ব হবে কূটনীতিকদের নিরাপত্তা দেয়া। পরবর্তী সময়ে ভিআইপি ও ভিভিআইপিদের নিরাপত্তার দায়িত্ব এই আনসার গার্ড রেজিমেন্টকে দেওয়া হবে বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। গণমাধ্যমকে আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘বাংলাদেশ আনসার বাহিনীতে একটি চৌকস দল তৈরি করা হয়েছে। চারটি দেশকে তাদের গাড়ির সামনে এবং পেছনে নিরাপত্তা দেয়া হতো। আমরা ঠিক করেছি পুলিশের বদলে এই গার্ড রেজিমেন্ট তাদের সামনে পেছনে থাকবে। আরও কোনো রাষ্ট্রদূত চাইলে তাদেরও দেব।’ পুলিশের জায়গায় আনসার বাহিনী নেয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের বহু কাজে পুলিশ লাগে। পুলিশের সংখ্যা বাড়নো যাচ্ছে না। সামনে নির্বাচন আছে। সবকিছু চিন্তাভাবনা করে পুলিশকে নিরাপত্তার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে।’ এদিকে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা ওই বাড়তি সুবিধা পেতে অনুরোধ জানিয়ে আসছে। এমন অবস্থায় পররাষ্ট্র দফতর জানায়, বিশেষ এসকর্টে পুলিশ সদস্যের পাশাপাশি বাড়তি গাড়িসহ আরও অনেক সরঞ্জামের প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর কাজের পরিসর বেড়ে যাওয়ায় এই বাড়তি সুবিধা এখন অব্যাহত রাখা যাচ্ছে না। এবিএন/এসএ/জসিম
এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ভারতের দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় বিবিসি বাংলার তরফ থেকে। যুক্তরাজ্যের দূতাবাসের পক্ষ থেকে ই-মেইলে জানানো হয় যে, ‘তারা তাদের কর্মীদের নিরাপত্তা এবং কূটনৈতিক সুবিধাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।’ তবে তারা অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা-সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করবেন না বলে জানান। অন্যদিকে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস থেকে কোন জবাব মেলেনি। তবে ওয়াশিংটনে স্টেট ডিপার্টমেন্টের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে অন্যতম মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল এ-সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। প্যাটেল বলেছেন, ভিয়েনা কনভেনশন অনুসারে যে কোনো স্বাগতিক দেশ সব কূটনৈতিক মিশন এবং তাদের কর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বাধ্য থাকবে এবং কর্মীদের উপর যে কোনো আক্রমণ প্রতিরোধে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। ‘আমাদের কূটনৈতিক কর্মীদের নিরাপত্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ,’ বলেন প্যাটেল। ঢাকায় ভারতীয় দূতাবাসের তরফ থেকেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। বিবিসির তরফ থেকে দিল্লিতে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কোনো প্রতিক্রিয়া মেলেনি।
বিভিন্ন দেশে নিয়োজিত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে , বাংলাদেশে নিযুক্ত বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা যে ধরনের ‘বিশেষ সুবিধা’ পেয়ে থাকেন, বিদেশে নিযুক্ত বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূতরা সে সুবিধা পান না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, পৃথিবীর কোনো দেশেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে বাড়তি নিরাপত্তা ও চলাচলের ক্ষেত্রে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো সুবিধা দেয় না। সাধারণত স্বাগতিক দেশের ওপরেই কূটনীতিকদের নিরাপত্তাসহ অন্যান্য বিধিবিধান নির্ভর করে বলে জানান যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির। তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রদূতদের নিরাপদে কাজ করার জন্য স্বাগতিক দেশের যতটুকু সুবিধা দেয়া দরকার তারা সেটা দেয়। এ নিয়ে স্বাগতিক দেশগুলো নিজেদের নিরাপত্তা পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে থাকে। কি ধরণের পরিবেশ তৈরি করলে সবাই নিরাপদে থাকবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়।’ পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও উজবেকিস্তানে রাষ্ট্রদূত হিসেবে এবং আরও অন্তত দশটি দেশে কূটনীতিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন সোহরাব হোসেন। ‘কূটনীতিক হিসেবে অনেক দেশে কাজ করেছি, বাংলাদেশ স্বাগতিক দেশ হিসেবে বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের যে নিরাপত্তা দেয় তা আর কোথাও দেখিনি। কখনও কোথাও আমি বিশেষ এসকোর্ট পাইনি, পশ্চিমা দেশে গাড়িতে পতাকা ওড়ানো যেতো না,’ বলেন রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির। ‘এ ছাড়া বিভিন্ন দেশে নিয়োজিত বাংলাদেশের দূতাবাসের বাইরে বা রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে কোন নিরাপত্তা বাহিনীর প্রহরা থাকে না। বাড়তি নিরাপত্তারক্ষী বা গানম্যান থাকা দূরের কথা। গাড়িতে শুধু চালক ও কূটনীতিক থাকেন।’ এ বিষয়ে হুমায়ুন কবির বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বা অন্যান্য দেশ মনে করে যে তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা যথেষ্ট ভালো। আলাদা করে পুলিশ এসকোর্টের দরকার নেই। আন্তর্জাতিক আইনে এ নিয়ে কিছু বলা নেই। তাই তারা এটা কাউকেই দেয় না। ‘তারা কীভাবে নিরাপত্তা দেবে সেটা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেয়। আমার কখনও মনে হয়নি বাড়তি নিরাপত্তা দরকার, তাই কখনও চাইনি। তবে চাইলে হয়তো পেতাম,’ বলেন রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির। তবে বাড়তি নিরাপত্তা দেওয়ার ক্ষেত্রে সব দেশের সরকারের একটি স্ট্যান্ডার্ড প্রটোকল আছে বলে জানান সোহরাব হোসেন। কোন দেশের কূটনীতিক স্বাগতিক দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফোন দিয়ে তাদের চলাচলের কথা জানালে পররাষ্ট্র দফতর থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্ক করে দেয়া হয়। কিন্তু কোনো বাড়তি নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগ দেয়া হয় না। তবে টাকার বিনিময়ে নিরাপত্তা প্রটোকল পাওয়া যায়। নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে সোহরাব হোসেন বলেন, ‘একবার আমি ইসলামাবাদ থেকে আরেক শহরে যাওয়ার আগে নিরাপত্তা চেয়েছিলাম। কিন্তু এ জন্য আমার কাছে পয়সা দাবি করা হয়। তখন আর নেইনি।’ তার মতে, কূটনীতিকদের কেমন নিরাপত্তা দেয়া হবে সেটা স্বাগতিক দেশের ওপর নির্ভর করে। যেমন আফগানিস্তান, পাকিস্তানে কিছুটা নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকে। আবার রাজধানীর বাইরে গেলে ঝুঁকি বাড়তে পারে। ‘কোন বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি হলে আলাদা কথা। না হলে কোন দেশেই বাড়তি কোন সুবিধা দেয়া হয় না। তবে বাড়তি নিরাপত্তা চাইলে তারা ব্যবস্থা করে তবে সেজন্য মোটা অংকের পয়সা গুনতে হয়।’
ভিয়েনা সনদ আর্টিকেল ২০-এ বলা হয়েছে, রাষ্ট্রদূত তার বাড়িতে, অফিসে, গাড়িতে সেই দেশের পতাকা ওড়াতে পারবেন এবং তাদের মনোগ্রাম বা এমব্লেম ব্যবহার করতে পারবে। এগুলো ব্যবহার করা না করার ব্যাপারে কূটনীতিকরা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কিন্তু এ বিষয়ে হোস্ট দেশ কোনো বাধা দিতে পারবে না। তবে বিভিন্ন দেশে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতরা পতাকা ওড়ানোর ক্ষেত্রেও একেক দেশে একেক নিয়ম দেখেছেন। এশিয়ার দেশগুলোয় তারা গাড়িতে পতাকা ওড়াতে পারলেও, পশ্চিমা দেশে ওড়াননি। কূটনীতিকদের গাড়িতে পতাকা ওড়ানো বন্ধ হচ্ছে কি না, এ প্রশ্নে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘এটা নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। নিউইয়র্ক বা জেনেভায় কখনই পতাকা ওড়ানোর কোনো পদ্ধতি নেই। অনেক দেশে আছে, রাষ্ট্রীয় যত মিটিং হয় তখন পতাকা উড়িয়ে যাওয়া যায়। এটা মিশন প্রধানদের নিজেদের ওপর থাকে।’ ভিয়েনা সনদ অনুযায়ী স্বাগতিক দেশকে অবশ্যই সব কূটনৈতিক মিশন ও কূটনীতিকদের সুরক্ষার বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করতে হবে। সে হিসেবে কূটনীতিক এবং অবকাঠামোর সুরক্ষা ও নিরাপত্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এবং আর্টিকেল ৪৭ অনুযায়ী এসব নিরাপত্তা ও সুবিধা দেয়ার ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্যমূলক আচরণ করা যাবে না। বাংলাদেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতদের এই বিশেষ নিরাপত্তা দেওয়ার কারণ হিসেবে হুমায়ুন কবির জানান, সাধারণত অভিজ্ঞতার আলোকে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের বিশেষ নিরাপত্তা দেয়া হয়।
ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে পুলিশের বাড়তি প্রোটকল তুলে দেয়া হলেও রাষ্ট্রদূতসহ কূটনীতিকরা বাকি সব ধরনের নিরাপত্তা সুবিধা আগের মতোই পাবেন। বাংলাদেশের তরফ থেকে বলা হয়েছে, প্রতিটি দূতাবাস, কূটনীতিকদের বাসভবন এবং ক্লাবে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের নিরাপত্তা অব্যাহত থাকবে সেইসাথে রাষ্ট্রদূতদের পুলিশ প্রদত্ত গানম্যান নিয়োজিত থাকবে। এই সশস্ত্র সদস্যদের বিশেষ পরিস্থিতিতে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের অনুমোদন দেয়া আছে। ঢাকায় কূটনৈতিক জোনে ৫৩টি দেশ রয়েছে। প্রতিটি দেশের কূটনীতিকদের নিরাপত্তা দিতে বিশাল সংখ্যক নিরাপত্তারক্ষী মোতায়েন থাকে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সোমবার একটি বেসরকারি টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে বলেছেন, সৌদি আরবের ক্লাব, দূতাবাস, বাসভবনসহ কূটনীতিকদের নিরাপত্তায় ৪৮ জন পুলিশ মোতায়েন আছে। ব্রিটিশ হাইকমিশনের নিরাপত্তায় ২৯ জন দায়িত্ব পালন করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ১৫৮ জন নিরাপত্তায় নিয়োজিত আছেন। তাদের এসব নিরাপত্তা অব্যাহত থাকবে। শুধুমাত্র ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে পুলিশের বাড়তি সুবিধা প্রত্যাহার হবে, বলেন শাহরিয়ার আলম।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সোমবার গণমাধ্যমকে বলেছেন, এখন থেকে এই বাড়তি সুবিধা নিতে হলে নির্দিষ্ট ফি দিতে হবে। কোন দূতাবাস এই সুবিধা অব্যাহত রাখতে চাইলে বা বাড়তি সুবিধা নিতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে জানালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বিদেশি কূটনীতিকরা তাদের খরচে এ সুবিধাটি গ্রহণ করতে পারবেন। এদিকে কূটনীতিকদের নিরাপত্তা দিতে পুলিশের পরিবর্তে আনসার ব্যাটালিয়নের সহায়তায় বিশেষ গার্ড রেজিমেন্ট গঠন করার কথা জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, যাদের মূল দায়িত্ব হবে কূটনীতিকদের নিরাপত্তা দেয়া। পরবর্তী সময়ে ভিআইপি ও ভিভিআইপিদের নিরাপত্তার দায়িত্ব এই আনসার গার্ড রেজিমেন্টকে দেওয়া হবে বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। গণমাধ্যমকে আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘বাংলাদেশ আনসার বাহিনীতে একটি চৌকস দল তৈরি করা হয়েছে। চারটি দেশকে তাদের গাড়ির সামনে এবং পেছনে নিরাপত্তা দেয়া হতো। আমরা ঠিক করেছি পুলিশের বদলে এই গার্ড রেজিমেন্ট তাদের সামনে পেছনে থাকবে। আরও কোনো রাষ্ট্রদূত চাইলে তাদেরও দেব।’ পুলিশের জায়গায় আনসার বাহিনী নেয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের বহু কাজে পুলিশ লাগে। পুলিশের সংখ্যা বাড়নো যাচ্ছে না। সামনে নির্বাচন আছে। সবকিছু চিন্তাভাবনা করে পুলিশকে নিরাপত্তার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে।’ এদিকে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা ওই বাড়তি সুবিধা পেতে অনুরোধ জানিয়ে আসছে। এমন অবস্থায় পররাষ্ট্র দফতর জানায়, বিশেষ এসকর্টে পুলিশ সদস্যের পাশাপাশি বাড়তি গাড়িসহ আরও অনেক সরঞ্জামের প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর কাজের পরিসর বেড়ে যাওয়ায় এই বাড়তি সুবিধা এখন অব্যাহত রাখা যাচ্ছে না। এবিএন/এসএ/জসিম
এই বিভাগের আরো সংবাদ