আজকের শিরোনাম :

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন

রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমার প্রতিনিধিদল কতটা আন্তরিক?

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৭ মার্চ ২০২৩, ১৩:৫৬

মিয়ানমারে সহিংসতার মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত নেয়ার ব্যাপারে নানা গড়িমসির পর অবশেষে একটি প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছে মিয়ানমার।

প্রত্যাবাসনের জন্য তালিকাভুক্ত হয়েও যেসব রোহিঙ্গা বাদ পড়েছিলেন, এবারে তাদের তথ্য পুনরায় যাচাই-বাছাই করতে প্রতিনিধিদলটি বুধবার সকালে বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার টেকনাফে আসে।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ আট লাখ ৮৮ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীর তালিকা মিয়ানমারের কাছে পাঠিয়েছিল।

এরপর মিয়ানমারের পক্ষ থেকে ৬৮ হাজার রোহিঙ্গার একটি ফিরতি তালিকা পাঠানো হয়। ওই তালিকা থেকে পরিবারভিত্তিক প্রত্যাবাসনের জন্য প্রাথমিকভাবে ১১৪০ জনকে বাছাই করা হয়।

এর মধ্যে ৭১১ জন রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে মিয়ানমার সম্মতি দিলেও বাকি ৪২৯ জনের ব্যাপারে তাদের আপত্তি ছিল।

প্রত্যাবাসনের ওই প্রাথমিক তালিকা থেকে একই পরিবারের কোনো কোনো সদস্য ওই বাদ পড়া তালিকায় চলে যান।

বিষয়টি মিয়ানমারকে অবহিত করা হলে বাদ পড়া ৪২৯ জন রোহিঙ্গার তথ্য পুনরায় যাচাইয়ের জন্যই প্রতিনিধিদলটি এবারে বাংলাদেশে এসেছে।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের (আরআরআরসি) কমিশনার মিজানুর রহমান এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

আবার ওই তালিকার অনেক রোহিঙ্গা পরিবার নতুন করে সন্তান জন্ম দিয়েছেন। সেই শিশুদের তথ্যও নথিভুক্ত করার বিষয়টি বিবেচনায় থাকতে পারে বলে তিনি জানিয়েছেন।

এই টেকনিক্যাল দলের সদস্যরা মূলত রোহিঙ্গাদের তালিকা যাচাই-বাছাই করবেন। বুধবার প্রথম দিনে অন্তত ৬৫ জন রোহিঙ্গার সাক্ষাতকার নিয়েছেন তারা। সবার তথ্য যাচাইয়ে ৫-৬ দিন লাগতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

তবে প্রতিনিধি দলের সদস্যরা শুধুই রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন। প্রত্যাবাসন নিয়ে তারা কোনও কিছুই বলছেন না বলে জানান মিজানুর রহমান।

তালিকা ধরে এর আগেও দুবার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরুর কথা থাকলেও রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিয়ে আপত্তি থাকায় তা সম্ভব হয়নি।

সাক্ষাতকারে অংশ নেয়া দুজন রোহিঙ্গা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, তাদের কাছে মিয়ানমারের প্রতিনিধিরা জানতে চেয়েছেন তারা নিজ দেশে মিয়ানমারে ফিরতে চান কিনা।

জবাবে একজন বলেছেন, ‘মিয়ানমার তো আমার দেশ আমি ফিরতে চাব না কেন? বাংলাদেশ তো আমার দেশ না। আমি আবার মাতৃভূমিতে ফিরতে চাই। কিন্তু আমাদের কিছু ডিমান্ডের কথা আমরা বলেছি।’

তার মতো বেশিরভাগ রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে সেই দেশে তাদের নিরাপত্তা দাবি করেছেন।

সেইসাথে তাদের যেসব ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, সেখানে যথাযথ পুনর্বাসন, মর্যাদাপূর্ণ নাগরিক অধিকার, স্বাধীনভাবে চলাচল এবং রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকৃতি চেয়েছেন।

‘আমাদের যদি নিরাপত্তা দেয়, স্বাধীনভাবে চলাচল করতে দেয়, নাগরিক সুবিধা, বাড়িঘর-জায়গা-জমি আমাদেরকে যদি আগের মতো করে দেয় আমরা অবশ্যই যাবো। আমাদের তো সব পুড়িয়ে দিয়েছে।’ বলেন এক রোহিঙ্গা।

মিয়ানমারের নাগরিকত্বের তথ্য প্রমাণ হিসেবে রোহিঙ্গা সদস্যরা তাদের মিয়ানমারের জমি-জমার দলিল, মিয়ানমারের সীলযুক্ত কাগজপত্র ইত্যাদি দেখানোর কথা জানিয়েছে। সেইসাথে তাদের নাম, পরিচয়, ঠিকানা, পেশা ইত্যাদি বিষয়ে নানা তথ্য নেয়া হয়।

সাক্ষাৎকার দিয়ে ফেরা ওই রোহিঙ্গা জানিয়েছেন, ‘তারা আমাদের মিয়ানমারের কোন এলাকায় ছিলাম, কোথায় ছিলাম, কোন জেলায়, কোন থানায় কোন মৌজায়, সেখানে চেয়ারম্যান কে ছিল, এসেম্বলি মেম্বার কারা এমন নানা প্রশ্ন করেছে। আমরা আমাদের জমির কাগজপত্র দেখিয়েছি। অনেক কাগজ দেখাতে পারি নাই। পুড়ে গেছে।’

তবে তাদের আদৌ ফিরিয়ে নেয়া হবে কি হবে না সে বিষয়ে প্রতিনিধি দলের কেউ কিছু বলেননি।

২০১৭ সালের ২৫শে অগাস্ট থেকে পরবর্তী কয়েক মাস সহিংসতার মুখে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।

এর আগেও বিভিন্ন সময়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। সব মিলিয়ে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্প ও ভাসানচরে স্থানান্তরিত প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা আছেন বলে জানা গিয়েছে।

এই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে গত ছয় বছর ধরে নানা প্রচেষ্টা চালানো হলেও বাংলাদেশ সরকার একজন রোহিঙ্গাকেও নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে পারেনি।

মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের পালিয়ে আসার তিন মাসের মাথায় ২০১৭ সালের ২৩শে নভেম্বর প্রত্যাবাসন ইস্যুতে ওই চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল। এজন্য একই বছরের ১৯শে ডিসেম্বর ঢাকায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে দুদেশের যৌথ ওয়ার্কিং কমিটি গঠন হয়।

কথা ছিল চুক্তি স্বাক্ষরের দুই মাসের মধ্যে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করার। কিন্তু মিয়ানমারের তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের নামে কালক্ষেপণ করে আসছে।

২০১৮ সালে এক দফা প্রত্যাবাসন শুরুর চেষ্টা ব্যর্থ হয়। পরে চীনের মধ্যস্থতায় ২০১৯ সালে আবার প্রত্যাবাসন শুরুর প্রচেষ্টা দেখা দিলেও রাখাইন রাজ্যের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কার কথা তুলে তখন ফিরতে রাজি হননি রোহিঙ্গারা।

এরপর ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে। এতে প্রত্যাবাসনের আলোচনা একেবারেই থমকে যায়। ফলে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে দেশটির সরকার বারবার আশ্বাস দিলেও এখন পর্যন্ত প্রত্যাবাসনে থেকে কার্যত কোন উদ্যোগ দেখা যায়নি।

এমন অবস্থায় মিয়ানমারের এই যাচাই বাছাইয়ের পদক্ষেপকে বেশ ইতিবাচকভাবে দেখছেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের (আরআরআরসি)কমিশনার মিজানুর রহমান।

তিনি জানান, ‘এটি অবশ্যই একটি ইতিবাচক সাড়া। এত দিন থমকে ছিল। এখন তো একটা মুভমেন্ট হচ্ছে। এটাই হয়তো সামনে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেবে। তবে সেটা ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের সিদ্ধান্ত।’

যে প্রতিনিধিরা এসেছেন তাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে মন্তব্য করার কোন এখতিয়ার নেই, প্রতিনিধিরা শুধু সাক্ষাতকার নেবেন। তারা ক্যাম্প পরিদর্শন বা বৈঠক করার মতো কোন কর্মসূচিতে অংশ নেবেন না বলে তিনি জানান।

এবিএন/এসএ/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ