আজকের শিরোনাম :

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন

পশ্চিমবঙ্গের নন্দীগ্রামে যেভাবে শুরু হয়েছিল কৃষক বিক্ষোভ

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৫ মার্চ ২০২৩, ১৩:৪০

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে একটা বড় মোড় এসেছিল ২০০৭ সালের ১৪ই মার্চ। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার নন্দীগ্রামে কৃষি জমি অধিগ্রহণ করে বৃহৎ শিল্প তালুক গড়ার বিরুদ্ধে বিক্ষোভরত কৃষকদের ওপরে গুলি চালিয়েছিল কমিউনিস্ট সরকারের পুলিশ। সরকারি হিসাবেই মারা গিয়েছিলেন ১৪ জন নারী-পুরুষ।

সেই ঘটনার পর থেকেই পশ্চিমবঙ্গে ‘বামফ্রন্ট জমানা’ অবসানের শুরু হয়েছিল। তারপরে একের পর এক নির্বাচনে পর্যুদস্ত হতে হতে শেষমেশ ৩৫ বছর রাজ্য শাসন করে বিদায় নিতে হয় বামফ্রন্টকে।

আর ওই কৃষক বিক্ষোভের নেতৃত্ব দেওয়ার মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন মমতা ব্যানার্জী।

যেভাবে শুরু হয়েছিল নন্দীগ্রামের কৃষক বিক্ষোভ
সালটা ছিল ২০০৭, জানুয়ারি মাস। হুগলি জেলার সিঙ্গুরে টাটাদের গাড়ি কারখানার বিরুদ্ধে ২৬ দিন অনশন শেষ করে মাত্র কয়েক দিন আগে তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা ব্যানার্জী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গে তখন চরম গণ্ডগোল চলছে। দীর্ঘ কয়েক দশকের নীতি থেকে সরে এসে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকার সেই সময়ে মন দিয়েছিল কলকারখানা গড়ে তুলতে।

সিঙ্গুরে যেমন টাটা গোষ্ঠী তাদের গাড়ি কারখানা গড়া উদ্যোগ নিয়েছে, আবার পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রামে বৃহৎ পেট্রোরসায়ন হাবের পরিকল্পনা হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ার সালিম গ্রুপ ওই হাব এবং বিশেষ শিল্পাঞ্চল গড়ার জন্য আগ্রহী। তারা কলকাতাকে ঘিরে বিরাট চওড়া রাস্তা, হুগলি নদীর ওপরে নতুন সেতু ইত্যাদি তৈরির পরিকল্পনা করছে।

এরই মধ্যে নন্দীগ্রামে একটি সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারি হয়, যেখানে ওই পেট্রোরসায়ন হাবের জন্য জমি অধিগ্রহণের কথা বলা হয়। শুরু হয়ে যায় বিক্ষোভ।

ওই অঞ্চলে তখন দোর্দন্ডপ্রতাপ ক্ষমতাসীন সিপিআইএম দলের। তাদের দলীয় কর্মীদেরই একটা অংশ বিক্ষোভে নেমে পড়লেন নিজেদের সরকারের বিরুদ্ধে। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন স্থানীয় তৃণমূল কংগ্রেস কর্মীরা, জামিয়াত উলেমা এ হিন্দ এবং স্থানীয় স্তরে কিছু ছোট বামপন্থী দল। পরে এই কৃষক বিক্ষোভে যোগ দেন মাওবাদীরাও।

নন্দীগ্রামের পাশে কাঁথি শহরে তৃণমূল কংগ্রেস নেতা শুভেন্দু অধিকারী, যিনি এখন বিজেপির নেতা, তার মাধ্যমে নন্দীগ্রামে কৃষক বিক্ষোভের নেতৃত্ব চলে যায় মমতা ব্যানার্জীর হাতে।

‘সিপিআইএমের বিরুদ্ধে রাগ জমছিল মানুষের মনে যে তারা অত্যন্ত বাড়াবাড়ি করছে রাজ্য চালানোর ব্যাপারে, নন্দীগ্রামের বিক্ষোভ ছিল সেই ক্ষোভের স্বতঃ:স্ফূর্ত প্রকাশ,’ বলছিলেন বিশ্লেষক শিখা মুখার্জী।

বিক্ষোভের শুরুতেই রাস্তা কেটে দেওয়া হয় অনেক জায়গায়, যাতে পুলিশ প্রশাসন ভেতরে ঢুকতে না পারে।

অন্যদিকে নন্দীগ্রাম ছাড়তে হয় বহু সিপিআইএম কর্মী আর তার পরিবারগুলিকেও।

নন্দীগ্রামের মানুষের কাছেই শুনেছি, ব্রিটিশ আমলে যখন বর্তমানে পূর্ব মেদিনীপুর যে জেলা, সেখানে কয়েকদিনের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল স্বাধীন তাম্রলিপ্ত সরকার। ব্রিটিশ পুলিশকে আটকাতে তখনও নাকি এভাবেই রাস্তা কেটে দেওয়া হয়েছিল।

নন্দীগ্রাম, ১৪ই মার্চ, ২০০৭
প্রায় তিন মাস পুরো দেশ থেকে একরকম বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিল নন্দীগ্রাম। মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকেই শোনা যাচ্ছিল হয়তো পুলিশ অপারেশন হবে সেখানে। তারিখও একটা জানতে পারছিল সাংবাদিকরা, যে ১৪ তারিখ সকাল থেকে প্রশাসন প্রবেশ করার চেষ্টা করবে নন্দীগ্রামে। প্রচুরসংখ্যক পুলিশ নিয়ে আসা হয়েছিল সেদিন।

‘আমরা কয়েকজন সাংবাদিক হেড়িয়ার দিক দিয়ে ঢুকেছিলাম। কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পরে আমাদের আর এগোতে দেয়নি পুলিশ। অন্যদিক থেকে আমরা কীর্তন, শাঁখের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। সকাল আটটা নাগাদ পুলিশ এগোতে থাকে আর একটু পরেই আমরা ফায়ারিংয়ের আওয়াজ পাই,’ জানাচ্ছিলেন সাংবাদিক বিশ্বজিত ভট্টাচার্য।

যে কয়েকজন সাংবাদিক ওইদিক দিয়ে ঢুকতে পেরেছিলেন, তারাই দৃশ্যটা দেখতে পেয়েছিলেন দূর থেকে। কিন্তু বাকি সংবাদমাধ্যম যাতে নন্দীগ্রামে না পৌঁছতে পারে, সেজন্য কলকাতার দিক থেকে একের পর এক জাতীয় মহাসড়কে অবরোধ করেছিলেন বামপন্থী কর্মীরা।

আমাকে অন্তত পাঁচ থেকে ছয়টি অবরোধ পেরিয়ে পৌঁছতে হয়েছিল চন্ডীপুর নামের একটা মোড়ে। সেখানে স্থানীয় সিপিআইএম কর্মীরা সাংবাদিকদের গালিগালাজ করছিলেন, গাড়িতে বাঁশ দিয়ে মারছিলেন।

নন্দীগ্রামের ভেতরে যেখান থেকে গুলি চালানোর আওয়াজ পেয়েছিলেন ভট্টাচার্য, সেখানে শয়ে শয়ে চটি, চপ্পল পড়ে ছিল।

আর ছিল রক্তের দাগ, জানলায়, বাড়ির দেওয়ালে গুলির দাগ। সেসব আমরা পরের দিন যখন নন্দীগ্রামের ভেতরে যেতে পারি, তখন দেখেছিলাম।

কৃষকরা ক্ষুব্ধ হচ্ছিলেন আগে থেকেই
সেই সময়ে বিবিসি বাংলা একটা রেডিও ধারাবাহিক প্রযোজনা করছিল পশ্চিমবঙ্গের শিল্প আর কৃষির মধ্যে তৈরি হওয়া বিরোধ নিয়েই।

সেই ধারাবাহিকের তথ্য সংগ্রহ করতেই প্রথম নন্দীগ্রাম যাই জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি। এক স্থানীয় বাসিন্দা মোটরসাইকেলে করে আমাকে ঘুরিয়েছিলেন পুরো অঞ্চল। সেখানে গাড়ি নিয়ে যাওয়ার তো উপায় ছিলই না, এমনকি ভ্যান বা রিকশাও চলছিল না।

বহু মানুষের সঙ্গে দুদিন ধরে কথা বলেছিলাম, বোঝার চেষ্টা করেছিলাম কেন নিজের দল আর সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেই তারা আন্দোলনে নামলেন।

আসলে পশ্চিমবঙ্গের ছোট কৃষকদের মধ্যে সিপিআইএম দল নিয়ে একটা ক্ষোভ জমছিলই বেশ কিছুদিন আগে থেকে।

বিশ্লেষকরা বলছেন যে স্থানীয় স্তরে সিপিআইএমের দুর্নীতি, বড় চাষীরা দলে যুক্ত হয়ে গিয়ে যেভাবে নেতৃত্বে চলে আসছিলেন, তার ফলে ছোট কৃষক, ভাগচাষিদের মতো শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির মানসিক দূরত্ব তৈরি হচ্ছিল।

‘পশ্চিমবঙ্গে ভাগচাষী আর ছোট কৃষকদের জমির অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল অপারেশন বর্গার মাধ্যমে। ওই ভূমি সংস্কার কর্মসূচীর মাধ্যমেই তো বামফ্রন্ট তাদের বিপুল জনভিত্তি তৈরি করেছিল, কিন্তু সেই শ্রেণীটা যখন দেখল যে তাদের একমাত্র মূলধন চাষের জমি, সেটাও চলে যেতে বসেছে, তখনই তারা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে শুরু করলেন। আর ১৪ই মার্চ যখন তারা দেখল যে সরকার জমি নিতে কৃষকদের ওপরেও গুলি চালাতে দ্বিধা করল না, তখন তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে যে এই সরকারকে আর রাখা যাবে না,’ বলছিলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলামিস্ট বিশ্বজিত ভট্টাচার্য।

দ্বিতীয় অপারেশন নভেম্বরে
পুলিশের গুলিতে ১৪ জন কৃষক নিহত হওয়ার পরে রাজ্য সরকারের ওপরে যে চাপ তৈরি হয়েছিল, তার ফলে প্রশাসন আর বেশি নন্দীগ্রামের ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা করেনি। পুরো এলাকাই নিয়ন্ত্রণ করত ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি। কিন্তু নভেম্বরে সিপিআইএম আবার চেষ্টা করে নন্দীগ্রামে প্রবেশ করতে। সেদিনের সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আমি নিজেই।

১৪ মার্চের মতোই সেদিনও রাস্তা আটকিয়ে দেওয়া হয়েছিল অনেক আগে থেকে। আমি বহু ঘুরে হলদি নদীর ফেরি পেরিয়ে নন্দীগ্রামে ঢুকি। গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই তারা সতর্ক করেন আমাকে। বলেন, ‘আপনি এখুনি চলে যান। সিপিএমের মিছিল ঢুকছে। বাইরের সাংবাদিক দেখলে আপনার খবর আছে।’

কোন পথ দিয়ে বাইরে বের হতে হবে, সেটাও দেখিয়ে দিয়েছিলেন। আর ঘরের ভেতর থেকে লাল কাপড়ের টুকরো নিয়ে এলেন তারা, তাদের দেখাতে হবে তো যে তারা আসলে সিপিআইএমেরই সমর্থক।

একটা খালের পাশ দিয়ে আমার ভ্যান রিকশা চালাক প্রাণপণে প্যাডেল করে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু সিপিআইএমের বিরাট একটি মিছিল তখন খুব কাছাকাছি চলে এসেছে, ৫০ মিটারের কম দূরত্বে।

বর্তমানে নন্দীগ্রাম কতটা প্রাসঙ্গিক?
অনেক বছর পরে আবার নন্দীগ্রামে গিয়েছিলাম ২০২১ সালে, যখন মমতা ব্যানার্জী কলকাতায় তার অনেকবারের জেতা আসন ভবানীপুর ছেড়ে নন্দীগ্রামে লড়বেন বলে ঘোষণা করেন।

ওই আসনের রাজনৈতিক গুরুত্ব তখন বেড়েছে শুধু একারণে নয় যে মুখ্যমন্ত্রী লড়াই করছেন সেখান থেকে। গুরুত্বটা এই কারণে যে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হলেন তৃণমূল কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়া শুভেন্দু অধিকারী।

এই শুভেন্দু অধিকারী ছিলেন নন্দীগ্রাম কৃষক বিক্ষোভে মমতা ব্যানার্জীর মূল সেনাপতি, আর ২০২১-এ তারা মুখোমুখি।

মমতা ব্যানার্জী তার সেনাপতি শুভেন্দু অধিকারীর কাছে হেরে যান সেই নন্দীগ্রাম থেকে, যেখান থেকে তার ক্ষমতার শীর্ষে উত্থান শুরু হয়েছিল। সেই ভোটের ফলাফল নিয়ে এখন মামলা চলছে।

বিশ্লেষক শিখা মুখার্জী বলছিলেন, ‘নন্দীগ্রাম যে এখনও প্রাসঙ্গিক তার প্রতিফলন এটাই যে মুখ্যমন্ত্রী তার নিশ্চিত আসন ছেড়ে সেখানে ভোটে লড়লেন। সেখান থেকেই তো তৃণমূল কংগ্রেসের আসল উত্থান, তার শুরু সেখান থেকেই। আসলে ওই জায়গাটা ২০০৭ সাল থেকেই বিরোধী আন্দোলনের আঁতুর ঘর হয়ে উঠেছিল।’

এবিএন/এসএ/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ