বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন

হিটলারের নির্দেশে যেভাবে রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি সরিয়ে ফেলা হয়েছিল

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২২, ১৪:০০

সেখানে আছে সব মিলিয়ে পাঁচটি শিল্পকর্ম, পাখি এবং মানুষের ছবি। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে লাল পোশাক পরা একটি মেয়ে।  রঙিন কালি ও জলরঙ দিয়ে এই ছবিগুলো এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভারতের এবং বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে বিখ্যাত কবি। এই ছবিগুলো ঠাঁই পেয়েছিল বার্লিনের একটি বিখ্যাত মিউজিয়ামে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ইউরোপের বাইরে থেকে প্রথম কেউ, যিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। ১৯৩০ সালে তিনি এই ছবিগুলো জার্মানিকে উপহার দেন। কিন্তু সাত বছর পর নাৎসি শাসকরা এই ছবিগুলো বাতিল করে দেয়, কারণ তারা তখন কিছু কিছু শিল্পকর্মকে ‘আপত্তিকর’ বলে তালিকাভুক্ত করছিল। তাদের মতে শিল্পকর্ম হিসেবে এগুলো কোনো জাতের মধ্যেই পড়ে না।   

হিটলার নিজেই ছিলেন শিল্পী হিসেবে ব্যর্থ। তিনি ইমপ্রেশনিস্ট পরবর্তী আধুনিক চিত্রকলাকে ‘বিকৃত মনের প্রকাশ’ বলে মনে করতেন। 

এ জন্য তিনি ১৬ হাজার শিল্পকর্ম জার্মান জাদুঘরগুলো থেকে সরিয়ে নিতে বলেছিলেন। এর মধ্যে ভ্যান গগ এবং ম্যান রে’র মতো শিল্পীর কাজও ছিল।  

নাৎসিরা এসব শিল্পকর্মকে ‘অবক্ষয়’ বলে গণ্য করতো এবং এমনকি একটি প্রদর্শনীরও আয়োজন করেছিল এগুলোকে বিদ্রূপ করার জন্য।  

তবে শিল্পকর্মের বিরুদ্ধে হিটলারের এই কুখ্যাত অভিযানের সময় কেন রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবিকে টার্গেট করা হয়েছিল সে বিষয়ে খুব কম তথ্যই পাওয়া যায়।

শিল্পকলার ইতিহাস নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের ধারণা, রবীন্দ্রনাথের শিল্পকর্ম ছিল আধুনিক ধারার, কাজেই এগুলো নাৎসিদের সহজ টার্গেটে পরিণত হয়েছিল।

হিটলার একবার বলেছিলেন, ‘যারা আকাশকে সবুজ দেখে এবং সবুজ রঙে আঁকে, কিংবা মাঠ আঁকে নীল রঙে, তাদের নির্বীজ করে দেয়া উচিৎ।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জার্মানি সফরে গিয়েছিলেন তিনবার- ১৯২১, ১৯২৬ এবং ১৯৩০ সালে। তার দুই ডজন বই  ততদিনে জার্মান ভাষায় পাওয়া যাচ্ছে।

‘তিনি যেখানেই বক্তৃতা দিতে যাচ্ছেন, সেখানেই হলভর্তি মানুষ। সংবাদপত্রগুলোয় রিপোর্ট আসছে, যারা হলে ঢুকতে পারছে না তাদের মধ্যে রীতিমতো ধাক্কাধাক্কি-মারামারি হচ্ছে,’ বলছিলেন মার্টিন কাম্পচেন, যিনি রবীন্দ্রনাথের অনেক কাজ অনুবাদ করেছেন।

স্থানীয় গণমাধ্যমে তখন রবীন্দ্রনাথকে ‘প্রাচ্যের এক জ্ঞানী মানুষ’ বলে পরিচয় করিয়ে দেয়া হচ্ছে। তাকে বর্ণনা করা হচ্ছে এক ঈশ্বরপ্রেরিত, রহস্যময় উদ্ধারকর্তা রূপে।

রবীন্দ্রনাথের আঁকা প্রায় তিনশো শিল্পকর্মের একটি একক প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল ইউরোপের বিভিন্ন দেশে।

এর মধ্যে ১০০ ছবির প্রদর্শনী হয় প্যারিসে। এর অর্ধেক আবার প্রদর্শিত হয়েছে বার্লিনের ন্যাশনাল আর্ট গ্যালারিতে। এরপর এই প্রদর্শনী যায় লন্ডনে।

রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবিগুলো ১৯৩৭ সালের আগে পর্যন্ত বার্লিনের ক্রাউন প্রিন্স প্যালেসে রাখা হয়েছিল। এখানেই ছিল আবার ন্যাশনাল গ্যালারি।

যখন হিটলারের লোকজন শিল্পকর্মের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান শুরু করলো, তখন ১৯৩৭ সালের ১৫ অক্টোবরের একটি তালিকায় দেখা যায়, সেখানে অনেক বিখ্যাত এক্সপ্রেশনিস্ট পেইন্টিংয়ের সঙ্গে অন্য পাঁচটি ছবি সরিয়ে নেয়া হয় প্যালেস থেকে। এগুলো রাখা হয়েছিল শহরের একটি গুদামে, যেখানে ঢুকতে অনেক বিধিনিষেধ ছিল। বলছিলেন শিল্পকলা বিষয়ক ইতিহাসবিদ কনস্টান্টিন ওয়েনযলাফ। কিন্তু এরপর কী ঘটেছিল, তা এখনো স্পষ্ট নয়।

১৯৪১-৪২ সালে একটি ‘ডিজেনারেট আর্ট’ বা তথাকথিত ‘অবক্ষয়িত শিল্পকর্মের’ তালিকা তৈরি করা হয়।

নাৎসি আমলে যেসব শিল্পকর্ম হারিয়ে গিয়েছিল, সেগুলো খুঁজে বের করার জন্য পরে এই তালিকাটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে।

এই তালিকায় রবীন্দ্রনাথের এই পাঁচটি শিল্পকর্মের সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে। মোটা-দাগে এগুলোর নাম রাখা হয়েছে মুখোশ, প্রতিকৃতি, মেয়ে (লাল পোশাকে) , মুখোশ এবং দুটি পাখি।

এই জব্দ করা শিল্পকর্মগুলোর তালিকাটি ছিল শিল্পীদের নামের বর্ণানুক্রমে তৈরি, এবং এগুলোর পাশে সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন টি (বিনিময় করা হয়েছে), ভি (বিক্রি হয়ে গেছে) এবং এক্স (ধ্বংস করা হয়েছে)।

রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবির বেলায় এই তালিকায় দুটির পাশে লেখা আছে এগুলো বিনিময় করা হয়েছে এবং দুটির পাশে লেখা ধ্বংস করা হয়েছে। পঞ্চমটি, যার নাম ‘দুটি পাখি’, তার পাশে কোনো সাংকেতিক চিহ্ন নেই।

ওয়েযলাফ লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথের শিল্পকর্ম গ্যালারি থেকে অদৃশ্য হয়ে যায় এবং এরপর এ পর্যন্ত উদ্ধার করা হয়নি।

রবীন্দ্রনাথের তিনটি শিল্পকর্ম ১৯৩৯ সালে তার কাছে ফেরত দেওয়ার কথা ছিল- কারণ হিটলারের পাবলিক এনলাইটমেন্ট অ্যান্ড প্রোপাগান্ডা মন্ত্রণালয় থেকে এক চিঠিতে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বংশধরদের সঠিক ঠিকানার ব্যাপারে জানতে চাওয়া হচ্ছিল, যদিও কবি তখনো জীবিত। 

আর সিভা কুমার একজন শিল্পকলা বিষয়ক ইতিহাসবিদ। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিল্পকর্ম নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করেছেন।

তাঁর বিশ্বাস এই তিনটি ছবি হয়তো ১৯৩৯ সালে কবির কাছে ফেরত দেয়া হয়েছিল, আর বাকী দুটি হারিয়ে গেছে।  

কিন্তু মিউনিখের পিনাকোথেক ডের মডার্ন মিউজিয়ামের অলিভার কাস আমাকে জানিয়েছেন, যে দুটি ছবি হারিয়ে গেছে বলে মনে করা হয়, তার একটি ব্যাভারিয়ান স্টেট পেইন্টিং সংগ্রহশালায় আছে ১৯৬৪ সাল থেকে।

তিনি জানান, একটি ‘আধছায়া মাথার’ এই চিত্রকর্মটি একই সঙ্গে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে খুবই কঠোর, আবার সেই সঙ্গে বেশ ‘স্বাপ্নিক আধ্যাত্মিকতা।’ এ ধরনের শিল্পকর্মকেই তখন নাৎসিরা ‘ডিজেনারেট আর্ট’ বা অধঃপতিত শিল্পকর্ম বলে বর্ণনা করতো।

তিনি বলেন, ‘আমার বিশ্বাস, জার্মানিতে কোন সরকারি সংগ্রহশালায় এটিই রবীন্দ্রনাথের আঁকা একমাত্র ছবি।’

অলিভার কাস বলেন, দ্বিতীয় ছবিটি ১৯৯৬ সালের অক্টোবরে এক নিলামে একজন ব্যক্তিগত শিল্প-সংগ্রাহকের কাছে বিক্রি করা হয়। 

‘বাকি যে তিনটি ছবি রবীন্দ্রনাথের কাছে ভারতে ফেরত পাঠানো হয়, সেগুলো হারিয়ে গেছে।  

অধ্যাপক সিভা কুমারের বিশ্বাস, তিনি হয়তো এই ফেরত পাঠানো ছবিগুলোর একটি বিশ্ব-ভারতীর আর্কাইভে দেখেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে। সেখানে আর্কাইভটি পরিচালনা করেন নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি আমাকে জানালেন, এই পেইন্টিংয়ের ব্যাপারে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে কিছু বলতে পারছেন না, তবে এগুলোর যদি কোন দৃশ্যমান প্রমাণ থাকে, তাহলে হয়তো খুঁজে পেতে সাহায্য হবে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছবি আঁকা শুরু করেছিলেন তার বয়স যখন ষাটের মধ্য কোঠায় তখন। তিনি ১৯৪১ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত প্রায় ২ হাজার ৩শ ছবি আঁকেন।

‘তিনি সবসময় আঁকতে চাইতেন। তিনি তার নিজের পাণ্ডুলিপির মধ্যেই নানারকম আঁকা-বুকি করতেন। এরপর ১৯২৮ সালের দিকে তিনি তার প্রথম ছবিগুলো আঁকা শুরু করেন,’ বলছিলেন অধ্যাপক সিভা কুমার। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এক বিরল বহুমুখী প্রতিভা- একইসঙ্গে কবি, ঔপন্যাসিক, শিক্ষক, দার্শনিক, এবং সঙ্গীত স্রষ্টা। তিনি কাল্পনিক প্রাণীর ছবি, জ্যামিতিক প্যাটার্ন, নারীদেহ, আত্মপ্রতিকৃতি, ল্যান্ডস্কেপ এবং সত্যিকারের মানুষের মতো দেখতে মুখোশ- কী আঁকেননি?

শিল্পকলা ইতিহাসবিদদের বিশ্বাস, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রকর্মে সেসময়ের একটি শিল্প আন্দোলন ‘আর্ট নোভুর’ ব্যাপক প্রভাব চোখে পড়ে।

সেই সঙ্গে প্রাচীন লোক শিল্পরূপের ছাপও আছে তাঁর আঁকাআঁকিতে।

‘তিনি যা করেছিলেন, তা হলো স্বাধীনতার একটি ধারণা ভারতে তার শিল্পকর্মে নিয়ে এসেছিলেন। যখন রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি জার্মানিতে লোকজনকে দেখানো হয়, তখন দর্শকরা তার কাজকে ‘সুররিয়ালিস্ট এবং এক্সপ্রেশনিস্ট’ ধারার শিল্পের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন,’ বলছিলেন অধ্যাপক সিভা কুমার।

তবে সেটা ছিল নাৎসিরা বিশুদ্ধি অভিযানের নামে তার শিল্পকর্ম সরিয়ে ফেলার আগ পর্যন্ত।

এবিএন/এসএ/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ