আজকের শিরোনাম :

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন

ভারতে নিষিদ্ধ ঘোষিত ইসলামি গোষ্ঠী পিএফআই কারা, উদ্ভব কীভাবে?

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, ২০:৫৩

ভারতের সন্ত্রাস দমন এজেন্সি এনআইএ এবং এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট কিছুদিন ধরেই বিভিন্ন রাজ্যে পিএফআইয়ের দপ্তরগুলোয় তল্লাশি অভিযান চালিয়ে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আনিস আহমেদসহ অনেক কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে।

এক বিবৃতিতে এনআইএ অভিযোগ করেছে যে ধৃতরা ‘সন্ত্রাসী কার্যকলাপ’কে সমর্থন করেন।

তবে পাল্টা বিবৃতি দিয়ে পিএফআই এই অভিযোগগুলোকে অসাড় ও চাঞ্চল্যকর বলে অস্বীকার করে।

কবে, কীভাবে গঠিত হয়েছিল পিএফআই?
গত শতাব্দীর ’৮০-এর দশকে যখন থেকে ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদের প্রসার ঘটতে শুরু করেছিল, আর এরপরে যখন ১৯৯২ সালে বাবরী মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছিল, তারপরে ‘ভারতের সরকার এবং রাজনীতির প্রতি মুসলমানদের চিন্তাভাবনায় একটা বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে শুরু করে’ বলে মন্তব্য করেছিলেন সমাজবিজ্ঞানী জাভেদ আলম।

দিল্লির জামা মসজিদের ইমাম আহমেদ বুখারীর ‘আদম সেনা’ অথবা বিহারের ‘পসমন্দা মুসলিম মহাজ’ বা মুম্বাইয়ের ‘ভারতীয় সংখ্যালঘু সুরক্ষা মহাসংঘ’ প্রভৃতি সংগঠন সেই সময়েই তৈরি হয়েছিল।

আবার কেরালায় ‘ন্যাশনাল ডেভলমেন্ট ফ্রন্ট’, তামিলনাডুর ‘মনিথা নিথি পসারাই’ আর ‘কর্নাটক ফোরাম ফর ডিগ্নিটি’র মতো সংগঠনও ভূমিষ্ঠ হয় সেই পর্যায়ে।

এই তিনটি সংগঠন ২০০৪ সাল থেকেই নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া-সমঝোতা শুরু করে।

২০০৬ সালের ২২ নভেম্বর কেরালার কোঝিকোডে এক বৈঠকে এই তিনটি সংগঠন মিশে গিয়ে ‘পপুলার ফ্রন্ট অক ইন্ডিয়া’ বা পিএফআই তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আর নতুন সংগঠনটি আনুষ্ঠানকিভাবে জন্ম নেয় ২০০৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি।

আরও কিছু সংগঠন মিশে যায় পিএফআইতে
কেরালা, তামিলনাডু আর কর্ণাটকের তিনটি সংগঠন এক ছাতার তলায় চলে আসার পরে গোয়া, রাজস্থান, অন্ধ্র প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ আর মনিপুরের পাঁচটি সংগঠনও মিশে যায় পিএফআইয়ের সঙ্গে।

পিএফআই দাবি করে যে তারা ভারতের সব চাইতে দ্রুত বেড়ে চলা ‘ক্যাডারভিত্তিক গণ-আন্দোলন’। ২৩টি রাজ্যে তাদের চার লাখ সদস্য আছে বলেও দাবি করে পিএফআই।

নিজেদের ওয়েবসাইটে পিএফআই আরও দাবি করে যে তাদের উদ্দেশ্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমতা রক্ষা করা এবং জাতীয় ঐক্য ও অখণ্ডতার জন্য কাজ করা।

তবে পিএফআইয়ের ব্যাপারে ভারত সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিটা ভিন্ন।

সংগঠনটির বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতা, অবৈধ কার্যকলাপে যুক্ত থাকা, সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়ানো এবং ভারতের অখণ্ডতার ক্ষতি করার প্রচেষ্টার অভিযোগ এনেছে নিরাপত্তা এজেন্সিগুলি। সন্ত্রাসবাদে মদত দেওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগেও এজেন্সিগুলি একের পর এক মামলা দায়ের করেছে পিএফআইয়ের বিরুদ্ধে।

সিমির সঙ্গে সম্পর্কের অভিযোগ
রাজস্থানে এক হিন্দু ধর্মাবলম্বীর হত্যার ঘটনাতেও পিএফআইয়ের নাম উঠে এসেছিল।

আবার বিহারের পাটনায় পুলিশ তল্লাশি চালিয়ে এমন কিছু নথি উদ্ধার করার দাবী করেছিল, যেখানে ২০৪৭ সালের মধ্যে ভারতে ইসলামী রাজ্য তৈরির একটা পথ-দিশা ছিল।

উদয়পুরে হিন্দু দর্জি হত্যার প্রতিবাদে ভারতের বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ, উত্তেজনা

পুলিশের উদ্ধার করা ওইসব নথিগুলো জাল বলে সেই সময়েই দাবি করেছিল পিএফআই।

পিএফআইয়ের দপ্তরগুলোয় গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বারে বারে তল্লাশি অভিযান চলেছে আর তাদের নিষিদ্ধ করা হল বুধবার, কিন্তু নিরাপত্তা এজেন্সিগুলো তাদের ওপরে নজর রাখছে সেই ২০০৭ সাল থেকেই।

পিএফআইয়ের ওপরে নজর
পপুলার ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়ার ওপরে সন্ত্রাস দমন এজেন্সি এনআইএর নজর পড়ে ২০০৮ সালে। অধ্যাপক টি জে জোসেফের ঘটনায় মনমোহন সিং সরকারের সমঢ থেকে কেন্দ্রীয় তদন্ত এজেন্সিগুলিকে যুক্ত করা হয়। কেরালার মালয়লাম ভাষার অধ্যাপক মি. জোসেফের ওপরে হামলা হয়, তার হাত কেটে দেওয়া হয়েছিল।

তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল যে তিনি ইসলামের নবীর সম্বন্ধে কটু কথা বলেছেন।

পিএফআই তৈরি হওয়ার পর থেকেই তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠতো যে আগেই নিষিদ্ধ ঘোষিত কট্টরপন্থী সংগঠন স্টুডেন্টস ইসলামিক মুভমেন্ট অফ ইন্ডিয়া বা 'সিমি'রই একটা প্রকাশ্য রূপ এই নতুন সংগঠন পিএফআই।

২০০১ সালে ভারত সরকার যেসব সংগঠনকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলে নিষিদ্ধ করে দেয়, সেই তালিকাতেই রয়েছে ‘সিমি’র নাম।

আবার ‘সিমি’র সঙ্গে আরেকটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে ঘোষিত ‘ইন্ডিয়ান মুজাহিদীনেরও যোগাযোগ আছে’ এমন দাবি করা হয়ে থাকে। ভারত সরকার ইন্ডিয়ান মুজাহিদীনকেও অবৈধ কার্যকলাপে যুক্ত থাকার অভিযোগে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে।

তবে পিএফআইয়ের সঙ্গে 'সিমি'র সম্পর্কের অভিযোগ এই জন্য আরও বেশি গ্রহণযোগ্যতা পায়, কারণ সিমির বেশ কিছু সাবেক নেতা পিএফআইতে যোগ দিয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠেন।

এমন দাবিও করা হয় যে সিমিকে নিষিদ্ধ করার কারণেই তার সদস্যরা নতুন নাম দিয়ে একটা সংগঠন তৈরি করেন। তবে সিমি নিষিদ্ধ হওয়ার প্রায় ছয় বছর পরে পিএফআইয়ের জন্ম।

পিএফআইয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য অধ্যাপক পি কোয়া অবশ্য বিবিসিকে দেওয়া এক পুরনো সাক্ষাৎকারে সিমির সঙ্গে তাদের সম্পর্কের কথা অস্বীকার করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে তিনি ‘এনডিএফ’-এর সংস্পর্শে আসেন ১৯৯৩ সালে, আর সিমির সঙ্গে তার সম্পর্ক শেষ হয়ে গিয়েছিল ১৯৮১ সালেই।

যে সংগঠনগুলো মিশে গিয়ে পিএফআই তৈরি হয়েছিল, তারই অন্যতম ছিল এনডিএফ।

পিএফআই সাংগঠনিকভাবে কতটা মজবুত?
পিএফআই যদিও তাদের সদস্য সংখ্যা নিয়ে বড় দাবী করে, তবে রাজনৈতিকভাবে তারা কেরালা আর কর্ণাটকের কিছু অংশেই সাধারণ কিছু সাংগঠনিক সাফল্য পেয়েছে।

কর্ণাটকে আগামী বছরে বিধানসভার নির্বাচন আছে। ওই রাজ্যের উপকূলবর্তী এলাকাগুলোয় পিএফআইয়ের প্রভাব এখন বাড়ছে বলে মনে করা হয়।

আবার কেরালায় রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনাগুলিতেও পুলিশ পিএফআইয়ের দিকে আঙ্গুল তুলে থাকে।

কর্ণাটকের স্কুলগুলোয় হিজাব পরার অধিকার নিয়ে যে মামলা চলছে, সেখানে সরকারি আইনজীবী আদালতেই দাবী করেছিলেন যে পিএফআই-ই ঘটনাটিকে বড় করে দেখানোর চেষ্টা করছে।

এও বলা হয়েছিল যে তারা মুসলমান নারীদের মাথায় এটা ঢুকিয়ে দিয়েছে যে হিজাব পরতেই হবে।

সেই মামলায় ক্যাম্পাস ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়া আর ন্যাশনাল উইমেন্স ফ্রন্টেরও নাম উঠে এসেছিল। পিএফআইয়ের সঙ্গে এই সংগঠন দুটিকেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অফ ইন্ডিয়া বা এসডিপিআই-কে মনে করা হয় পিএফআইয়ের রাজনৈতিক দল। তাদেরকে অবশ্য নিষিদ্ধ করেনি ভারত সরকার।

পিএফআইয়ের ঘোষিত এজেন্ডা
সংগঠনটির দাবি অনুযায়ী, এক বৈষম্যহীন সমাজ গড়া তাদের লক্ষ্য। সেই সমাজে প্রত্যেকের জন্য স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার আর নিরাপত্তা থাকবে। এই পরিবর্তন আনার জন্য তারা বর্তমান অর্থনৈতিক নীতিমালাতেও বদল আনতে চায়, যাতে তাদের সেই কাঙ্ক্ষিত সমাজে দলিত, আদিবাসী এবং সংখ্যালঘুরাও অধিকার পায়।

ভারত সরকার অবশ্য পিএফআইয়ের এইসব লক্ষ্য, উদ্দেশ্যর সঙ্গে সহমত নয়। পিএফআইয়ের বিরুদ্ধে দায়ের করা একের পর এক মামলায় দেশদ্রোহ, অবৈধ কার্যকলাপে যুক্ত থাকা, হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ঘৃণা ছড়ানো, বিদেশী অর্থায়নের মাধ্যমে ভারতের অখণ্ডতার ক্ষতিসাধন করা এবং অশান্তি ছড়ানোর অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।

এবিএন/এসএ/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ