আজকের শিরোনাম :

১০০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানির টার্গেট কতটা বাস্তবসম্মত

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৪ আগস্ট ২০২২, ১৪:২২

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ২০৩০ সাল নাগাদ পোশাক খাতে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ১০০ বিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি ডলার।

যদিও গত অর্থবছরে এ খাতের রপ্তানি ৪৩ বিলিয়ন ডলারের সামান্য বেশি। তবে উদ্যোক্তারা বলছেন গত কয়েক বছরের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার পাশাপাশি বাজার সম্প্রসারণের মধ্য দিয়েই এ লক্ষ্য অর্জন করতে চান তারা।

এখান থেকে কীভাবে ৮ বছরে একশ বিলিয়ন ডলারের টার্গেট অর্জিত হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে বিজিএমইএ সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলছেন, এ জন্য পথনকশা বা রোডম্যাপ তৈরির কাজ এখন চলছে।

আজিম বলছেন, প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও গত কয়েক বছরের প্রবৃদ্ধিই তাদের লক্ষ্য নির্ধারণে সাহসী করে তুলেছে।

তিনি বলেন, ‘এ বছর ১১ বিলিয়ন ডলার বেশি শিপমেন্ট হয়েছে, যেটা আমাদের টার্গেটের কাছাকাছি। আমরা চেষ্টা করব ১০০ বিলিয়ন ডলারের টার্গেট অর্জন করতে। সবাই ভালোভাবে কাজ করতে পারলে এটা সম্ভব। ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও এটা সম্ভব হবে। এটা অসম্ভব কোনো ব্যাপার না। গত কয়েক বছর যাবৎ এটাই হচ্ছে। এটা আমাদের শুধু ১০০ বিলিয়ন ডলারের টার্গেটের বিষয় নয়। এখানে আরও কিছু বিষয় আছে।’

এই আরও কিছু বিষয় বলতে মূলত পোশাক খাতের বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে বোঝাতে চাইছেন মালিকপক্ষ। বিশেষ করে চীন থেকে গত কয়েক বছরে অনেক ক্রয়াদেশ বাংলাদেশে এসেছে।
 
সেটিকেই এখন আরও বেশি করে পেতে চাইছেন তারা। এ জন্য চীনের কোন ধরনের কারখানাগুলো বন্ধ হচ্ছে বা কোন ধরনের পণ্যগুলো তারা উৎপাদন করতে চাইছে না তা নিয়ে গত কয়েক বছর ধরেই কাজ করছে সরকার ও বিজিএমইএ।

শহীদুল্লাহ আজিম বলছেন তিনটি আলাদা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে একটি চূড়ান্ত রোডম্যাপ তৈরির কাজ এখনো চলছে।

‘গ্লোবাল মার্কেটে এখন ম্যান মেইড ফাইবারের চাহিদা বাড়ছে। ২০০ বিলিয়ন ডলারের মার্কেট আছে। আর চায়না যেহেতু পরিবেশগত কারণে টেক্সটাইল থেকে সরে আসছে সেগুলো সঙ্গত কারণেই আমাদের দিকে আসবে। তবে জ্বালানি বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ না থাকলে কিছুটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।’

৫০ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্য অর্জিত হয়নি
এর আগে ২০১৫ সালেও বিজিএমইএ স্বাধীনতার ৫০ বছর অর্থাৎ ২০২১ সাল থেকে লক্ষ্য করে ৫০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি টার্গেট ঘোষণা করেছিল। যদিও রপ্তানি হয়েছে এর চেয়ে ৭ বিলিয়ন ডলারের কম।

অন্যদিকে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সর্বশেষ হিসেবে ২০২০ সালে বিশ্ববাজারে রপ্তানি হওয়া পোশাকের মাত্র ৬ দশমিক ২৬ শতাংশ বাংলাদেশের।

যদিও দীর্ঘদিন ধরেই পোশাক খাতে পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ ও নতুন নতুন বাজার খোজার ওপর জোর দেয়া হচ্ছিল। তবে এর বাইরেও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ পোশাক খাতকে মোকাবেলা করতে হবে বলে বলছেন অর্থনীতিবিদ ফাহমিদা খাতুন।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হবে। তখন আর আমরা ইউরোপসহ নানা বাজারে কোটা মুক্ত সুবিধা পাবো না। একইসাথে কমপ্লায়েন্স ইস্যু আরও শক্তভাবে সামনে আসবে। একই সাথে প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির পাশাপাশি মানবসম্পদের দক্ষতা বাড়াতে হবে।

বিজিএমইএ বলছে উৎপাদনশীলতা ৬০ ভাগ বাড়িয়ে ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বের সব দেশেই বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি করতে চায় তারা। কিন্তু চীন, ভিয়েতনাম ও তুরস্কের মতো প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে এটি কতটা সম্ভব হবে সে প্রশ্নও আছে।

এ ছাড়া দেশের রাস্তাঘাট, বন্দর, পরিবহন ও জ্বালানীর ওপরেও লক্ষ্য অর্জনের বিষয়টি অনেকাংশে নির্ভর করবে। এর বাইরে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার বিষয়টিও উদ্যোক্তাদের মাথায় রাখতেই হবে বলে বলছেন ফাহমিদা খাতুন।

তিনি বলেন, ‘উচ্চমূল্যের পণ্যগুলো এখনো আমরা করতে পারছি না, যেগুলো চীন ও ভিয়েতনাম করে থাকে। এগুলো করতে না পারলে লাভের মার্জিন বাড়বে না। আর বাজার বহুমুখীকরণ করতেই হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নতুন জিএসপি সুবিধার ক্ষেত্রে কমপ্লায়েন্স বিষয়টি সামনে আসবে। তাই নতুন নতুন বাজার খুঁজতে হবে। আর দেশের ভেতরের চ্যালেঞ্জগুলোও মোকাবেলা করতে হবে।’

কর্মসংস্থান বাড়বে নাকি কমবে?
২০৩০ সালকে সামনে রেখে আরও যেসব টার্গেট ঘোষণা করেছে বিজিএমইএ তার মধ্যে আছে অন্তত ৮০ ভাগ কারখানাকে পরিবেশবান্ধব করা, গ্যাস বিদ্যুৎ ব্যবহার ৩০ ভাগ কমিয়ে আনা, ক্ষতিকর রাসায়নিক শতভাগ কমিয়ে আনা ও কর্মসংস্থান ৬০ লাখে উন্নীত করা। যদিও প্রযুক্তি ব্যবহার বাড়িয়ে অর্থাৎ অটোমেশনের দিকেই ঝুঁকে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েছে বহু কারখানা। সেক্ষেত্রে কর্মসংস্থান না বেড়ে বরং কমে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে অনেকের মধ্যে।

গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার বলছেন, শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে মালিকরা আরও আন্তরিক হয়ে কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে এ খাতকে ঝুঁকির মধ্যেই থাকতে হবে।

‘এখন যে অবকাঠামো এবং অটোমেশনের যে অবস্থা তাতে করে নতুন টার্গেট অর্জনের জন্য শ্রমিকের ওপরই অতিরিক্ত চাপ পড়বে। কোনভাবে এ টার্গেটে যেতে হলে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, খাদ্য ও বাসস্থানের নিশ্চয়তা ছাড়া সেটি সম্ভব হবে না। মজুরি বৃদ্ধি করে তার চাহিদা পূরণের মাধ্যমেই ২০৩০ সালের টার্গেট অর্জনের জন্য তাদের প্রস্তুত করা সম্ভব হবে।’

যদিও পোশাক খাতের মালিকদের দাবি বাংলাদেশেই এখন সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পরিবেশবান্ধব কারখানা কাজ করছে। বিশেষ করে ২০১২ সালের নভেম্বরে তাজরীন ফ্যাশনসে আগুনে শতাধিক শ্রমিকের মৃত্যু ও ২০১৩ সালের এপ্রিলে ঢাকার কাছে সাভারে রানা প্লাজা ধ্বসের ঘটনায় এক হাজারের বেশি শ্রমিকের মৃত্যুর পর বেশ কয়েক বছর ধরে পোশাক কারখানাগুলোর কর্মপরিবেশ নিয়ে কাজ করেছে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের মতো বিদেশি ক্রেতাদের জোটগুলো।

দরকার মিড ম্যানেজমেন্ট দক্ষতা
অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদ বলছেন, শ্রমিকের দক্ষতা, প্রযুক্তির উন্নয়ন, নতুন বাজার খুঁজে পাওয়ার সাথে দরকার হবে কারখানাগুলোর মিড ম্যানেজমেন্টের দক্ষতা।

‘হাই অ্যান্ড প্রোডাক্টে যেতে হবে। এ জন্য দরকার হবে দক্ষ শ্রমিক। যতই মেশিনারিজের দিকে যাব ততই মেশিন মানুষের কাজ নিয়ে নেবে। তাই সেক্টর বড় না হলে অনেকে কর্মহীন হবে। এ কারণে প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বাজার ধরতে পারলে রপ্তানি বাড়বে। তখন কর্মসংস্থান কমানোর দরকার হবে না।’

তবে পোশাক খাতের প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর ক্ষেত্রে প্রথমেই যে সংকটের কথা এতদিন আলোচনায় আসতো তা হলো আনুষঙ্গিক পণ্য। যেমন শুধু কার্টন ও বোতামের সংকটের কারণেই নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত নিয়মিত বাতিল হতো বিদেশি অর্ডার।

একটি রপ্তানিযোগ্য পোশাক তৈরি করতে ৩০টিরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ আনুষঙ্গিক পণ্য, যেমন পলি ব্যাগ, হ্যাঙ্গার, জিপার, বোতাম, কার্টন, হ্যান্ড ট্যাগ, প্রাইস ট্যাগ ও প্রিন্টেড লেবেলসহ প্যাকেজিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ দরকার হয়।

তবে এখন উদ্যোক্তারা বলছেন গত দুই দশকে আনুষঙ্গিক পণ্যের সংকট কাটিয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। যদিও কিছু বিশেষায়িত পণ্যের ঘাটতি রয়েই গেছে।

আনুষঙ্গিক পণ্যের চাহিদা পূরণে আরও নীতি সহায়তা দরকার বলে বলছেন গার্মেন্টস অ্যাকসেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন মতি।

“গার্মেন্টসে একশ বিলিয়ন ডলারের টার্গেট অর্জনে সাপোর্ট দেয়ার মতো অবস্থা আমাদের এক্সেসরিজ খাতের এখন নেই। তবে সরকার যদি আগামী দু বছরের মধ্যে নীতি সহায়তা দেয় তাহলে এটা সম্ভব হবে। এখন টোটাল এক্সেসরিজ পন্য ৩০-৩২ টা। এর মধ্যে ১০-১২টা এখন আমরা রপ্তানি করি। ২০০০ সালের পর থেকে আমরা পোশাক খাতকে লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করছি। কিন্তু একশ বিলিয়ন ডলারের টার্গেটের জন্য দরকারি অবকাঠামো ও উৎপাদন দক্ষতা আমাদের এখন নেই।’

কীভাবে পাল্টাচ্ছে কারখানাগুলো
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের মালিকরা বলছেন ১৯৭৯ সালে নুরুল কাদেরের হাত ধরে যাত্রা শুরুর পর গত চার দশকে এ খাতের প্রবৃদ্ধি ও সক্ষমতা অনেক গুণ বেড়েছে।

তবে একই ধরনের ব্যবসায়িক মডেলে দীর্ঘকাল ধরে অগ্রগতি অব্যাহত রাখা অসম্ভব বলে অনেক দিন ধরেই এ খাত নিয়ে গবেষণা বাড়ানোর তাগিদ আসছিল।

আবার বাংলাদেশে একই কারখানা একই ক্রেতার কাছ থেকে বারবার ক্রয়াদেশ পাওয়ার প্রবণতা বেশি। কিন্তু এটিকে কাজে লাগিয়ে দরকষাকষির ক্ষেত্রে খুব একটা সুবিধা করতে পারছে না বাংলাদেশের কারখানাগুলো।

আবার প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যম পর্যায়ের ব্যবস্থাপনার জন্য পর্যাপ্ত দক্ষ জনবল এখনো তৈরি করা যায়নি, যেটি ১০০ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্য অর্জনে বড় সমস্যা তৈরি করবে বলেও মনে করেন অনেকে।

যদিও রপ্তানিমুখী একটি প্রতিষ্ঠান স্নোটেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম খালেদ হোসেন বলছেন, চীন ও ভিয়েতনামের ভালো কারখানাগুলো পরিদর্শন করে সে অনুযায়ী কারখানা পুনর্বিন্যাস ও ব্যবস্থাপনার কাজ বাংলাদেশ শুরু হয়েছে কয়েক বছর আগেই। একই সঙ্গে দৃষ্টি দেয়া হয়েছে ব্যবস্থাপনা খাতেও।

‘ওখান থেকেই ভালো বিষয়গুলো আমাদের কারখানাগুলোতে কার্যকর করেছি। সামনে আবার ভিয়েতনামের কারখানা দেখতে যাবো। প্রতিনিয়ত আমরা আমাদের বেস্ট প্রাকটিসটাই বিনিয়োগ, যন্ত্রপাতি, মজুরি ও প্রযুক্তিতে করা হচ্ছে। গত দুই বছরে পাঁচশর বেশি ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি নিয়োগ দিয়েছি। এখন উচ্চশিক্ষিত জনবল অনেক বেশি যা দক্ষ ব্যবস্থাপনা সিস্টেম গড়ে তুলতে সহায়তা করছে।’

তিনি বলছেন, পরিকল্পনাগুলো ঠিকঠাক বাস্তবায়ন করতে পারলে তিনিসহ অসংখ্য উদ্যোক্তা তাদের কারখানা বহুগুণে সম্প্রসারণে সক্ষম হবেন বলে আশা করছেন।

উদ্যোক্তারা বলছেন এখন ইউরোপের দেশগুলো সারা বছর যে পরিমাণ টি-শার্ট বা গেঞ্জি কেনে, তার প্রায় ৪০ শতাংশই বাংলাদেশি কারখানা সরবরাহ করে। কেবল টি-শার্ট নয়, ট্রাউজার, শর্টস, প্যান্ট ও পুরুষ বা বাচ্চাদের শার্ট রপ্তানিতে ইউরোপে সবার ওপরেই বাংলাদেশ।

এ ছাড়া ডেনিম রপ্তানিতে ইউরোপের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রেও শীর্ষস্থানে রয়েছেন বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা।

এ ধারা অব্যাহত রেখে নতুন নতুন বাজার তৈরি এবং পণ্যের দাম বাড়াতে দরকষাকষিতে সাফল্য পেলে ১০০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির লক্ষ্য অর্জন কঠিন হবে না বলেই মনে করছেন উদ্যোক্তারা।

এবিএন/এসএ/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ