আজকের শিরোনাম :

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন

তাইওয়ানকে ঘিরে মহড়া দিয়ে কী বার্তা দিচ্ছে চীন?

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১০ আগস্ট ২০২২, ১১:১০

চীনের সঙ্গে তাইওয়ানের সম্পর্কে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে মার্কিন রাজনীতিক ন্যান্সি পেলোসি স্বশাসিত এই দেশটি সফরে যাওয়ার পর। চীন দাবি করে তাইওয়ান তাদের দেশেরই অংশ, এবং ন্যান্সি পেলোসির এই সফর তাদের এতটাই ক্ষুব্ধ করেছে যে, তারা তাইওয়ানের চারিদিকের সমুদ্রে এক বিরাট সামরিক মহড়া চালিয়েছে, তাইওয়ানের সীমানার ওপর দিয়ে ক্ষেপণাস্ত্র এবং তাজা গোলা বর্ষণ করেছে।

তাইওয়ান সংকটকে ঘিরে চীনের এই বিশাল সামরিক মহড়ার তাৎপর্য বিশ্লেষণ করেছেন বিবিসির দুজন সংবাদদাতা:

‘এক নতুন স্বাভাবিক অবস্থা’
ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফর তাদেরকে যে অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির উপরের স্তরের কট্টরপন্থীরা হয়তো সেটা নিয়ে খুশি। ন্যান্সি পেলোসি তাদের জন্য যেন একটা সুযোগ খুলে দিয়েছেন, এবং তারা সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছেন।

এখন তাইওয়ানকে ঘিরে একের পর এক চরম সামরিক ব্যবস্থা যেন একটা 'গ্রহণযোগ্য' বাস্তবতা তৈরি করেছে।

চীন এখন যেসব সামরিক ব্যবস্থা নিচ্ছে, তার মধ্যে তাইওয়ানের ওপর দিয়ে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের মতো ঘটনাও আছে। এগুলো গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার কারণ এই নয় যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এগুলো মেনে নিচ্ছে। এই গ্রহণযোগ্যতার কারণ- এগুলো ঘটছেই এবং এরকম ব্যবস্থা নিয়ে বেইজিং পার পেয়ে যাচ্ছে।

চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) যতবার তাদের যুদ্ধ বিমান তাইওয়ান প্রণালীর ওপর দিয়ে দেশটির আরও কাছাকাছি জায়গা দিয়ে বা আরও বেশি সংখ্যায় ওড়াচ্ছে, সেটাই একটা নতুন সীমা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

চীন কোন একদিন জোর করে তাইওয়ান দখল করে নেয়ার জন্য দ্বীপটির ওপর আক্রমণ চালাতে পারে, অনেক বেশি চীনা নাগরিক এখন এরকম সম্ভাবনা দেখছে।

যারা চায় এরকমটা ঘটুক, এটাকে তাদের জন্য এক বিজয় বলেই দেখতে হবে।

চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই-র ভাষায় তাইওয়ানকে ‘মাতৃভূমিতে ফিরিয়ে আনতে’ আর যেসব শান্তিপূর্ণ উপায়ের কথা এতদিন ভাবা হচ্ছিল, সেগুলো কিন্তু এখন আর সেভাবে আলোচিত হচ্ছে না, বিস্তারিতভাবে তো নয়ই।

পিপলস লিবারেশন আর্মির এই ব্যাপক সামরিক মহড়া এবং গোলাগুলির প্রদর্শনী কিন্তু বিশ্বজুড়ে এই বিশ্বাসটা আরও দৃঢ় করেছে যে, চীনের সামরিক উত্থানকে আর থামানো যাবে না। এতে করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনের কিছু প্রতিবেশী দেশ ভীত হয়ে পড়বে, কারণ দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে চীনের সঙ্গে তাদের সীমানা বিরোধ আছে।

এ ধরনের বিরাট সামরিক মহড়ার জন্য অনেক দীর্ঘ প্রস্তুতির দরকার হয়। ন্যান্সি পেলোসি তাইওয়ান সফরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন- এই খবর ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর চীনের জেনারেলরা হঠাৎ করে এরকম বিশাল এক সামরিক মহড়ার আয়োজন করে ফেলেছেন- এটা বিশ্বাস করা কঠিন।

বরং এরকম সম্ভাবনাই বেশি বলে মনে হচ্ছে যে, চীন এরকম একটি মহড়ার প্রস্তুতি অনেকদিন ধরেই নিচ্ছিল, এবং যখনই তারা একটা সুযোগ পেয়েছে, সেটাকে ব্যবহার করেছে এই মহড়া দেয়ার জন্য।

গত সপ্তাহে বেইজিং এর রাস্তায় যখন এক জাতীয়তাবাদী লোকের সাক্ষাৎকার নেয়া হচ্ছিল, তখন তিনি তো হাসিমুখে বলেই ফেললেন, ‘ধন্যবাদ কমরেড পেলোসি!’

তবে চীনা সরকার যদি এখন নিজেদের বাগাড়ম্বরপূর্ণ হুংকারের পর এমনটা ভাবতে শুরু করে যে তাইওয়ান দখল করে নেয়া খুব সহজ, এই কাজটা করতে সেরকম কোন কঠিন, রক্তাক্ত এবং বিপর্যয়কর সংঘাতের দরকার হবে না, সেটা কিন্তু খুব বিপদজনক হবে। কোন কোন বিশ্লেষকের ধারণা, চীনের এই যুদ্ধ মহড়া আসলে তাইওয়ান সরকার এবং যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীকে চীনের হামলা মোকাবেলায় প্রতিরক্ষা কৌশল তৈরিতে সহায়তা করবে।

কিন্তু প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর সরকার তো এই সামরিক মহড়ার মধ্যেই আটকে থাকছে না। শুক্রবার রাতে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষণা করেছে যে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অনেক ধরনের সহযোগিতা বন্ধ করে দিচ্ছে। মাদক চালানের মতো আন্ত-সীমান্ত অপরাধ, সমুদ্র পথের নিরাপত্তা থেকে শুরু করে উচ্চ পর্যায়ের চীন-মার্কিন সামরিক সংলাপ- সবকিছুই স্থগিত করা হয়েছে।

মার্কিন গণমাধ্যমে এরকম খবরও বেরিয়েছিল যে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন এবং সশস্ত্র বাহিনীর জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ জেনারেল মার্ক মাইলির ফোন কল ধরেনি চীনারা।

আরও গুরুতর ব্যাপার হচ্ছে, চীন এখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবেলায় সহযোগিতাও বন্ধ করে দিয়েছে। এর মানে হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে দূষণকারী দুটি দেশ এখন আর এই ইস্যুতে কোন কথাবার্তা বলছে না।

ন্যান্সি পেলোসির সফর দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা যে বাড়িয়েছে সন্দেহ নেই, কিন্তু মনে হচ্ছে পরিস্থিতি যে এদিকে গড়িয়েছে, সেটা শি জিনপিং-এর সরকারের ভালোই লাগছে, অন্তত আপাতত।

তাইওয়ানকে ঘিরে গত কদিন ধরে যে সামরিক মহড়া আর গোলাগুলি চলছে, সবার মনোযোগ ছিল সেদিকে। কিন্তু এই মহড়ার পাশাপাশি বেইজিং থেকে যে ধরনের কথাবার্তা আর হুংকার শোনা গেছে, সেগুলোও কিন্তু কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই, তাইওয়ানের একদল রাজনীতিকের প্রতি ইঙ্গিত করে তাদেরকে 'তাইওয়ানের বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি' বলে তকমা দিয়েছেন। এই তালিকার শীর্ষে আছেন তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েন। কড়া ভর্ৎসনার জন্য তাকেই যেন বিশেষভাবে বেছে নেয়া হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং তাকে ‘চীনা জাতির বংশধর হওয়ার অনুপযুক্ত’ বলে বর্ণনা করেন, যার আরেক অর্থ ‘বিশ্বাসঘাতক।’

এর উদ্দেশ্য তাইওয়ানের জনগণের বিরাট অংশকে যেন, বেইজিং এর ভাষায়, সেই ‘ক্ষুদ্র চক্র’ থেকে আলাদা করে ফেলা যায়, যারা নাকি তাইওয়ানকে মাতৃভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে চাইছে।

বেইজিং-এর জন্য মুশকিলটা হচ্ছে, যে ধরনের তাইওয়ানের চিত্র তারা তুলে ধরছে, বাস্তবতার সঙ্গে তার বিরাট ফারাক। সাম্প্রতিক জরিপগুলোতে দেখা যাচ্ছে, তাইওয়ানের মানুষের একটা সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ চীনের সঙ্গে কোন ধরনের একত্রীকরণের বিরুদ্ধে।

তাইওয়ানের জনগণের বিরাট অংশ, যাদের সংখ্যা এখন বাড়ছে, নিজেদেরকে ‘তাইওয়ানিজ’ বলে ভাবে, ‘চীনা’ নয়।

তবে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই মনে করেন, এর কারণ তাইওয়ানের সাই ইং-ওয়েনের সরকার সেখানে এক ধরনের 'বি-চীনাকরণের' নীতি নিয়েছে, তারা ‘দুই চীন’ অথবা ‘এক চীন, এক তাইওয়ান’ প্রতিষ্ঠার জোর চেষ্টা চালাচ্ছে।

এ কারণেই ফ্রান্সে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূতকে বলতে শোনা গেছে, তাইওয়ান যখন চীনের সঙ্গে এক হয়ে যাবে, তখন তাইওয়ানিজদের ‘নতুন করে শিক্ষিত’ করার দরকার হবে। তার মতে, তাইওয়ানের মানুষের মগজ ধোলাই করে বোঝানো হয়েছে, তারা চীনা নয়।

এটাও কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি থেকে একেবারে ভিন্ন। তাইওয়ান একটি মুক্ত সমাজ, যেখানে লোকজন তাদের ইচ্ছেমত পড়তে পারে, যা খুশি চিন্তা করতে পারে এবং যাকে খুশি ভোট দিতে পারে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে- যা ঘটছে তার পরিণাম কী দাঁড়াবে?
বেইজিংয়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে, ২০২৪ সালের পরবর্তী নির্বাচনে তাইওয়ানের মানুষ যেন প্রেসিডেন্ট সাই এর দলকে ভোট না দেয়, সেজন্যে তাদের ভয় দেখানো। বেইজিং চায়, তাদের প্রতি অনেক বেশি বন্ধু-ভাবাপন্ন বলে পরিচিত কেএমটি (কুওমিনটাং) যেন ক্ষমতায় ফিরে আসে।

তাইওয়ানের ব্যবসায়ীদেরকে চীন সরাসরি হুমকিও দিচ্ছে, যাদের অনেকের বড় বিনিয়োগ রয়েছে চীনের মূল ভূখণ্ডে। তাদের বলা হচ্ছে, তাদের ‘সঠিক পক্ষকে’ বেছে নিতে হবে।

বেইজিং এ রকম কৌশল আগেও ব্যবহারের চেষ্টা করেছে, তবে সে রকম সাফল্য পায়নি। বেইজিং এর নিষেধাজ্ঞার ফলে তাইওয়ানের অনেক ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, বিশেষ করে ফল ব্যবসায়ীরা। পর্যটন শিল্প এরই মধ্যে ক্ষতির শিকার হয়েছে, কারণ মূল ভূখণ্ড থেকে পর্যটকদের তাইওয়ানে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে চীন।

কিন্তু গত কয়েকদিনে যেসব প্রমাণ পাওয়া গেছে, তাতে মনে হচ্ছে, বেইজিং-এর প্রতি তাইওয়ানের মনোভাব আরও কঠোর হতে যাচ্ছে।

এবিএন/এসএ/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ