রিজার্ভ নিয়ে কতটা সংকটে বাংলাদেশ, পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে?
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ২৩ জুলাই ২০২২, ১৩:০৫
বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বিপজ্জনক মাত্রায় চলে গেছে বলে মনে করছেন অনেক অর্থনীতিবিদ। তারা বলছেন, এখন রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসায় তা দিয়ে তিন মাসের বেশি আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব নয়।
তবে সরকার এই পরিস্থিতিকে এখনো আশঙ্কাজনক মনে করছে না। যদিও রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে বিদ্যুতের লোডশেডিং করাসহ সাশ্রয়ী বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে যাতে জ্বলানি আমদানির খরচ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় দুই বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো ৪০ বিলিয়ন বা ৪ হাজার কোটি ডলারের নিচে নেমে এসেছে।
এক বছর আগেই অর্থাৎ গত বছরের জুলাই মাসেই সব রেকর্ড ভেঙে ৪৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি রিজার্ভ হয়েছিল।
রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহের তুলনায় আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় কয়েক মাস ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলারের মজুদে চাপ বাড়ছিল।
সর্বশেষ কয়েকদিন আগে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নকে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলারের আমদানি দায় শোধ করতে হয়েছে ও সে কারণে রিজার্ভ কমেছে।
বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, নেপাল, মিয়ানমার, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ-এই ৯টি দেশ এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন বা আকুর সদস্য। এই দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ যে সব পণ্য আমদানি করে তার বিল দুই মাস পর পর এই আকুর মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেয়া তথ্যে এখন রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩৯ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলারে। এই পরিমাণ নিয়েও বিতর্ক রয়েছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এই পরিমাণ আরও কম। অন্যতম একজন অর্থনীতিবিদ এবং বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির বোর্ড অব ট্রাস্টির সদস্য ড. দেবপ্রিয় ভট্টচার্য বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে রিজার্ভের পরিমাণ যা বলা হচ্ছে, সেটাও দেশের অর্থনীতির জন্য বিপদ সংকেত।
‘এ মুহূর্তে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার যে মজুদ আছে, তা তিন মাসের আমদানি মূল্যেরও কম হয়ে যায়। নিঃসন্দেহে অর্থনীতির জন্য এই পরিমাণ মজুদ একটা বিপদ সংকেত দেয়।’
কী পরিস্থিতি দাঁড়াতে পারে?
এখনই বিপদের ঝুঁকিতে পড়ছে, এমন কয়েকটি খাতও উল্লেখ করেন ড. ভট্টাচার্য। তিনি মনে করেন, রিজার্ভ কমে যাওয়ায় প্রয়োজন বা চাহিদা অনুযায়ী পণ্য আমদানি প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ছে। একই সঙ্গে এটি টাকার বিনিময় মূল্যকেও দূর্বল করে দিচ্ছে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি হবে। ড: ভট্টাচার্য এটা-ও উল্লেখ করেন যে, এখনকার পরিস্থিতিতে রপ্তানি বাড়ানো এবং প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানোর উৎসাহ বাড়াতে কিছুটা সুযোগ সৃষ্টি করবে। কিন্তু তার ধারণা, সামগ্রিক বিচারে এটি নিঃসন্দেহে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা দূর্বল করবে। এ ছাড়া বাংলাদেশে চলমান উন্নয়নের ধারাকেও শ্লথ করে দেয়ার আশঙ্কা থাকে। ইতিমধ্যেই নানামুখী প্রভাব পড়ছে আমদানির ক্ষেত্রে। সরকার বিলাসবহুল পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করছে। তবে কয়েকমাস ধরে ডলার সংকটের কারণে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতেও সমস্যায় পড়ছেন আমদানিকারকরা। এমনকি বেসরকারি খাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি এবং সরকারিভাবে বিপিসির জ্বালানি তেল আমদানিতেও অনেক ব্যাংক ঋণপত্র বা এলসি খুলছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। বন্দরনগরী চট্টগ্রাম থেকে সেখানকার অন্যতম একজন আমদানিকারক ড. মুণাল মাহমুদ বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে না পারলে বাজারে অস্থিরতা কমবে না। ‘আমদানি খাতে চাপ তৈরি হয়েছে এবং এর ফলে সবকিছুর দাম বাড়তি থাকবে।’ ড: মুণাল মাহমুদ তার অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, ‘আগে আমদানির এলসি খুলতে সমস্যা হতো না। এখন অনেক পণ্য আমদানির শুল্ক শতভাগ করে দিয়ে এলসি নিরুৎসাহিত করছে। ফলে শতভাগ শুল্ক দিয়ে কোন পণ্য আনা সম্ভব নয়। প্রয়োজনীয় পন্যের ব্যাপারেও এখন ব্যাংকগুলো এলসি খুলছে না।’ ‘জীবনযাত্রার ব্যয় অসহনীয়’
ফলে কয়েক মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে এবং এখন মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ। ডলার সংকট এবং মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তে পারে বলে অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন। সরকার কী বলছে
তবে এখন ডলারের রিজার্ভ যা আছে, তাতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই বলে মন্তব্য করেছেন অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এখনকার রিজার্ভ নিয়ে অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর রিজার্ভ থাকলে সেটা কোনো বিপদ সংকেত দেয় না। ‘আমাদের কাছে এখন যে রিজার্ভ আছে, সেটা তিন মাসেরও বেশি আমদানি ব্যয় মেটাতে পারবে। এখন আমরা বিলাসী সব পণ্য আমদানির শুল্ক বাড়িয়েছি। আশা করি, তার সুফল আমরা পাব।’ দেশে বছরে আমদানি ব্যয় ৮০ বিলিয়ন বা ৮ হাজার কোটি ডলার। গত অর্থ বছর গার্মেন্টস খাতে রপ্তানি আগের সব বছরের রেকর্ড ভেঙেছে। এরপরও রপ্তানি হয়েছে ৪৫ বিলিয়ন বা সাড়ে চার হাজার কোটি ডলার। আমদানি খরচ আরো বেশি হওয়ায় ঘাটতি ছিল সাড়ে ৩ হাজার কোটি ডলার। আমদানি ও রপ্তানির ঘাটতি মেটানো হয় প্রবাসী শ্রমিকের পাঠানো রেমিট্যান্স দিয়ে। করোনাভাইরাস মহামারীর দুই বছরে রেমিট্যান্স এসেছে রেকর্ড পরিমাণ। কিন্তু কয়েকমাস ধরে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমছে। বাংলাদেশে ব্যাংক তেমন গুরুত্ব না দিলেও সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান রিজার্ভের ওপর চাপের কথা স্বীকার করেন। তবে তিনি বলেন, চাপ থাকলেও পরিস্থিতি সহনীয় পর্যায়ে আছে বলে সরকার মনে করছে। ‘চাপ তো অস্বীকার করার কোনো বিষয় নেই। তবে চাপেরতো মাত্রা আছে। আমরা মনে করি, সহনীয় পর্যায়ে আছে।’ এই বক্তব্যের সমর্থনে যুক্তি দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নে সর্বশেষ আমদানির যে পেমেন্ট, সেটা দেয়া হয়েছে। আগামী তিন মাস কোন দায় বা পেমেন্ট নেই। এ ছাড়া আমাদের রেমিট্যান্সও বাড়বে আশা করছি এবং এখন রপ্তানি খুবই ভালো আছে। তাছাড়া আমরা কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি, আমরা ব্যয় সংকোচন করছি। ফলে আমরা সাসটেইন করব," বলেন মন্ত্রী মান্নান। শিল্প মালিক এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে। তবে তারা মনে করেন, সরকার সতর্ককতামূলক যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তাতে সঙ্কট সামলানো সম্ভব হতে পারে। ব্যবসায়ীদের প্রধান সংগঠন এফবিসিসিআই এর একজন পরিচালক হাসিনা নেওয়াজ বলছিলেন, ‘আমরা ব্যবসায়ীরা সত্যিই শঙ্কিত হচ্ছি। শঙ্কার কারণ হলো, আমরা ১২ ঘণ্টা একটা কারখানা চালাই, সেখানে যখন বিদ্যুতের ঘাটতি হবে, উৎপাদনের ক্ষতি হবে তার মানে এই নয় যে আমরা হতাশ হচ্ছি।’ শঙ্কা থাকলেও হতাশ না হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হাসিনা নেওয়াজ বলেন, ‘আমাদের যে পদক্ষেপগুলো নেয়া হচ্ছে বিদ্যুৎ বা ডলারের ব্যাপারে, সেগুলোর সাথে অ্যাডজাস্ট করে আমরা ব্যবসায়ীরা ঠিকই টিকে যাব। সেজন্য আমাদের হতাশ হওয়ার কিছু নেই।’ জ্বালানি ও বিদ্যুতের ওপর সরাসরি প্রভাব রিজার্ভ ধরে রাখতে আমদানিসহ সামগ্রিকভাবে ব্যয় কমানোর জন্য সরকার সাশ্রয়ী যেসব ব্যবস্থা নিয়েছে, তার বড় প্রভাব পড়েছে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে। আন্তর্জাতিক বাজারে চড়া দামের কারণে ডিজেলসহ জ্বালানি তেল এবং তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি আমদানি বন্ধ রাখা হয়েছে। গ্যাস এবং ডিজেল ভিত্তিক সব বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রেখে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে সারাদেশে লোডশেডিং করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতির উন্নতির জন্য সরকার এখন শীত আসার অপেক্ষার কথা বলছে। ‘এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার’ নামের একটি সাময়িকীর সম্পাদক মোল্লা আমজাদ হোসেন বলেন, জ্বালানি খাত আমদানি নির্ভর হওয়ায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। ‘জ্বালানি খাত নিয়ে আমরা যা ভাবছি, পরিস্থিতি তার চেয়েও ভয়াবহ।’ আমজাদ হোসেন বলেন, ২০১৭ সালে যেখানে জ্বালানি আমদানির খরচ ছিল মোট আমদানির ২২শতাংশ গত বছর তা ৪৮ শতাংশ হয়েছে। এখন যে বিদ্যুৎ সংকট, আমার ধারণা, এটা আরও বাড়বে। যদি আন্তর্জাতিক বাজারে তেল এবং গ্যাসের দাম না কমে তাহলে সঙ্কট বাড়বে।’ তিনি বলেন, একদিকে বিশ্ববাজার চড়া অন্যদিকে ডলার সঙ্কটের কারণে তেল এবং গ্যাস আমদানি করা যাচ্ছে না। এখন বিদ্যুতে সাশ্রয় করা না হলে বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের দাম অনেক বাড়াতে হবে এবং সরকারের ভর্তুকি তুলে নিতে হবে। যেটা সরকার এখন চাইছে না। ফলে সরকার মনে করছে লোডশেডিং করে আড়াই থেকে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা যাবে। তাতে দাম বাড়াতে হবে না।’ সাশ্রয়ী কর্মসূচির পাশাপাশি সরকারকে বৈদেশিক এবং দেশের ভেতর থেকে ঋণ নিতে হবে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন। অর্থ সহায়তার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের উচ্চপর্যায়ে একটি দল এখন ঢাকায় আলোচনা করছে। এখনকার পরিস্থিতিতে আইএমএফ এর সঙ্গে আলোচনাকে ইতিবাচক হিসাবে দেখেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। ‘এ মুহূর্তে সরকার আইএমএফের সঙ্গে যে আলোচনা শুরু করেছে, আমি এটাকে সঠিক মনে করি।’ ড: ভট্টাচার্যের বক্তব্য হচ্ছে, ‘শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা থেকে যদি দেখি, একটু আগে থেকে আইএমএফ থেকে বৈদেশিক লেনদন কাঠামোটা ঠিক করা গুরুত্বপূর্ণ। দুর্যোগ বেশি ঘনীভূত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করা ঠিক নয়।’ তিনি বলেন, ‘যেহেতু সরকার সঠিক সময়ে এই আলোচনা শুরু করেছে, তাই সাড়ে বিলিয়ন বা ন্যূনতম দুই বিলিয়ন হোক, যে পরিমাণ অর্থ আনতে পারবে, সেটা অর্থের দিক থেকে যতটা না গুরুত্বপূর্ণ হবে, তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হবে আমাদের বৈদেশিক সহযোগীদের একটা সঙ্কেত দেয়ার ক্ষেত্রে। বিদেশি সহযোগীদের প্রতি এই সংকেতের অর্থ হচ্ছে, আমরা শৃঙ্খলার মধ্যে আছি।’ আইএমএফের কাছে কেন কিছু ঋণ সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ?
আইএমএফের কাছ থেকে এ মুহূর্তে ঋণ সহায়তা চাওয়ার বিষয়ে দেশে নানা রকম আলোচনা চলছে। তবে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, চলতি অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নে আইএমএফের কাছে কিছু ঋণ সহায়তা চাওয়া হয়েছে। এ নিয়ে তিনি আতঙ্কের কিছু দেখেন না। এই অর্থ সহায়তা চাওয়ার পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে মন্ত্রী মান্নান বলেন, ‘আইএমএফের কাছে আমরা এই প্রথম চাইনি। ’৯০ দশকেও ঋণ নিয়ে কাঠামোগত সংস্কার আমরা করেছিলাম, তখন অন্য সরকার ক্ষমতায় ছিল। আমরা আইএমএফের সদস্য। এটা আমাদের অধিকার। এর মধ্যেতো আমি ভয়ভীতির কোন কিছু দেখছি না।’ একদিকে অর্থসহায়তার প্রশ্নে আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে আলোচনা এবং অন্যদিকে ব্যয় কমানোর সতর্কতামূলক বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে পরিস্থিতি বেশি খারাপ হবে না বলে সরকার মনে করছে। সাময়িক সমস্যা মনে করছেন না বিশ্লেষকরা
কিন্তু অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের বক্তব্য হচ্ছে, এখন সমস্যাকে মৌসুমি সমস্যা হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। ‘যে সমস্যা হচ্ছে, এটা মৌসুমি কোনো সমস্যা না। এটা অর্থনীতির কাঠামোগত সমস্যা।’ তিনি বলেন, ‘মৌসুমি সমস্যা হলে আমরা চলমান একটা পদক্ষেপ নিয়ে কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করি এবং সুসময় আবার আসার জন্য অপেক্ষা করি। কিন্তু এখানে সমস্যা হচ্ছে, বড় ধরনের বাণিজ্য ঘাটতি। এ ছাড়া রেমিট্যান্স কম আসছে।’ ড: ভট্টাচার্য মনে করেন, এই কাঠামোগত সমস্যা এমন একটা সময়ে এসেছে, যখন শুধু আন্তর্জাতিক বাজার বা ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপার না। এটি বাংলাদেশের অর্থনীতির অভ্যন্তরীন কাঠামোগত সমস্যা এবং এর ভেতরে বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের দায় দেনা পরিশোধের বিষয়ও আসবে। এবিএন/এসএ/জসিম
এখনই বিপদের ঝুঁকিতে পড়ছে, এমন কয়েকটি খাতও উল্লেখ করেন ড. ভট্টাচার্য। তিনি মনে করেন, রিজার্ভ কমে যাওয়ায় প্রয়োজন বা চাহিদা অনুযায়ী পণ্য আমদানি প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ছে। একই সঙ্গে এটি টাকার বিনিময় মূল্যকেও দূর্বল করে দিচ্ছে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি হবে। ড: ভট্টাচার্য এটা-ও উল্লেখ করেন যে, এখনকার পরিস্থিতিতে রপ্তানি বাড়ানো এবং প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানোর উৎসাহ বাড়াতে কিছুটা সুযোগ সৃষ্টি করবে। কিন্তু তার ধারণা, সামগ্রিক বিচারে এটি নিঃসন্দেহে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা দূর্বল করবে। এ ছাড়া বাংলাদেশে চলমান উন্নয়নের ধারাকেও শ্লথ করে দেয়ার আশঙ্কা থাকে। ইতিমধ্যেই নানামুখী প্রভাব পড়ছে আমদানির ক্ষেত্রে। সরকার বিলাসবহুল পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করছে। তবে কয়েকমাস ধরে ডলার সংকটের কারণে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতেও সমস্যায় পড়ছেন আমদানিকারকরা। এমনকি বেসরকারি খাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি এবং সরকারিভাবে বিপিসির জ্বালানি তেল আমদানিতেও অনেক ব্যাংক ঋণপত্র বা এলসি খুলছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। বন্দরনগরী চট্টগ্রাম থেকে সেখানকার অন্যতম একজন আমদানিকারক ড. মুণাল মাহমুদ বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে না পারলে বাজারে অস্থিরতা কমবে না। ‘আমদানি খাতে চাপ তৈরি হয়েছে এবং এর ফলে সবকিছুর দাম বাড়তি থাকবে।’ ড: মুণাল মাহমুদ তার অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, ‘আগে আমদানির এলসি খুলতে সমস্যা হতো না। এখন অনেক পণ্য আমদানির শুল্ক শতভাগ করে দিয়ে এলসি নিরুৎসাহিত করছে। ফলে শতভাগ শুল্ক দিয়ে কোন পণ্য আনা সম্ভব নয়। প্রয়োজনীয় পন্যের ব্যাপারেও এখন ব্যাংকগুলো এলসি খুলছে না।’ ‘জীবনযাত্রার ব্যয় অসহনীয়’
ফলে কয়েক মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে এবং এখন মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ। ডলার সংকট এবং মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তে পারে বলে অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন। সরকার কী বলছে
তবে এখন ডলারের রিজার্ভ যা আছে, তাতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই বলে মন্তব্য করেছেন অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এখনকার রিজার্ভ নিয়ে অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর রিজার্ভ থাকলে সেটা কোনো বিপদ সংকেত দেয় না। ‘আমাদের কাছে এখন যে রিজার্ভ আছে, সেটা তিন মাসেরও বেশি আমদানি ব্যয় মেটাতে পারবে। এখন আমরা বিলাসী সব পণ্য আমদানির শুল্ক বাড়িয়েছি। আশা করি, তার সুফল আমরা পাব।’ দেশে বছরে আমদানি ব্যয় ৮০ বিলিয়ন বা ৮ হাজার কোটি ডলার। গত অর্থ বছর গার্মেন্টস খাতে রপ্তানি আগের সব বছরের রেকর্ড ভেঙেছে। এরপরও রপ্তানি হয়েছে ৪৫ বিলিয়ন বা সাড়ে চার হাজার কোটি ডলার। আমদানি খরচ আরো বেশি হওয়ায় ঘাটতি ছিল সাড়ে ৩ হাজার কোটি ডলার। আমদানি ও রপ্তানির ঘাটতি মেটানো হয় প্রবাসী শ্রমিকের পাঠানো রেমিট্যান্স দিয়ে। করোনাভাইরাস মহামারীর দুই বছরে রেমিট্যান্স এসেছে রেকর্ড পরিমাণ। কিন্তু কয়েকমাস ধরে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমছে। বাংলাদেশে ব্যাংক তেমন গুরুত্ব না দিলেও সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান রিজার্ভের ওপর চাপের কথা স্বীকার করেন। তবে তিনি বলেন, চাপ থাকলেও পরিস্থিতি সহনীয় পর্যায়ে আছে বলে সরকার মনে করছে। ‘চাপ তো অস্বীকার করার কোনো বিষয় নেই। তবে চাপেরতো মাত্রা আছে। আমরা মনে করি, সহনীয় পর্যায়ে আছে।’ এই বক্তব্যের সমর্থনে যুক্তি দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নে সর্বশেষ আমদানির যে পেমেন্ট, সেটা দেয়া হয়েছে। আগামী তিন মাস কোন দায় বা পেমেন্ট নেই। এ ছাড়া আমাদের রেমিট্যান্সও বাড়বে আশা করছি এবং এখন রপ্তানি খুবই ভালো আছে। তাছাড়া আমরা কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি, আমরা ব্যয় সংকোচন করছি। ফলে আমরা সাসটেইন করব," বলেন মন্ত্রী মান্নান। শিল্প মালিক এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে। তবে তারা মনে করেন, সরকার সতর্ককতামূলক যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তাতে সঙ্কট সামলানো সম্ভব হতে পারে। ব্যবসায়ীদের প্রধান সংগঠন এফবিসিসিআই এর একজন পরিচালক হাসিনা নেওয়াজ বলছিলেন, ‘আমরা ব্যবসায়ীরা সত্যিই শঙ্কিত হচ্ছি। শঙ্কার কারণ হলো, আমরা ১২ ঘণ্টা একটা কারখানা চালাই, সেখানে যখন বিদ্যুতের ঘাটতি হবে, উৎপাদনের ক্ষতি হবে তার মানে এই নয় যে আমরা হতাশ হচ্ছি।’ শঙ্কা থাকলেও হতাশ না হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হাসিনা নেওয়াজ বলেন, ‘আমাদের যে পদক্ষেপগুলো নেয়া হচ্ছে বিদ্যুৎ বা ডলারের ব্যাপারে, সেগুলোর সাথে অ্যাডজাস্ট করে আমরা ব্যবসায়ীরা ঠিকই টিকে যাব। সেজন্য আমাদের হতাশ হওয়ার কিছু নেই।’ জ্বালানি ও বিদ্যুতের ওপর সরাসরি প্রভাব রিজার্ভ ধরে রাখতে আমদানিসহ সামগ্রিকভাবে ব্যয় কমানোর জন্য সরকার সাশ্রয়ী যেসব ব্যবস্থা নিয়েছে, তার বড় প্রভাব পড়েছে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে। আন্তর্জাতিক বাজারে চড়া দামের কারণে ডিজেলসহ জ্বালানি তেল এবং তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি আমদানি বন্ধ রাখা হয়েছে। গ্যাস এবং ডিজেল ভিত্তিক সব বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রেখে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে সারাদেশে লোডশেডিং করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতির উন্নতির জন্য সরকার এখন শীত আসার অপেক্ষার কথা বলছে। ‘এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার’ নামের একটি সাময়িকীর সম্পাদক মোল্লা আমজাদ হোসেন বলেন, জ্বালানি খাত আমদানি নির্ভর হওয়ায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। ‘জ্বালানি খাত নিয়ে আমরা যা ভাবছি, পরিস্থিতি তার চেয়েও ভয়াবহ।’ আমজাদ হোসেন বলেন, ২০১৭ সালে যেখানে জ্বালানি আমদানির খরচ ছিল মোট আমদানির ২২শতাংশ গত বছর তা ৪৮ শতাংশ হয়েছে। এখন যে বিদ্যুৎ সংকট, আমার ধারণা, এটা আরও বাড়বে। যদি আন্তর্জাতিক বাজারে তেল এবং গ্যাসের দাম না কমে তাহলে সঙ্কট বাড়বে।’ তিনি বলেন, একদিকে বিশ্ববাজার চড়া অন্যদিকে ডলার সঙ্কটের কারণে তেল এবং গ্যাস আমদানি করা যাচ্ছে না। এখন বিদ্যুতে সাশ্রয় করা না হলে বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের দাম অনেক বাড়াতে হবে এবং সরকারের ভর্তুকি তুলে নিতে হবে। যেটা সরকার এখন চাইছে না। ফলে সরকার মনে করছে লোডশেডিং করে আড়াই থেকে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা যাবে। তাতে দাম বাড়াতে হবে না।’ সাশ্রয়ী কর্মসূচির পাশাপাশি সরকারকে বৈদেশিক এবং দেশের ভেতর থেকে ঋণ নিতে হবে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন। অর্থ সহায়তার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের উচ্চপর্যায়ে একটি দল এখন ঢাকায় আলোচনা করছে। এখনকার পরিস্থিতিতে আইএমএফ এর সঙ্গে আলোচনাকে ইতিবাচক হিসাবে দেখেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। ‘এ মুহূর্তে সরকার আইএমএফের সঙ্গে যে আলোচনা শুরু করেছে, আমি এটাকে সঠিক মনে করি।’ ড: ভট্টাচার্যের বক্তব্য হচ্ছে, ‘শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা থেকে যদি দেখি, একটু আগে থেকে আইএমএফ থেকে বৈদেশিক লেনদন কাঠামোটা ঠিক করা গুরুত্বপূর্ণ। দুর্যোগ বেশি ঘনীভূত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করা ঠিক নয়।’ তিনি বলেন, ‘যেহেতু সরকার সঠিক সময়ে এই আলোচনা শুরু করেছে, তাই সাড়ে বিলিয়ন বা ন্যূনতম দুই বিলিয়ন হোক, যে পরিমাণ অর্থ আনতে পারবে, সেটা অর্থের দিক থেকে যতটা না গুরুত্বপূর্ণ হবে, তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হবে আমাদের বৈদেশিক সহযোগীদের একটা সঙ্কেত দেয়ার ক্ষেত্রে। বিদেশি সহযোগীদের প্রতি এই সংকেতের অর্থ হচ্ছে, আমরা শৃঙ্খলার মধ্যে আছি।’ আইএমএফের কাছে কেন কিছু ঋণ সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ?
আইএমএফের কাছ থেকে এ মুহূর্তে ঋণ সহায়তা চাওয়ার বিষয়ে দেশে নানা রকম আলোচনা চলছে। তবে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, চলতি অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নে আইএমএফের কাছে কিছু ঋণ সহায়তা চাওয়া হয়েছে। এ নিয়ে তিনি আতঙ্কের কিছু দেখেন না। এই অর্থ সহায়তা চাওয়ার পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে মন্ত্রী মান্নান বলেন, ‘আইএমএফের কাছে আমরা এই প্রথম চাইনি। ’৯০ দশকেও ঋণ নিয়ে কাঠামোগত সংস্কার আমরা করেছিলাম, তখন অন্য সরকার ক্ষমতায় ছিল। আমরা আইএমএফের সদস্য। এটা আমাদের অধিকার। এর মধ্যেতো আমি ভয়ভীতির কোন কিছু দেখছি না।’ একদিকে অর্থসহায়তার প্রশ্নে আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে আলোচনা এবং অন্যদিকে ব্যয় কমানোর সতর্কতামূলক বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে পরিস্থিতি বেশি খারাপ হবে না বলে সরকার মনে করছে। সাময়িক সমস্যা মনে করছেন না বিশ্লেষকরা
কিন্তু অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের বক্তব্য হচ্ছে, এখন সমস্যাকে মৌসুমি সমস্যা হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। ‘যে সমস্যা হচ্ছে, এটা মৌসুমি কোনো সমস্যা না। এটা অর্থনীতির কাঠামোগত সমস্যা।’ তিনি বলেন, ‘মৌসুমি সমস্যা হলে আমরা চলমান একটা পদক্ষেপ নিয়ে কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করি এবং সুসময় আবার আসার জন্য অপেক্ষা করি। কিন্তু এখানে সমস্যা হচ্ছে, বড় ধরনের বাণিজ্য ঘাটতি। এ ছাড়া রেমিট্যান্স কম আসছে।’ ড: ভট্টাচার্য মনে করেন, এই কাঠামোগত সমস্যা এমন একটা সময়ে এসেছে, যখন শুধু আন্তর্জাতিক বাজার বা ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপার না। এটি বাংলাদেশের অর্থনীতির অভ্যন্তরীন কাঠামোগত সমস্যা এবং এর ভেতরে বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের দায় দেনা পরিশোধের বিষয়ও আসবে। এবিএন/এসএ/জসিম
এই বিভাগের আরো সংবাদ