আজকের শিরোনাম :

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন

বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া-ইউরোপে মানব পাচার কেন ঠেকানো যাচ্ছে না?

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৭ জানুয়ারি ২০২২, ১৫:২৬

ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার সময় আবার ৭ বাংলাদেশি প্রাণ হারিয়েছেন। তবে এ রকম ঘটনা এই প্রথম নয়। এর আগেও উন্নত জীবনের খোঁজে সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যাওয়ার সময় বাংলাদেশিদের হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।

গত বছর মে মাসে লিবিয়া থেকে ইউরোপে যাওয়ার পথে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের একটি নৌকা যাওয়ার পর সাগর থেকে যে ৩৩ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে তাদের সবাই বাংলাদেশি ছিল বলে জানিয়েছিল আইওএম। সেই ঘটনায় ৫০ অভিবাসী নিখোঁজ ছিলেন।

২০১৯ সালের মে মাসে লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে সাগরে ডুবে প্রাণ হারিয়েছিলেন অন্তত ৪০ বাংলাদেশি। 

ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে বারবার বাংলাদেশিদের এ রকম হতাহত হওয়ার ঘটনা ঘটলেও কেন এই প্রবণতা বন্ধ হচ্ছে না?

ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়া এক বাংলাদেশির কাহিনি 
২০১৯ সালে ইতালির এক আশ্রয় শিবিরে একজন বাংলাদেশি তরুণের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন বিবিসি সাংবাদিক ইসমাইল এইনাশে।

সেই তরুণ বিবিসিকে বলেছেন, ২০১৬ সালে ১৯-বছর বয়সে কাজের খোঁজে লিবিয়ার উদ্দেশে এক ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা শুরু করেন। এ জন্য দালালের মাধ্যমে তার ভুয়া পাসপোর্ট তৈরি করা হয়, যেখানে তার বয়স দেখানো হয় ২১ বছর। তারা লিবিয়ায় গিয়ে কাজ করে ধনী হওয়ার জন্য তাকে প্রলুব্ধ করে। তাকে বলা হয়, সেখানে কাজ করে হাজার হাজার টাকা আয় করতে পারবে।

কিন্তু লিবিয়ায় যাওয়া মানুষের দুর্দশা, নির্যাতন, নিপীড়ন বা ঝুঁকি সম্পর্কে তাকে কিছু জানানো হয়নি। বাড়ির একটি গরু বিক্রি করে লিবিয়া যেতে টাকা দেয় তার পরিবার।

প্রথমে তাকে ঢাকা থেকে বাসে কলকাতা নিয়ে যাওয়া হয়। পরে বিভিন্ন ফ্লাইটে মুম্বাই, দুবাই, কায়রো হয়ে লিবিয়ায় যান। লিবিয়ায় যাওয়ার পরই আরও টাকা আদায়ের জন্য তাকে একটি কারাগারে আটকে ফেলা হয়। বাড়ির বাকি দুটি গরু বিক্রি করে তার মুক্তিপণ দেয় পরিবার।

যেখানে তাকে রাখা হয়েছিল, সেখানে তার মতো আরও ১৫ বাংলাদেশি ছিল। সেখান থেকে ছাড়া পেয়ে ত্রিপোলির একটি কারখানায় কিছুদিন কাজ করেন। কিন্তু সেখানেও তাকে নির্যাতন করা হতো। তখন তিনি আবার পাচারকারীদের সহায়তায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যারা সিদ্ধান্ত নেন।

একটি ডিঙি নৌকায় করে ৭৯ বাংলাদেশির সঙ্গে তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেন। উদ্ধার করার পর তাদের প্রথমে ল্যাম্পাডুসা দ্বীপে নিয়ে যাওয়া হয়, পরে সিসিলির উপকণ্ঠে পলিমারোর একটি আশ্রয় কেন্দ্রে পাঠানো হয়।

পাচারের প্রধান রুট লিবিয়া
লিবিয়া পাড়ি দিতে গিয়ে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মৃত্যু বা আটক হওয়া অনেকটা নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। মিসর, ইরাক, সুদান বা সিরিয়ার নাগরিকদের পাশাপাশি সেই তালিকায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশিও রয়েছে।

অভিবাসনবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ফ্রন্টিয়ারের ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী, যত মানুষ ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করে আটক হয়েছে, বাংলাদেশ সেই তালিকায় তৃতীয়। গত বছর ৭ হাজার ৫৭৭ বাংলাদেশি ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করেছে।

এই তালিকার শীর্ষে তিউনিসিয়া। এর পরে মিশর, বাংলাদেশ, সিরিয়া, ইরান, আইভরি কোস্ট, ইরাক, আফগানিস্তান ও এরিত্রিয়া রয়েছে।

ব্র্যাকের অভিবাসন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলছেন, ‘অন্য দেশগুলোয় যুদ্ধ বা সংকট থাকলেও, বাংলাদেশে কিন্তু সেইরকম পরিস্থিতি নেই। প্রবাসীরা সেটাকে মনে করেন স্বপ্ন যাত্রা, কিন্তু আমরা বলি মৃত্যু যাত্রা। দেখা যায় কয়েকটি জেলার বাসিন্দারা বেশি চেষ্টা করেন। এর কারণ এসব জেলার অনেকে ইউরোপের নানা দেশে থাকেন। তারা গ্রামের লোকজন বা স্বজনদের বলেন, কোনভাবে ইউরোপে আসতে পারলেই কাজের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ফলে তারাও যেভাবেই হোক, ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করেন। সেই সঙ্গে দালালদের প্রলোভন তো রয়েছে।’

তিনি বলছেন, বাংলাদেশি নানা দালাল বা এজেন্সির লোকজন জাল কাগজপত্র তৈরি করে, মিথ্যা তথ্য দিয়ে অবৈধভাবে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করে। লিবিয়ায় সরকার ব্যবস্থা অকার্যকর থাকায় এবং ইউরোপের উল্টো দিকে হওয়ায় মানব পাচারকারীরা রুট হিসাবে লিবিয়াকে বেশি পছন্দ করে। সেখানে অনেক আন্তর্জাতিক পাচারকারী চক্র গড়ে উঠেছে।

কেন বাংলাদেশ থেকে লিবিয়ায় যাওয়া বন্ধ হচ্ছে না?
শরিফুল হাসান বলছেন, মানব পাচারের শিকার হওয়ার পর বাংলাদেশে ফেরত এসেছেন, তাদের সঙ্গে কথা বলে তারা অন্তত ১৮টি রুটের তথ্য জানতে পেরেছেন।

শরিফুল হাসান বলছেন, ‘সরাসরি বাংলাদেশ থেকে যে লিবিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়, তা নয়। আমরা দেখতে পেয়েছি, বাংলাদেশ থেকে মানব পাচারকারীরা অন্তত ১৮টি রুট ব্যবহার করে। তারা বিভিন্ন দেশে বসে এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে।’

অনেক সময় বাংলাদেশ থেকে ভারত হয়ে, দুবাই, ওমান বা নেপাল হয়ে ভাগ্যান্বেষীদের নিয়ে যাওয়া হয়।

‘ইউরোপে সম্প্রতি যারা আটক হয়েছেন, তাদের অনেকেই প্রথমে দুবাই বা মধ্যপ্রাচ্যে ভ্রমণ ভিসায় গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখা যায়, তারা কোন কাজ পায়নি। তখন তারা মরীয়া হয়ে পাচারকারী চক্রের সহায়তায় ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করে। এখানে বাংলাদেশের বিমানবন্দর বা ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের অনেক দায়িত্ব আছে। তাদের আরও সতর্ক হওয়া দরকার,’ বলছেন শরিফুল হাসান।

তিনি জানান, প্রতিবছর গড়ে ৫,০০০ মানুষ বাংলাদেশ থেকে এভাবে উন্নত দেশগুলোয় যাওয়ার চেষ্টা করে। গত এক যুগে অন্তত ৬৫,০০০ মানুষ এভাবে বিভিন্ন দেশে যাওয়ার চেষ্টা করেছে।

অভিবাসনবিষয়ক সংস্থা রামরুর চেয়ারপার্সন তাসনিম সিদ্দিকী বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘রাষ্ট্রের যে মেকানিজম আছে, তার ভিতর যে জবাবদিহিতা থাকা দরকার, সেটা নেই। যারা যাচ্ছেন, তারা কিন্তু জেনেই যাচ্ছেন যে, তারা অবৈধ পথে যাচ্ছেন। তবে তারা ভাবেন, তারা পার হতে পারবেন, তাহলেই জীবন বদলে যাবে। তারা জেনেশুনে সেই ঝুঁকিটা নেয়।’

কিন্তু সেখানে পথে পথে যত বিপদ লুকিয়ে আছে, সেসব তথ্য তাদের কাছে খুব বেশি থাকে না।

‘অন্যদিকে যাদের এসব ঘটনাকে নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব, তারা জেনে বুঝেও অনেক ক্ষেত্রে চোখ বন্ধ করে থাকেন। যেমন এয়ারপোর্টে হয়তো এরা টুরিস্ট ভিসা নিয়ে যাচ্ছেন। তখন গ্রামের এই লোকটা প্রথমবার সুদান, তিউনিসিয়া যাচ্ছেন- দেখার পরেও তারা ছেড়ে দিচ্ছেন। সেখানে তাদের জবাবদিহিতার মধ্যে আনা যাচ্ছে না,’ বলছেন তাসনিম সিদ্দিকী।

তবে অভিবাসন বিভাগের গাফিলতির অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব মো. মোকাব্বির হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘আমি আপনাকে নিশ্চিতভাবেব লতে পারি, বাংলাদেশ থেকে বৈধ কাগজপত্র ছাড়া কেউ ইমিগ্রেশন পার হতে পারে না। এখন ধরুন কারও কাছে কাছে দুবাইয়ের ভিজিট ভিসা আছে, তাকে আপনি কীভাবে আটকাবেন? হয়তো অন্য কোন দেশের বৈধ ভিসা নিয়ে এখান থেকে বৈধভাবে বের হচ্ছে। সেখান থেকে সে লিবিয়া বা অন্য কোথাও যাচ্ছে। আমার এখান থেকে তো কেউ সরাসরি লিবিয়া যাচ্ছে না। তবে আমরা চেষ্টা করছি, যাতে এভাবে কেউ বিদেশে গিয়ে অবৈধ পথে যাওয়ার চেষ্টা না করে। যাদের ভিজিট ভিসা আছে, তাদের ক্ষেত্রেও আমরা যথেষ্ট সতর্ক আছি।’

আইনি ব্যবস্থা নেই বলে মানব পাচার বন্ধ হয় না
অভিবাসনসংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেহেতু এভাবে বিদেশগামী ব্যক্তিদের বেশিরভাগ মানুষ জেনেশুনে অবৈধ পথে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করেন, তারা ব্যর্থ হয়ে দেশে ফিরতে বাধ্য হলে বা স্বজনরা হতাহত হলেও কেউ আর আইনি পদক্ষেপ নিতে চান না। ফলে ফেরত এলেও মামলা হয় না।

শরিফুল হাসান বলছেন, ‘আইনি ব্যবস্থা নিতে হলে তার কাছে যেসব কাগজপত্র বা প্রমাণ থাকা দরকার, অবৈধ পথে যাওয়ার কারণে তাদের কাছে সেগুলো থাকে না। আবার নিজেরা জেনেশুনে যাওয়ার চেষ্টা করেন বলে তারাও আইনি পদক্ষেপ নিতে আগ্রহী হন না।’

ফলে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে বাংলাদেশিদের হতাহতের খবর গণমাধ্যমে এলেও এ নিয়ে খুব একটা আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয় না।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে মানব পাচার সংক্রান্ত ৫৩৮টি মামলা হয়েছে। তার মধ্যে গুটিকয়েক রয়েছে লিবিয়া থেকে মানব পাচার ঘিরে। সেই বছর ২০২০ সালে সন্ত্রাসীদের গুলিতে ২৬ জন বাংলাদেশি নিহত হওয়ার পরে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী উদ্যোগী হয়ে পাচারকারীদের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে।

গত বছরের মে মাসে লিবিয়া উপকূল থেকে ৩৩ জন বাংলাদেশিকে উদ্ধার করার পর বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেছিলেন, ‘সরকারিভাবে লিবিয়ায় শ্রমিক পাঠানো বন্ধ আছে। সুতরাং যারা গেছেন তাঁরা নিজের রিস্কে গেছেন। তা ছাড়া তারা কোনো রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমেও যাননি। সম্ভবত ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে গেছেন। তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।’

তবে ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নজির খুব বিরল।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব মো. মোকাব্বির হোসেন বলছেন, ‘পাচারের ক্ষেত্রে যারাই অভিযোগ করেন, যারা ফেরত আসছেন, সেটা অ্যাড্রেস করা হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলো, যারা বিদেশে গিয়ে ফেরত আসেন, তারা কারও বিরুদ্ধে বলেন না, মামলাও করেন না। আমরা তিউনিসিয়া থেকে যাদের ফেরত এনেছি, তাদের একজনও অভিযোগ করতে রাজি হননি। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথেষ্ট চেষ্টা করে, কিন্তু কেউ যদি অভিযোগ না করে, তাহলে আপনি তো যে কাউকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন না।’

‘যারা যায় এবং যারা পাঠায়, এই দুই গ্রুপের মধ্যে বোঝাপড়া অত্যন্ত শক্ত। তারা কেউ ডিসক্লোজড করে না, এটা রিয়েলিটি। আমরা বা ইমিগ্রেশন পুলিশ, সরকার বিভিন্নভাবে চেষ্টা করছে। কিন্তু এরা কেউ স্বীকার করতে চায় না। তবে কেউ তথ্য দিলে সেটা অবশ্যই দেখা হয়।’

ব্র্যাকের অভিবাসব প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলছেন, ‘বড় বা আলোচিত ঘটনা হলে কিছু মামলা হয়, গ্রেপ্তার হয়। কিন্তু কিছুদিন গেলেই সেটা থেকে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আসলে কঠোর কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়, ফলে মানব পাচারকারীদের কর্মকাণ্ডও বন্ধ হয় না। সেই সঙ্গে যারা বিদেশে যাচ্ছে, তাদের নিজেদের এবং তাদের পরিবারকে সবার আগে সচেতন হতে হবে।’

এবিএন/সাদিক/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ