আজকের শিরোনাম :

যেভাবে বিশ্ব নজরদারির পেগাসাস নির্মাতা হয়ে উঠল ইসরায়েলি এনএসও

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২১, ১১:২৫

অভ্যন্তরীণ সূত্রমতে, এনএসও’র নীতিমালা ইসরায়েলের রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তার অন্তর্ভুক্ত। প্রতিষ্ঠানটির অলিখিত বিধান হচ্ছে, 'তিনটি বিচার ব্যবস্থার সাথে কখনো ঝামেলা করা যাবে না: ইসরায়েল, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র।'
২০১৯ সালে গোপন নজরদারির অভিযোগে পেগাসাস নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এনএসও গ্রুপের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হলে প্রতিষ্ঠানটির নতুন বিনিয়োগকারীরা মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোকে আশ্বস্ত করতে উঠেপড়ে লাগে।

এক খোলা চিঠিতে তারা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে জানায়, এনএসও'র কার্যক্রম শুধুই সন্ত্রাসবিরোধী ও জঙ্গিবাদের মতো গুরুতর বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

তবে সাম্প্রতিক কেলেঙ্কারির পর প্রতিষ্ঠানটির এই বিবৃতি কেবলই ফাঁকা বুলি বলে মনে হবে।

ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান এনএসও'র তৈরি করা স্পাইওয়্যার পেগাসাস ব্যবহার করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাজনীতিক, মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক ও আইনজীবীদের ওপর নজরদারির খবর সামনে আসার পরই গোপনীয়তা রক্ষা ও নজরদারি নীতিমালা সম্পর্কে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে।

২০১০ সালে যাত্রা শুরু করা এনএসও খুব দ্রুত সময়ের মধ্যেই বিশ্বজুড়ে নজরদারি সফটওয়্যার বিতরণের অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।

প্যারিসভিত্তিক সংস্থা ফরবিডেন স্টোরিস এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে দ্য গার্ডিয়ানসহ ১৬টি পত্রিকার যৌথ অনুসন্ধানী 'পেগাসাস প্রজেক্টে'র মাধ্যমে ৫০ হাজারের বেশি ফোন নম্বর ফাঁস হওয়ার প্রতিবেদনের পর প্রতিষ্ঠানটির নাম নতুন করে সামনে আসে।

দেখে নেওয়া যাক এনএসও গ্রুপের ইতিবৃত্ত:

এনএসও'র যাত্রা
ইসরায়েলের হারজিলিয়া শহরে যাত্রা শুরু করা এনএসও গ্রুপ স্বল্প সময়েই বহুদূর পাড়ি দিতে সক্ষম হয়েছে। তিন বন্ধু নিভ কারমি, শালেভ হুলিও এবং ওমরি লাভিয়ে মিলে এনএসও প্রতিষ্ঠা করেন। তিনজনের নামের আদ্যাক্ষর দিয়ে এনএসও নামের উদ্ভব।

ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্সের সদস্য ছিলেন শালেভ হুলিও। তিনি জানান, লেভি ও তার কাছে ইউরোপীয়ান একটি গোয়েন্দা সংস্থার ফোন কল এসেছিল। হুলিও ও লেভি মানুষের ফোনের গোপন তথ্য বের করতে জানেন, এ কথা জানতে পেরেই সংস্থাটি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল।

'আপনারা কেন এই জিনিস ব্যবহার করে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করছেন না?' সংস্থাটি তাদের সামনে প্রশ্ন রাখে।

আর তখনই প্রথমবারের মতো হুলিও ও লেভির মাথায় নজরদারিভিত্তিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান শুরু করার চিন্তা আসে।

স্মার্টফোনের উন্নতি এবং হোয়াটসঅ্যাপ ও টেলিগ্রামের মতো এনক্রিপ্টেড যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যূহ ভেদ করে জঙ্গি, শিশুকামী এবং অন্যান্য অপরাধীদের ধরতে মরিয়া গোয়েন্দা সংস্থা ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো বিকল্প হিসেবে গোপনে আড়িপাতার মতো 'অন্ধকার রাস্তা' বেছে নেয়।

হুলিও বলেন, 'তারা আমাদের জানায় যে আমরা প্রকৃত বিষয়টা জানি না। পরিস্থিতি ভীষণ উদ্বেগজনক।'

পরিস্থিতি অনুযায়ী নজরদারি প্রযুক্তির চাহিদা এতই বেশি ছিলো, স্পাইওয়্যার বিক্রি শুরু করার স্বল্প সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি দ্রুত প্রসার লাভ করে। বর্তমানে এনএসওতে কর্মরত সদস্যের সংখ্যা ৭৫০ জন।

নজরদারির স্বার্থে শুধুমাত্র বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছে স্পাইওয়্যার বিক্রির দাবি
বিশ্ব নজরদারি প্রযুক্তির বাজারে এনএসও এখন শীর্ষস্থানীয় পর্যায়ে অবস্থান করছে। বিভিন্ন দেশের সরকার প্রতিষ্ঠানটির কাছে উন্নত সব সাইবার সুবিধা পাচ্ছে, যা দিয়ে সহজেই যুক্তরাষ্ট্রের এনএসএ বা যুক্তরাজ্যের জিসিএইচকিউ'র মতো নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া সম্ভব।

শুরু থেকেই এনএসও জঙ্গিবাদবিরোধী ও অপরাধ দমনে অগ্রগামী ভূমিকা পালনের একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করে।

২০১৯ সালে এনএসও গ্রুপের সহ-সভাপতি তামি মাজেল শাচার সিক্সটি মিনিটসকে বলেন, 'এই প্রযুক্তি মূলত বিশ্বের বিন লাদেনদের ধরার জন্য।'

এছাড়া, প্রতিষ্ঠানটি জনসাধারণের ওপর ঢালাওভাবে নজরদারি সমর্থন করে না বলেও দাবি করে। এনএসওর গ্রাহকরা প্রতিবারে ১০০ জনের কমসংখ্যক টার্গেটের প্রতি নজরদারি চালায় বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, গ্রাহকপ্রতি বার্ষিক গড় টার্গেট সংখ্যা ১১২ জন।

প্রতিষ্ঠানের স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে অপরাধ সংগঠনের ঘটনা বিরল বলে দাবি করেছে তারা। তাছাড়া, এ ধরনের অভিযোগ এলে তা তদন্ত করার কথাও জানায় প্রতিষ্ঠানটি।

তবে নিপীড়নের অভিযোগ উঠলেও প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহক রাষ্ট্রদের নাম প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনএসও কার্যক্রমের সঙ্গে পরিচিত এক সূত্র জানায়, গত বছরই মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্নের মুখে সৌদি আরব ও আরব আমিরাতের দুবাইয়ের সঙ্গে করা চুক্তির ইতি টানে।

'পকেটের ভেতর ডিজিটাল স্পাই'
দ্য গার্ডিয়ানসহ ১৬ টি পত্রিকার সম্মিলিত অনুসন্ধান 'পেগাসাস প্রজেক্টে'র মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম নিয়ে নতুন ভাবে প্রশ্ন উঠেছে।

'পেগাসাস প্রজেক্টে' ইসরায়েল সরকারের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ওপরও আলোকপাত করা হয়েছে।

'প্রতিষ্ঠানটির নীতিমালা রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তার অন্তর্ভুক্ত,' জানায় অভ্যন্তরীণ একটি সূত্র। তবে এনএসও গ্রুপ একটি মৌলিক নীতি অনুসরণ করে। তা হলো, 'তিনটি বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে কখনো ঝামেলা করা যাবে না। এগুলো হলো: যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও রাশিয়া।'

মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ
২০১২ সালে প্রতিষ্ঠানটির প্রথম গ্রাহক হয় মেক্সিকো। এখনো দেশটি এনএসও'র অন্যতম বৃহৎ স্পাইওয়্যার আমদানিকারক।

২০১৬ থেকে ২০১৭ সালে ১৮ মাসের ব্যবধানে মেক্সিকোর ১৫ হাজারের বেশি মানুষের নম্বর ফাঁস হওয়া ডেটাবেজে উঠে এসেছে। এদের মধ্যে ডজনখানেক সাংবাদিক, সম্পাদক এবং দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেজ ম্যানুয়েল লোপেজের ঘনিষ্ঠ অন্তত ৫০ ব্যক্তির নম্বর রয়েছে।

তবে এর অর্থ এই নয়, তাদের সবার ফোনে আক্রমণ বা আক্রমণের চেষ্টা করা হয়েছে। এর অর্থ হলো, এনএসও'র সরকারি গ্রাহকদের মেক্সিকান এই মানুষদের প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল।

২০২০ সালেও মেক্সিকোর বিরুদ্ধে এনএসওর প্রযুক্তির অপব্যবহারের অভিযোগ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। পুলিশের মাধ্যমে অপহৃত ৪৩ জন শিক্ষার্থীর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনার অনুসন্ধানে নিয়োজিত আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের লক্ষ্য করে স্পাইওয়্যার ব্যবহারের অভিযোগ ওঠে।

মানবাধিকার রক্ষার বিষয়ে আরব আমিরাতের দুবাইয়ের জলঘোলা করার ইতিহাস নতুন নয়। রাজতন্ত্রটি যুক্তরাজ্যে ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে নজরদারি আরোপের জন্য এনএসও'র অনুমতি চেয়েছিল।

মাদক চোরাচালানকারীদের ধরতে গোপনে এই কাজ করতে হবে বলে যুক্তি দেয় দুবাই।

বিষয়টি নিয়ে এনএসও দ্বন্দ্বে পড়েছিল বলে জানায় সংশ্লিষ্ট সূত্র। ২০১৬ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত স্বনামধন্য মানবাধিকার কর্মী আহমেদ মনসুরের ফোন হ্যাক করতে এনএসও স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে। এক বছর পর মনসুরকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি এখনো কারাবন্দি রয়েছেন।

২০১৮ সালের অক্টোবরে সিটিজেন ল্যাব কানাডায় বসবাসকারী সৌদি ভিন্নমতাবলম্বী ওমর আবদুল আজিজের ফোনেও ম্যালওয়্যার শনাক্ত করে।

ইস্তানবুলে সৌদি কনস্যুলেটে নিহত সাংবাদিক জামাল খাসোগির মৃত্যুর পর আবদুল আজিজের ফোনে আড়িপাতার বিষয়টি নতুন করে গুরুত্ব পায়।

খাসোগির সঙ্গে আবদুল আজিজের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। এক সাক্ষাৎকারে এবং আদালতের কাছে বয়ানে আবদুল আজিজ জানান, তার বিশ্বাস ওয়াশিংটন পোস্টের কলাম লেখক খাসোগির হত্যা এবং তার পরিবারকে হয়রানির পেছনে ফোনে আড়িপাতা 'গুরুত্বপূর্ণ বিষয়' হিসেবে কাজ করেছে।

খাসোগি হত্যাকাণ্ডের চারদিন পরেই এনএসও'র একজন সৌদি গ্রাহকের মাধ্যমে পেগাসাস ব্যবহার করে খাসোগির বাগদত্তা হাতিস চেঙ্গিজের ফোন হ্যাক করার চেষ্টা করা হয়। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সিকিউরিটি ল্যাব কর্তৃক হাতিসের ফোন পরীক্ষার পর বিষয়টি সামনে আসে।

তবে এনএসও এক বিবৃতিতে জানায়, 'আমাদের প্রযুক্তি কোনোভাবেই জামাল খাসোগির জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়। খাসোগি বা তার পরিবারের কারও বিষয়ে যাচাই করতে আমাদের প্রযুক্তি ব্যবহার করে কিছু শোনা, নজরদারি করা, অবস্থান শনাক্ত করা বা অন্য কোনো তথ্য সংগ্রহ করা হয়নি বলে আমরা নিশ্চিত করছি।'

ব্যবস্থা নিয়েছে হোয়াটসঅ্যাপ
পেগাসাসের বিতর্কে যুক্ত রয়েছে আরেক প্রযুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হোয়াটসঅ্যাপ।

২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে হোয়াটসঅ্যাপ জানায়, তাদের এক হাজার ৪০০ জন ব্যবহারকারীকে পেগাসাসের মাধ্যমে টার্গেট করা হয়েছে। যাদেরকে আক্রমণ করা হয়, তাদের এ বিষয়ে সতর্ক করে হোয়াটসঅ্যাপ। এদের মধ্যে ভারত, রোয়ান্ডা ও মরক্কোর ডজনখানেক সাংবাদিক রয়েছেন।

এনএসও'র সাথে হোয়াটসঅ্যাপের চলমান আইনি লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালতের সামনে এনএসও গ্রুপ নিজেদের নির্দোষ দাবি করে। তারা জানায়, প্রতিষ্ঠানটির সফটওয়্যার গ্রাহক হিসেবে বিভিন্ন বিদেশি সরকার ব্যবহার করছে। এই বিষয়ে তারা কিছুই জানে না বা তারা এর অনুমোদনও দেয়নি।

এনএসও'র গ্রাহক হওয়া যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুকধারী হওয়ার মতো বলে মন্তব্য করেন নজরদারি বাণিজ্যের সাবেক একজন মধ্যস্থতাকারী।

তিনি বলেন, 'বন্দুকের সাহায্যে আপনাকে আত্মরক্ষার অধিকার দেওয়া হয়। কিন্তু সেই বন্দুক ব্যবহার করে আপনি ব্যাংকে ডাকাতি করলে কে থামাবে?'

'পেগাসাস সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মীদের ওপর নজরদারির বিষয়টি জানত কি না, এ বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন করলে বলব, তারা অবশ্যই জানত। এটা আমার অভিমত। সবাই তা বোঝে। কিন্তু এগুলো কি বলা হয়েছে? তারা কি বলেছে, আমরা এটাকে রাষ্ট্রবিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করব? না, তারা এসব স্বীকার করে না,' বলেন তিনি।

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান ভায়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড

এবিএন/জনি/জসিম/জেডি

এই বিভাগের আরো সংবাদ