আজকের শিরোনাম :

বিশ্বের রাজনীতি ওলটপালট করছে টিকা

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১২ মে ২০২১, ১৯:১৭

বিশ্বব্যাপী কভিডের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর থেকেই টিকার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছে বিশ্ববাসী। বর্তমানে বাজারে টিকা এলেও তা নিয়ে রয়েছে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা। অনেক দেশই এখনো জনগণের জন্য পর্যাপ্ত টিকার সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারেনি। সংক্রমণের একেকটি প্রবাহ পর্যুদস্ত করে ছাড়ছে এসব দেশের জীবন ও জীবিকাকে। টিকা সংগ্রহে ব্যর্থতার দায়ে অজনপ্রিয় হয়ে উঠছে ক্ষমতাসীনরা। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাও দেখা দিচ্ছে কোথাও কোথাও। এমনকি এরই মধ্যে শুধু টিকা ইস্যুতেই ক্ষমতার পালাবদল ঘটে যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে।

এ মুহূর্তে টিকা ইস্যুতে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সবচেয়ে বড় উদাহরণ হয়ে উঠেছে স্লোভাকিয়া। গত বছরের মার্চে অনেকটা জনগণের চ্যাম্পিয়ন ভাবমূর্তি নিয়ে দেশটির ক্ষমতায় এসেছিলেন ইগর মাতোভিচ। দুর্নীতিবিরোধী প্লাটফর্মকে কাজে লাগিয়ে ইগর মাতোভিচের নেতৃত্বাধীন জোট সরকার যখন ক্ষমতায় আসে, তখন বিশ্বব্যাপী করোনার প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়েছে। এ কারণে শুরু থেকেই স্বাস্থ্য খাত নিয়ে বড় ধরনের চাপে ছিলেন মাতোভিচ। তবে জনপ্রিয় নেতা হিসেবে মাতোভিচ এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবেন বলেই ধারণা করছিলেন সবাই। যদিও ক্ষমতা গ্রহণের এক বছরের মাথায় মাতোভিচ হয়ে ওঠেন স্লোভাকিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে অজনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী। এমনকি ক্ষমতাসীন জোটের মধ্যেই তার প্রতি সমর্থন নেমে আসে শূন্যের কোটায়। বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরে গত মাসেই পদত্যাগ করেছেন ইগর মাতোভিচ।

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, মাত্র এক বছরের মধ্যে নিজ দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে অজনপ্রিয় নেতা হয়ে উঠেছেন ইগর মাতোভিচ। মহামারীকালে জনগণের টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিতে ব্যর্থতা তাকে বানিয়ে তুলেছে রাজনৈতিক খলনায়ক। করোনাকালীন দুর্বল ব্যবস্থাপনার অভিযোগে আগেই বেশ সমালোচিত হয়েছেন তিনি। করোনার দ্বিতীয় সংক্রমণপ্রবাহ শুরুর পর তার পতন অনেকটা নিশ্চিত হয়ে পড়ে। বিপর্যয়ের মুখে রাশিয়ার সঙ্গে এক গোপন চুক্তির ভিত্তিতে ২০ লাখ ডোজ টিকা আমদানির মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার শেষ চেষ্টা চালিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) অনুমোদিত না হওয়ায় স্লোভাকিয়ার ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থাও এর অনুমোদন দিতে অস্বীকৃতি জানায়। এক পর্যায়ে জোট সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন ইগর মাতোভিচ।

টিকাকেন্দ্রিক অনিশ্চয়তায় বৈশ্বিক রাজনীতিতে বড় ধরনের ওলটপালটের সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন পর্যবেক্ষকরা। তারা বলছেন, শুধু স্লোভাকিয়া নয়, বিশ্বের অনেক স্থানেই এখন ক্ষমতাসীনদের জন্য বড় বিপদের কারণ হয়ে উঠেছে মহামারীকালীন অব্যবস্থাপনা ও জনগণের জন্য প্রয়োজনীয় টিকা সংগ্রহে ব্যর্থতা। কোনো কোনো দেশে এরই মধ্যে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে গিয়েছে। আবার কোথাও নড়বড়ে হয়ে উঠেছে ক্ষমতাসীনদের দীর্ঘদিন ধরে গড়ে তোলা রাজনৈতিক ভিত্তি।

এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে বলা হচ্ছে ভারতের কথা। বিশেষজ্ঞদের মতে, টিকাকেন্দ্রিক অনিশ্চয়তা দেশটির ক্ষমতাসীন বিজেপিকে যতটা বিপাকে ফেলেছে, গত কয়েক বছরে বিরোধী দলগুলোও তা করে উঠতে পারেনি।

দেশটির মহামারী পরিস্থিতি এখন গোটা বিশ্বেই উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারিভাবে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে এরই মধ্যে সংক্রমণ শনাক্তের সংখ্যা ২ কোটি ২৯ লাখ ছাড়িয়েছে। মৃত্যু হয়েছে আড়াই লাখের বেশি মানুষের। যদিও দেশটির গণমাধ্যম ও স্বাস্থ্য খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা আরো অনেক বেশি।

স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ভারতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এখন মারাত্মক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। এমনকি শ্মশান-গোরস্তানসহ মৃতদেহ সমাহিত করার স্থানেরও মারাত্মক সংকট দেখা দিয়েছে। দেশটির এ ভয়াবহ দশার জন্য দায়ী করা হচ্ছে বিজেপি সরকারের মহামারীকালীন অব্যবস্থাপনা ও জনগণের জন্য প্রয়োজনীয় টিকার সরবরাহ নিশ্চিতে ব্যর্থতাকে।

অথচ গোটা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি টিকা উৎপাদন হয় ভারতেই। চলমান মহামারী প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও দেশটি বৈশ্বিক টিকা কারখানার দায়িত্ব পালন করবে, এমনটাই প্রত্যাশা ছিল অনেকের। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোও টিকার সরবরাহের জন্য তাকিয়ে ছিল দেশটির টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সেরাম ইনস্টিটিউটের দিকে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি প্রতিশ্রুত টিকা সরবরাহে ব্যর্থ হয়। অন্যদিকে সময়মতো প্রয়োজনীয় টিকার ক্রয়াদেশ ও সেরামকে সহযোগিতা দিতে ব্যর্থ হয় নয়াদিল্লিও। ফলে অন্য দেশে সরবরাহ দূরের কথা, সেরাম এখন নিজ দেশেই প্রয়োজনীয় টিকার সরবরাহ দিতে পারছে না। এ অবস্থায় টিকা রফতানি বন্ধ করেও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না ভারত। প্রয়োজনীয় টিকার অভাবে পরিকল্পনামাফিক টিকাদান কার্যক্রম চালাতে পারছে না রাজ্য সরকারগুলো। এ পরিস্থিতির জন্য কেন্দ্রকেই দোষারোপ করছে রাজ্য সরকারগুলো।

টিকা সরবরাহ নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক সমালোচিত হচ্ছে নরেন্দ্র মোদির সরকার। অন্য দেশগুলোয় প্রতিশ্রুত টিকা সরবরাহে ব্যর্থতা কূটনৈতিক পরিমণ্ডলে ভারতকে অনেকটাই বিপাকে ফেলে দিয়েছে। সমালোচনায় মুখর বিরোধী নেতারাও। দেশটির গণমাধ্যমেও প্রতিদিন টিকার সরবরাহ সংকট ও মহামারীকালীন অব্যবস্থাপনার অভিযোগ তুলে কোনো না কোনো নিবন্ধ বা প্রতিবেদন প্রকাশ হচ্ছে।

ভারতের প্রতিশ্রুত টিকা না পেয়ে বিপাকে পড়েছে ব্রাজিল সরকারও। বিশ্বব্যাপী করোনার প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকেই মারাত্মক বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে ব্রাজিলের স্বাস্থ্য খাত। এ নিয়ে ঔদাসীন্যের কারণে দেশটির প্রেসিডেন্ট জাইর বোলসোনারোকে নিয়ে সমালোচনাও হয়েছে অনেক। সম্প্রতি তার জন্য পরিস্থিতিকে আরো কঠিন করে তুলেছে করোনার টিকা সংগ্রহে ব্যর্থতা।

ব্রাজিলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কার্লোস ফ্রাঙ্কা সম্প্রতি দেশটির আইনপ্রণেতাদের জানিয়েছেন, ব্রাজিলের জন্য চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে টিকার সরবরাহ আনার চেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি। কিন্তু বিশ্বব্যাপী সরবরাহ সংকটের কারণে বিষয়টি তার জন্য বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিষয়টি ব্রাজিলের রাজনীতিতে অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা তৈরি করেছে। কার্লোস ফ্রাঙ্কার পূর্বসূরি এরনেস্তো আরুয়াজোও টিকার সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারার ব্যর্থতা মাথায় নিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন। গত মার্চের শেষদিকের ওই ঘটনায় ব্রাজিলের মন্ত্রিসভায় ছয়টি বড় রদবদল ঘটে। একই সঙ্গে পদত্যাগ করেন তিন বাহিনীপ্রধানও। ওই সময় দেখা দেয়া রাজনৈতিক সংকটেরও বড় কারণ ছিল মহামারীকালীন অব্যবস্থাপনা ও টিকার সংকট। সে সময় জাইর বোলসোনারোকে অভিশংসনের প্রস্তাবও উঠেছিল।

কোনোমতে পতন ঠেকাতে তখন সক্ষম হলেও ব্রাজিলে করোনা পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গতকালও দেশটিতে ২৪ ঘণ্টায় মোট সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে ২৫ হাজার ২০০। মৃত্যু হয়েছে ৮৮৯ জনের। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত দেশটিতে সংক্রমণ শনাক্তের সংখ্যা ১ কোটি ৫২ লাখের বেশি। মৃত্যু দাঁড়িয়েছে সোয়া চার লাখের কাছাকাছি।

এ অবস্থায় এখনো টিকার সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারেনি জাইর বোলসোনারোর সরকার। অন্যদিকে দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি এ মুহূর্তে খুব একটা স্থিতিশীল নয়। বোলসোনারোর সরকারের অধীনে পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগও উঠেছে অহরহ। এছাড়া দেশটির সরকারের বিরুদ্ধে এর বাইরে আরো নানা অভিযোগ উঠেছে। সব মিলিয়ে ব্রাসিলিয়ার সরকার এখন বেশ নড়বড়ে অবস্থায় রয়েছে।

সৌজন্যে: দৈনিক বণিক বার্তা

এবিএন/জনি/জসিম/জেডি

এই বিভাগের আরো সংবাদ