আজকের শিরোনাম :

ভারতের লোকসভা নির্বাচন : আমাদের জন্য শিক্ষা

  সুভাষ সিংহ রায়

১২ মে ২০২৪, ০৯:৫৩ | অনলাইন সংস্করণ

কালে কালে ভারতের রাজনীতি বাংলাদেশের রাজনীতির একটা অনুষঙ্গ হয়ে যায়। অর্থাৎ বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘ভারত ফাক্টর’ অনেক পুরোনো। আর ভারতীয় রাজনীতিতে ছলাকলার অভাব নেই। কিন্তু যে বিষয়টা আমাদের জন্য শিক্ষণীয় যে দেড় মাসব্যাপী নির্বাচন হয় এবং ব্যালেট বাক্স বা ভোটসহ ইভিএম মেশিন নির্বাচন কমিশনের কাছে সংরক্ষিত থাকে। কোনো রাজনৈতিক দল এ বিষয়ে কখনও প্রশ্ন তোলে না। মাত্র একদিন আগে ৪ মে ভারতের বাংলা ‘দৈনিক আনন্দবাজার’ পত্রিকার একটা শিরোনাম ছিল ‘তৃণমূলের থেকে বিজেপিকে ভোট দেওয়া ভালো’! অধীরের সেই ভিডিও বিকৃত : পিটিআই প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি তথা বহরমপুরের কংগ্রেস প্রার্থী অধীর চৌধুরীর বক্তব্যের যে ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছিল সেটি বিকৃত বলে জানিয়েছে রাজ্য পুলিশ। এ খবর জানিয়েছে সর্বভারতীয় সংবাদ সংস্থা পিটিআই। রাজ্য পুলিশের তরফে জানানো হয়েছে, যে ভিডিওয় অধীরকে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘তৃণমূলের চেয়ে বিজেপিকে ভোট দেওয়াও ভালো’, সেটি বিকৃত। রাজ্য পুলিশের এক আধিকারিক পিটিআইকে জানান, রাজনৈতিক অভিসন্ধি নিয়ে অধীরের বক্তব্যের সম্পূর্ণ ভিডিওটির নির্দিষ্ট একটি অংশ সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। জঙ্গিপুর থানায় রাজ্য পুলিশের তরফে ভারতীয় দণ্ডবিধির ধারা ৪৯৯/৫০০ এবং তথ্যপ্রযুক্তি আইনে ধারা ৬৬ডি-তে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে বলেও ওই খবরে প্রকাশ। অর্থাৎ লোকসভা নির্বাচন নিয়ে চাতুরতার শেষ নেই। আমাদের সবারই জানে আছে ভারতের নির্বাচন মানেই মহাভারতের ‘অশ্বমেথ যজ্ঞ’। ভারতের নাগরিকরা ১৯ এপ্রিল থেকে পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য দেশটির সংসদ সদস্যদের নির্বাচন করতে শুরু করেছেন। এই নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একটানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় ফিরে আসার জন্য ভোটে লড়ছেন। বিভিন্ন জনমত জরিপে মি. মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি আর তার জোট সঙ্গীদের এগিয়ে রেখেছে। বিজেপি-র নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের বিপরীতে লড়াই করছে ‘ইন্ডিয়া’ জোট। কংগ্রেসসহ দু-ডজনেরও বেশি বিরোধী দল এই জোটে রয়েছে। প্রায় ১৪০ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারত বিশ্বের সব থেকে জনবহুল দেশ। এ-রকম একটা দেশের নির্বাচন-সংক্রান্ত সংখ্যাগুলোর দিকে তাকালে মাথা ঘুরে যেতে পারে। লোকসভার ৫৪৩ সদস্যকে নির্বাচন করতে ছয় সপ্তাহ ধরে সাত-দফায় ভোট নেওয়া হবে। নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হবে ৪ জুন। এই নির্বাচনে ভোটারের সংখ্যা ৯৬ কোটি ৯০ লাখ। একটা ধারণা দেওয়ার জন্য বলা যেতে পারে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, জাপান, যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল আর ফ্রান্সের জনসংখ্যার প্রায় সমসংখ্যক মানুষ ভারতের নির্বাচনের ভোটার তালিকায় রয়েছেন। ওইসব দেশের মিলিত জনসংখ্যা ভারতের ভোটারের সংখ্যার থেকে সামান্য কম, তাই ওই দেশগুলোর সঙ্গে বেলজিয়ামের জনসংখ্যাও জুড়ে দেওয়া যেতে পারে। এবারের ভোটারদের মধ্যে ৪৯ কোটি ৭০ লাখ পুরুষ এবং ৪৭ কোটি ১০ লাখ নারী। প্রথমবার ভোট দেবেন, অর্থাৎ যাদের বয়স ১৮-১৯ বছর, এমন ভোটার ১ কোটি ৮০ লাখ। প্রবীণ ভোটার, যাদের বয়স ৮৫ থেকে ৯৯ বছর, এ-রকম ৮২ লাখ মানুষের নাম আছে ভোটার তালিকায়। নিরাপত্তা আর ভোটের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার কারণেই নানা দফায় ভোট করানো হচ্ছে। বয়স্ক আর শারীরিক প্রতিবন্ধকতা আছে যাদের, তাদের বাড়িতে গিয়েও ভোট নেওয়ার ব্যবস্থা করেছে নির্বাচন কমিশন। মুখ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব কুমারের কথায়, ‘ভারতের প্রতিটি কোনায় গণতন্ত্রকে পৌঁছিয়ে দেওয়ার জন্য’ সারাদেশে ১৫ লাখ ভোটকেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে। মি. কুমার বলছেন, ‘একজন ভোটার জঙ্গলে বাস করুন অথবা তুষারাবৃত পাহাড়ে, আমাদের কর্মীরা বাড়তি পরিশ্রম করে হলেও প্রত্যেক ভোটারের কাছে পৌঁছবেন। আমরা ঘোড়া আর হাতি বা খচ্চরের পিঠে চেপেও যেমন যাব, তেমনই হেলিকপ্টারেও যাব। আমরা সব জায়গায় পৌঁছব।’ বেশিরভাগ ভোটগ্রহণ কেন্দ্রই স্কুল, কলেজ বা কমিনিউটি সেন্টারে হলেও বেশ কিছু অদ্ভুত জায়গাও বাছা হয়েছে বুথ তৈরির জন্য; যার মধ্যে রয়েছে জাহাজের কন্টেইনার, পাহাড়ের চূড়া বা জঙ্গলের মধ্যেও বুথ হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন যখন বলে যে ‘প্রত্যেক ভোটারই গুরুত্বপূর্ণ’ সেটা শুধু কথার কথা নয়। বিগত লোকসভা নির্বাচনে, ২০১৯ সালে পাঁচজন ভোটকর্মী বাসে চেপে আর তার পরে পায়ে হেঁটে দুদিন ধরে পৌঁছিয়েছিলেন এমন একটি বুথে, যেখানে মাত্র একজন ভোটার ছিলেন। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য অরুণাচল প্রদেশের ওই ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের একাকী ভোটার ছিলেন একজন ৩৯ বছর বয়সী নারী।

(২)
ভারতের যে কোনো বিষয়ে জ্যোতিষচর্চা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জ্যোতিষের ভবিষ্যদ্বাণী ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। এক জ্যোতিষী না-কি বলেছিলেন, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরিবিন্দ কেজরিওয়াল লোকসভা নির্বাচনের আগেই গ্রেফতার হবেন এবং তা মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে। এবং সত্যি সত্যি তাই হয়েছে। সেই জ্যোতিষী এখন বলছেন, এবারও নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হবেন। কিন্তু ২০২৭ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হবে উত্তর প্রদেশের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী আদি যোগিত্য নাথ। তার মানে ২০২৯ সালে পরবর্তী নির্বাচনের দু-বছর আগেই নির্বাচন হবে।
ভারতের নির্বাচন কমিশন বলেছে, জ্যোতিষী বা ট্যারো কার্ড রিড করে ভোটের ফলাফলের আগাম অনুমান প্রকাশ করা যাবে না। সংবাদমাধ্যমগুলোতেও ভোটের ফলাফল নিয়ে যেসব বুথ-ফেরত সমীক্ষা প্রকাশ করা হয়, সেটাও ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার আগে প্রকাশ করার ওপরে নিষেধাজ্ঞা আগে থেকেই আছে। এক নির্দেশিকায় কমিশন জানিয়েছে এ ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী জনপ্রতিনিধিত্ব আইনে আগে থেকেই নিষিদ্ধ ছিল। তবুও সদ্য-সমাপ্ত পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনে কিছু সংবাদমাধ্যম এবং বেশ কয়েকজন জ্যোতিষী নিয়ম ভেঙে এ ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী প্রকাশ করেছে। ভারতে জ্যোতিষীদের দিয়ে ভোটের ফলাফল নির্ধারণ এবং তা প্রকাশ করা অনেকদিন ধরেই চলে আসছে। এখন নির্বাচন কমিশন বলছে, কিছু সংবাদমাধ্যম ব্যবসায়িক কারণে প্রতিদ্বন্দ্বী চ্যানেল বা সংবাদপত্রের থেকে এগিয়ে থাকার জন্যই জ্যোতিষীদের দিয়ে ওইসব ভবিষ্যদ্বাণী করায়, যা বে-আইনি।
রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য হলো উত্তর প্রদেশ। সে-রাজ্যে ভোটার রয়েছেন প্রায় ২৪ কোটি। এটিই ভারতের সব থেকে জনবহুল রাজ্য আর এখান থেকেই সংসদে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সদস্য নির্বাচিত হন। বিশ্লেষকরা বলেন, দিল্লি যাওয়ার পথটা উত্তর প্রদেশ হয়েই যায়। এই রাজ্যে যে দল ভালো ফল করে, সাধারণত ভারত শাসন করে থাকে তারাই। এই রাজ্য থেকে ভারতের আটজন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে যখন প্রথম ক্ষমতায় আসেন, সে-বছর বিজেপি উত্তর প্রদেশের ৮০টির মধ্যে ৭১টি আসনে জিতেছিল। পরেরবার, ২০১৯ সালে অবশ্য বিজেপি-র জেতা আসনের সংখ্যাটা কমে ৬২ হয়েছিল। মি. মোদি ২০১৯ সালে প্রাচীন শহর বারানসী আসন থেকে জিতেছিলেন, এবারও তিনি ওই আসন থেকে ভোটে লড়ছেন। উত্তর প্রদেশ থেকে যেমন সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন, অন্যদিকে রয়েছে সিকিম, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম আর আন্দামান, লাক্ষাদ্বীপ এবং লাদাখের মতো কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলো, যার প্রতিটি থেকে মাত্র একজন করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। অন্য যেসব রাজ্য এবারের নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, তার মধ্যে আছে ৪২টি আসনের পশ্চিমবঙ্গ, ৪৮টি আসনের মহারাষ্ট্র, ৪০টি আসনের বিহার এবং ৩৯টি আসনের তামিলনাড়ু।

(৩)
লোকসভা ভোটের প্রচারে পশ্চিমবঙ্গে এসে সদ্য-চাকরি হারানো ‘যোগ্য প্রার্থীদের’ পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এই চাকরি হারানো ব্যক্তিদের আইনি সহায়তা দেওয়ারও প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। বর্ধমানের সাঁই কমপ্লেক্সে বিজেপি আয়োজিত এক নির্বাচনী জনসভায় এসব কথা বলেন নরেন্দ্র মোদি। পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনকে ছাপিয়ে এখন বড় আলোচনার বিষয় ২৬ হাজার শিক্ষকের চাকরি বাতিলের ঘটনা। গত ২৬ এপ্রিল চাকরি বাতিলের এ রায় দেন কলকাতার সুপ্রিমকোর্ট। চাকরি নিয়ে এই ব্যাপক দুর্নীতির কারণে উত্তাল হয়ে পড়ে রাজ্যের রাজনীতি। অভিযোগ আছে, লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে এই চাকরি বিক্রি করেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, শিক্ষা দপ্তরের কর্মকর্তা ও তৃণমূলের নেতারা। এরপর সিবিআই-এর অভিযানে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বান্ধবীর বাসভবন থেকে উদ্ধার হয় ৫০ কোটি রুপি। এখন পার্থসহ শিক্ষা দপ্তরের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা ও তৃণমূলের নেতা কারাগারে। সাঁই কমপ্লেক্সের নির্বাচনী প্রচার সভায় মোদি বলেছেন, যেসব শিক্ষক যোগ্য এবং সৎভাবে চাকরি পেয়েছিলেন, হাইকোর্টের নির্দেশে তাদের চাকরি যাওয়ার পর এবার তাদের পাশে এসে দাঁড়াবে বিজেপি। বিজেপি বাংলায় একটি লিগ্যাল সেল গঠন করে সহায়তা দেবে। প্রশ্ন করেন, পরের পাপে কেন তাদের ফল ভোগ করতে হবে? নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘ঈশ্বররূপী মানুষের ভালোবাসা পেয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমি আরাম করার জন্য জন্মাইনি। ১৪০ কোটি ভারতবাসীর জনসেবার সংকল্প নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি দিনরাত। শুধু নিজের জন্য বাঁচতে চাইনি। আত্মনির্ভর ভারত গড়ার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে চলেছি।’ নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘দেশ সবার জন্য এবং আত্মনির্ভর ভারত গড়া আমার স্বপ্ন, সেই স্বপ্ন নিয়ে আমি এগোতে চাই। আত্মনির্ভর ভারত গড়তে চাই। গরিবি হটাতে চাই। বিগত ১০ বছরে ২৫ কোটি মানুষকে দারিদ্র্যসীমার ওপরে তুলে আনা হয়েছে। এবার আমার স্বপ্ন ভারতবাসীকে আত্মনির্ভর হিসেবে গড়ে তোলা।’ মোদি বর্ধমান পূর্ব আসনের বিজেপি প্রার্থী লোকসংগীতশিল্পী অসীম সরকার এবং বর্ধমান-দুর্গাপুর আসনের প্রার্থী দিলীপ ঘোষের প্রচারের জন্য এ রাজ্যে আসেন। মোদি বলেন, ‘আমি ভয় পাই না। ভয় শব্দটি মোদির অভিধানে নেই। তৃণমূল-বাম দল বলছে মোদিকে গুলি করো, মোদির মাথায় লাঠি মারো।’
মোদি নদীয়ার তেহট্টে কৃষ্ণনগরের বিজেপি প্রার্থী কৃষ্ণনগরের রাজমাতা অমৃতা রায়ের নির্বাচনী সভায় যোগ দেন। সেখানে নরেন্দ্র মোদি বলেন, কংগ্রেস তো এবার আসন সংখ্যায় হাফ সেঞ্চুরি পার করতে পারবে না আর তৃণমূল গোটা দেশে ১৫টির বেশি আসন পাবে না। কেন্দ্রের সরকার গড়বে বিজেপি-র নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট। নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘বাম দলের লাল পতাকা এখন আর দেখা যায় না। আগে এই বাংলায় বামদের সূর্য অস্ত যেত না। এখন সারাদেশে জোর চর্চা, মোদি কি ৪০০ আসন পার করতে পারবে?’ বর্ধমান ও নদীয়ার সভা শেষ করে বীরভূমের বোলপুরে শেষ সভা করার কথা রয়েছে। বীরভূমের বোলপুরের বিজেপি প্রার্থী প্রিয়া সাহার সমর্থনে হবে এই সভা। স্তুত দক্ষিণ ভারতের মোট ৫টি রাজ্য (অন্ধ্র, তেলেঙ্গানা, কর্নাটক, তামিলনাড়ু ও কেরালা) ও একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল (পন্ডিচেরি) মিলে যে মোট ১৩০টি সংসদীয় আসন- বিদায়ী লোকসভায় বিজেপি-র দখলে ছিল তার মাত্র ২৯টি। এই ২৯টির মধ্যে ২৫টিই আবার কর্নাটক থেকে, আর বাকি ৪টি তেলেঙ্গানায়। কর্নাটকই দাক্ষিণাত্যের একমাত্র রাজ্য যেখানে বিজেপি এককভাবে কখনও সরকার গড়েছে, যদিও গত বছরের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস সেখানে জিতে আবার ক্ষমতায় ফিরেছে। তবে এবারের লোকসভা নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী মোদি নিজে বিজেপি জোটের জন্য ‘আব কি বার চারশো পার’ বা ৪০০-রও বেশি আসনের যে উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য বেঁধে দিয়েছেন, তার ধারেকাছে যেতে হলেও বিজেপি-কে দক্ষিণ ভারতে অনেক বেশি আসন পেতে হবে। কারণ উত্তর, পশ্চিম বা পূর্ব ভারতে যেসব রাজ্য বিজেপি-র দুর্গ বলে পরিচিত, সেখানে ইতোমধ্যে প্রায় সর্বোচ্চ সংখ্যক আসন তাদের ঝুলিতে, সেটা আর বাড়ানো কার্যত অসম্ভব। ফলে বিজেপি-র আসন বাড়ানোর একমাত্র সুযোগ কেবল দক্ষিণেই। অথচ ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস বলে, দাক্ষিণাত্য চিরকালই বিজেপি-র রাজনৈতিক ভাবধারা ও দর্শনকে প্রত্যাখ্যান করে এসেছে। শতকরা ভোটের হার বা আসন সংখ্যা, দুদিক থেকে এই রাজ্যগুলোতে বিজেপি-র প্রভাব বরাবরই ছিল নগণ্য।

(৪)
ভারতীয়রা কীসের ভিত্তিতে ভোট দেবেন? মি. মোদির তুরুপের তাস কী হবে? নতুন গড়ে তোলা বিশালাকার রাম মন্দির? অর্থনীতি, কর্মসংস্থানের চিন্তা বা কল্যাণকারী প্রকল্পগুলোর ওপরে ভিত্তি করেই কি ভোটাররা সিদ্ধান্ত নেবেন? না-কি জাত আর ধর্মের ভিত্তিতে ভোট দেবেন তারা? মনে করা হচ্ছে, উত্তরাঞ্চলীয় শহর অযোধ্যায় গড়ে ওঠা হিন্দুদের ভগবান রামের মন্দিরটি এবারের নির্বাচনী দৌড়ে নরেন্দ্র মোদিকে কিছুটা ঐশ্বরিক সহায়তা দিতে পারে। হিন্দুত্ববাদীরা ১৯৯২ সালে যে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে দিয়েছিল, সেই জায়গাতে গড়ে উঠেছে এই মন্দির। সেই ঘটনার পরে যে দাঙ্গা বেঁধেছিল, নিহত হয়েছিলেন প্রায় ২ হাজার মানুষ। এ বছর জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী ওই মন্দিরটির উদ্বোধন করেন। সই অনুষ্ঠান টিভিতে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছিল। স্কুল, কলেজ আর বেশিরভাগ অফিসও সেদিন ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছিল, যাতে মানুষ ওই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটা দেখতে পারেন। ভারতের স্বাধীনতার শতবর্ষ ‘২০৪৭ সালের মধ্যে উন্নত দেশ’ হিসেবে গড়ে তোলার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি, তা কি ভোটারদের মনে কোনো দাগ ফেলতে পারবে? বিশ্বের সব থেকে দ্রুত বাড়তে থাকা অর্থনীতির দেশ ভারত। দেশটির জিডিপি এখন সাড়ে ৩ লাখ কোটি মার্কিন ডলার। গত বছর যুক্তরাজ্যকে টপকিয়ে বিশ্বের পঞ্চম সব থেকে বড় অর্থনীতি হয়ে উঠেছে। আগামী তিন বছরের মধ্যে ভারতের অর্থনীতি হয়তো পৌঁছে যাবে ৭ লাখ কোটি মার্কিন ডলারে। আর সেটি সম্ভব হলে জাপান এবং জার্মানিকেও পেরিয়ে যাবে ভারতের অর্থনীতি। তাদের আগে থাকবে মাত্র দুটি দেশ- যুক্তরাষ্ট্র আর চীন। তবে ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ফল হাতে গোনা কয়েকজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। অর্থনৈতিক অসাম্য চোখে পড়ার মতো। বৈশ্বিক জনপ্রতি আয়ের দিক থেকে হিসাব করলে ভারতের স্থান ১৪০ নম্বরে। দেশটির ৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষ দিনে ১৭৯ ভারতীয় টাকারও কম আয় করেন। যদিও সরকারি নথিতে বলা হয় যে ‘চরম দারিদ্র্য’ অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। অনেক ভোটারের মাথাতে কর্মসংস্থান বিষয়টা থাকবে। তরুণ ভারতীয়দের মধ্যে থেকে ৭০-৮০ লাখ জন প্রতিবছর চাকরির বাজারে প্রবেশ করে থাকেন। কিন্তু আরও লাখ লাখ মানুষ কোনো কাজ জোটাতে পারেন না। সাম্প্রতিক সরকারি তথ্য অবশ্য বলছে, কর্মহীন মানুষের সংখ্যা কমছে এবং শ্রমিকের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। বিশ্লেষকরা অবশ্য বলছেন যে নতুন সৃষ্টি হওয়া বেশিরভাগ কাজই খুব কম বেতনের চাকরি। মানুষ যে সংকটে আছেন, তার একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় যখন দেখা যায় যে লাখ লাখ মানুষ সরকারের গ্রামীণ রোজগার প্রকল্পে নাম লেখাচ্ছেন। ওই প্রকল্পে কাজ করলে প্রতিদিন প্রায় আড়াইশো ভারতীয় টাকা পাওয়া যায়। আবার কয়েক হাজার মানুষ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোতেও কাজ করতে যেতে আগ্রহী হচ্ছেন।
আরেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্বাচনী বন্ড। নির্বাচনের অর্থায়নে স্বচ্ছতা আনতে যে নির্বাচনী বন্ড ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল, সম্প্রতি ভারতের সুপ্রিমকোর্ট সেটিকে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। কারা ওই নির্বাচনী বন্ড কিনেছে আর কোন দল কত অর্থ পেয়েছে, সেই তথ্য প্রকাশ করার জন্য সরকারি ব্যাংক স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়াকে নির্দেশ দিয়েছিলেন শীর্ষ আদালত। সেই তথ্য সামনে আসতেই দেখা যায় যে নির্বাচনী বন্ড থেকে সব থেকে লাভবান হয়েছে বিজেপি। দলটি ২০১৮ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে যে ১২০০ কোটি ভারতীয় টাকার নির্বাচনী বন্ড বিক্রি হয়েছিল, তার অর্ধেকই পেয়েছিল বিজেপি।
নানা কেন্দ্রীয় এজেন্সির তদন্তের মুখে পড়া অনেক সংস্থাই নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে বিজেপি-কে অর্থ জুগিয়েছিল বলে একাধিক প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে। বিরোধী দলগুলো নির্বাচনী বন্ডের ব্যবস্থাকে ‘ভারতের ইতিহাসে সব থেকে বড় দুর্নীতি’ বলে আখ্যা দিয়ে অভিযোগ করে যে এজেন্সিগুলোকে দিয়ে তোলাবাজি করানো হয়েছে। তবে সরকারের মন্ত্রীরা অবশ্য সেসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। ভারতের কল্যাণমুখী প্রকল্পগুলোর পরিমাণ দেখলে বিস্মিত হতে হয়। নরেন্দ্র মোদির সরকার দাবি করে যে তারা প্রায় ৯০ কোটি গরিব মানুষকে সহায়তা দেওয়ার জন্য কয়েক লাখ কোটি ভারতীয় টাকা খরচ করেছে। বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরাও কল্যাণমুখী প্রকল্পে প্রচুর অর্থায়ন করে থাকেন। কিন্তু ওই বিনামূল্যের এক বস্তা চাল বা টয়লেট বানানোর জন্য অর্থ সহায়তা কি একটি দলকে ভোট এনে দেবে? বিশ্লেষকরা অবশ্য বলেন, এ ধরনের প্রকল্প হয়তো ভোট পেতে সহায়তা করে; কিন্তু তা একমাত্র ফ্যাক্টর না হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি।

(৫)
রাহুল গান্ধী কখনও মন্ত্রী হননি; কিন্তু সবচেয়ে পরিচিত বিরোধী নেতা। তবে তার রাজনৈতিক পরিচয়ের অনেকটাই বংশ পরম্পরায় পাওয়া, দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু থেকে শুরু করে তার ঠাকুমা এবং বাবা দুজনেই প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। বিগত এক দশকে বিজেপি-র যত উত্থান হয়েছে, ততই মি. গান্ধীর দল কংগ্রেস ততই ক্ষীণ হয়েছে। তার রাজনৈতিক জীবনের গোড়ার দিকে সমালোচকরা তাকে ‘অনিচ্ছুক রাজপুত্র’ বলে আখ্যা দিত। সেই আখ্যা ঘোচাতে তিনি যথেষ্ট পরিশ্রম করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে দেশব্যাপী দুটি পদযাত্রা, যার মাধ্যমে তিনি ‘হিংসা ও দ্বেষের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের ঐক্যবদ্ধ’ করার প্রয়াস নিয়েছিলেন। জনমত সমীক্ষাগুলো অবশ্য কংগ্রেসকে বিজেপি-র অনেক পিছনে ফেলেছে। প্রায় এক দশক আগে যখন কংগ্রেস শেষবার সরকারে আসীন ছিল, তখন মি. গান্ধীর মা সোনিয়া গান্ধীকে ভারতের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী নারী বলে মনে করা হতো। তবে গত কয়েক বছরে ৭৭ বছর বয়সী মিসেস গান্ধীর যেমন শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়েছেন, তেমনই রাজনীতিতে তার প্রভাবও কমেছে। এ বছর জানুয়ারি মাসে মিসেস গান্ধী সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় নির্বাচিত হয়েছেন, তাই এই লোকসভা নির্বাচনে তিনি লড়াই করছেন না। গান্ধী পরিবারের আরও একটি নাম প্রতি নির্বাচনের আগেই আলোচনায় উঠে আসে। তিনি হলেন মিসেস গান্ধীর কন্যা প্রিয়াংকা। যদিও তিনি কখনও লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী হননি। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মতোই অনেকটা দেখতে প্রিয়াংকা গান্ধী অবশ্য কংগ্রেসের হয়ে নির্বাচনী প্রচার চালান আর মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার কারণে প্রশংসিতও হন। এবারও তার সমর্থকদের মধ্যে থেকে দাবি উঠেছিল যে তিনি যেন নির্বাচনে দাঁড়ান। বিরোধী নেতাদের মধ্যে আর যার নাম আলোচনায় রয়েছে, তিনি হলেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। তিনি এখন অবশ্য গ্রেফতার হয়ে জেলে রয়েছেন। তিনি প্রথম প্রচারের আলোয় উঠে এসেছিলেন দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনকারী হিসেবে। তার দল আম আদমি পার্টি বিজেপি আর কংগ্রেসকে হারিয়ে একটানা তিনবার দিল্লির শাসন ক্ষমতায় আছে। আবার পাঞ্জাবেও ওই দলটি সরকার চালায়। এ বছর মার্চ মাসে আরও কয়েকজন দলীয় সিনিয়র নেতাদের মতো গ্রেফতার হন। দুর্নীতির অভিযোগ তিনি অস্বীকার করে বলে থাকেন যে তার সরকারের ওপরে প্রতিশোধ নেওয়া হচ্ছে। মি. কেজরিওয়ালের সমর্থকদের মনে একটা আশঙ্কা আছে যে তার গ্রেফতারির ফলে দলের প্রচারণায় সমস্যা তৈরি হবে।

সুভাষ সিংহ রায় : রাজনৈতিক বিশ্লেষক; সাবেক সহ-সভাপতি- বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিল, প্রধান সম্পাদক- সাপ্তাহিক বাংলা বিচিত্রা ও এবিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম।

এই বিভাগের আরো সংবাদ