আজকের শিরোনাম :

বিএনপির ২৮ অক্টোবর মহড়া

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৭ নভেম্বর ২০২৩, ১২:৪৭

পাঠক খেয়াল করে দেখবেন, লেখার শিরোনাম ‘বিএনপির ২৮ অক্টোবর মহড়া’ বোধগম্য কারণে করেছি। কারণ ‘কর্মসূচি’ আর ‘মহড়া’র মধ্যে গুণগত পার্থক্য আছে। একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে—২০০৪ সালের ১১ ডিসেম্বর দৈনিক প্রথম আলোর একটা বড় শিরোনাম ছিল ‘৫০ লাখ মানুষের ১০৫০ কিমি মানববন্ধন’। পাঠক নিশ্চয়ই স্মরণে আনতে পারবেন, ২০০৩-০৪ সালের দিনগুলো কেমন ছিল। সে বছরের ২১ আগস্ট ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছিল। সে বছর আওয়ামী লীগের আন্দোলনের যে কাঠামো ছিল, তা এই উদাহরণ দেখলে বোঝা যায়। এ কারণে আওয়ামী লীগের সেই কর্মসূচিকে বলছি, আন্দোলনের কর্মসূচি আর বিএনপির গতকালের কর্মসূচিকে বলছি মহড়া। ১৭ বছর বিএনপি ক্ষমতার বাইরে, তাই তাদের মধ্যে ক্ষমতায় যাওয়ার উদগ্র বাসনা।

বিগত ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নানা ধরনের কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। যতটা না নিয়মতান্ত্রিক পথে হেঁটেছে, তার চেয়ে বেশি অনিয়মতান্ত্রিক পথে হেঁটেছে। ২০২২ সালের ৮ অক্টোবর বিএনপি নেতা আমানউল্লাহ আমান ঘোষণা করেছিলেন, সেই বছর ১০ ডিসেম্বরের পর থেকে দেশ চলবে খালেদা জিয়ার কথায়। তারপর পরপর কয়েকদিন বিএনপির অন্য নেতারা আরও আগ বাড়িয়ে হুংকার দিয়েছিলেন। শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, জয়নাল আবদিন ফারুক প্রমুখের বক্তব্য ছিল আরও ঝাঁজালো। সে সময় বিএনপি নেতারা সরকারকে মাত্র দুমাস সময় দিয়েছিলেন। যখন এই লেখা লিখছি, তখন বিএনপির সেই ঘোষণার পর এক বছর ২০ দিন পার হয়েছে। তাদের ডাকা ২৮ অক্টোবরের কর্মসূচির অন্যতম খিচুড়ি রান্না ও বিতরণ কর্মসূচি চলছে এবং যথারীতি গণমাধ্যমে তা প্রকাশিত হচ্ছে। ইউটিউবাররা তা যথারীতি একটার পর একটা ভিডিও আপলোড করছে এবং যথারীতি দেশে সরকারের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে চলেছে।

কমাস ধরে বিএনপির পক্ষে কিছু সুধীজন সরকারের বিরুদ্ধে আদাজল খেয়ে নেমে গেছে। বিএনপির নেতারা যখন ‘ভগবান, অবতার’ (তাদের ভাষায়)-এর সন্ধান পেয়ে গেছেন, তাদের সুধীজন তখন আর বসে থাকবেন কেন? তারা সরকারের যাচ্ছেতাই সমালোচনা করছেন, যা কোনোভাবে বলা উচিত নয়, সেটাও বলে যাচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘কাঁচা সমালোচনা গালিগালাজ’ আর ঠিক আমাদের সমাজে যত সমালোচনা দেখবেন, তার অধিকাংশ কাঁচা সমালোচনা। যারা বিএনপির হয়ে আওয়ামী লীগের সমালোচনা করেন, তার বেশিরভাগই কাঁচা সমালোচনা করে থাকেন। তারা কি ভেবে দেখেন, কী ভয়ংকর ছিল বিএনপির শাসনামল? জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের এক অসাধারণ গানের কথা আমরা জানি—‘এ কোন সকাল, রাতের চেয়েও অন্ধকার’। বিএনপির শাসনামলের অনেক দিনই ছিল রাতের চেয়েও অন্ধকার। পৈশাচিক তাণ্ডব পাশবিক—এসব শব্দবন্ধ প্রায়ই ব্যবহৃত হয় কোনো ঘটনার নৃশংসতা এবং বীভৎসতা বোঝাতে গিয়ে। নবারুণ ভট্টাচার্যের একটি কবিতা আছে, সেখানে একটা লাইন আছে—‘এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না’।

২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত জামায়াত-বিএনপি এদেশ শাসন করেছে এবং সেক্ষেত্রে তারা কতটা গণবিরোধী কর্মকাণ্ড চালিয়েছে, তা ইতিহাসের পাতায় রয়ে গেছে। বিএনপিমনা মানুষের কথাবার্তায় মনে হয়, বিএনপির শাসনামলে গণতন্ত্র ছিল। তাদের বলব, ২০০১ সালের ১ অক্টোবর থেকে টানা সাড়ে তিন বছরের দৈনিক পত্রিকাগুলোয় জামায়াত-বিএনপির নির্যাতনের ছবি এবং অধিকাংশ পত্রিকা সেদিন অনেক সংবাদ প্রকাশ করেনি বা প্রকাশ করতে পারেনি। ২০০১ সালে এদেশে অক্টোবর এসেছিল ‘ভয়ংকর অক্টোবর’ হিসেবে। আওয়ামী লীগের ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ অফিসে ‘নোঙরখানা’ খুলতে হয়েছিল। হিন্দু সম্প্রদায় শারদীয় দুর্গোৎসব পালন করতে পারেনি। সারা বাংলাদেশে কোথাও প্রতিমা গড়া হয়নি, সেবার হয়েছিল ঘটপূজা। দেশব্যাপী ঘটপূজার আন্দোলন হয়েছিল। ভয়ংকর ভয়ংকর সব কথা অনেক বলা যাবে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সারা দেশে বাড়িতে রাত্রিযাপন করতে পারেনি। তখনকার অনেক সুধীজন পত্রিকায় প্রবন্ধ লেখেননি। এখন বাংলাদেশে নাকি গণতন্ত্র নেই, বাকস্বাধীনতা নেই, আগে কী ধরনের গণতন্ত্র ছিল সে কথা একবারও বলেন না।

নির্বাচন ব্যবস্থা ও বহুদলীয় পরিস্থিতি, সরকারে সক্রিয়তা, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং নাগরিক অধিকার- এই পাঁচ মানদণ্ডে তৈরি বিশ্ব গণতন্ত্র সূচকে এক লাফে বাংলাদেশের আট ধাপ অগ্রগতি হয়েছে। এ পরিসংখ্যান গত দুবছর আগের। ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিনের গবেষণা প্রতিষ্ঠান দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ‘বিশ্ব গণতন্ত্র সূচক’ প্রকাশ করেছে। বিশ্বের ১৬৫টি দেশ ও দুটি ভূ-খণ্ডের এই সূচকে সেই বছরে আট ধাপ এগোল। ২০০৬ সাল থেকে এই সূচক প্রকাশ করে আসছে ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। ওই পাঁচ মানদণ্ডে একটি দেশের পরিস্থিতি বিবেচনা করে প্রতি সূচকের পূর্ণমান ২ ধরে ১০ স্কোরের ভিত্তিতে এই সূচক তৈরি করে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি। সব মানদণ্ডের সূচক মিলিয়ে কোনো দেশের গড় স্কোর যদি ৮-এর বেশি হয়, তাহলে সেদেশে ‘পূর্ণ গণতন্ত্র’ রয়েছে বলে বিবেচনা করা হয়। ৬ থেকে ৮-এর মধ্যে স্কোর হলে সেটাকে ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, স্কোর ৪ থেকে ৬-এর মধ্যে থাকলে ধরে নেওয়া হয় ‘মিশ্র শাসন’ (হাইব্রিড রেজিম)। আর স্কোর ৪-এর নিচে হলে সেদেশে ‘স্বৈরশাসন’ চলছে বলে ধরে নেওয়া হয়।

২০২২ সালে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৫ দশমিক ৯৯; তার আগের বছর বাংলাদেশের স্কোর ৫ দশমিক ৮৮, যা তার আগের বছর এই স্কোর ছিল ৫ দশমিক ৫৭। আর ২০১৮ সালে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৫ দশমিক ৪৩। ক্রমাগতভাবে বাংলাদেশ গণতন্ত্রের সূচকে দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে। বাংলাদেশের ২০২৩ সালে প্রকাশিত ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ডেমোক্রেসি ইনডেক্সে ১০-এর মধ্যে ২ দশমিক ৯ স্কোর নিয়ে কম্বোডিয়ার অবস্থান ১৩০তম। আর লিবারেল ডেমোক্রেসি ইনডেক্সে শূন্য দশমিক ০৭ স্কোর নিয়ে কম্বোডিয়ার অবস্থান ১৬০তম। অন্যদিকে ৬ দশমিক শূন্য শূন্য স্কোর নিয়ে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ডেমোক্রেসি ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান ৭১তম। তার মানে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ডেমোক্রেসি ইনডেক্সে বাংলাদেশ ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রের দ্বারপ্রান্তে। আর মাত্র শূন্য দশমিক ০১ স্কোর করলে ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রের কাতারে শামিল হবে বাংলাদেশ, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশও রয়েছে। এশীয়-অস্ট্রেলীয় অঞ্চলের বিপুলসংখ্যক দেশের হাইব্রিড শাসনের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫তম। উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের বাইরে বাংলাদেশের রয়েছে সর্বোচ্চ আঞ্চলিক গড়। আরেকটি বিষয় নিয়ে বিএনপি ও বিএনপিঘেঁষা বিজ্ঞজন জোরালো কণ্ঠে কথা বলে থাকেন, দেশের অর্থনীতির অব্যবস্থাপনা নিয়ে দারুণভাবে উৎকণ্ঠিত। কিন্তু একথা বলে না, ২০০৬ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতি ছিল ৭৫ বিলিয়ন ডলারের আর এখন ৫০০ বিলিয়ন ডলার ছুঁইছুঁই। ঋণখেলাপি নিয়ে কথা হয় এবং কথা হওয়াটা স্বাভাবিক। ঋণখেলাপি দেশের বিকাশমান অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এই অব্যবস্থাপনা এক দিনের কিংবা ১৫ বছরের বিষয় নয়। কারা কোন আমলে এই খারাপ বিষয়গুলোর সুবিধা নিয়েছিল?

ড্যান্ডি ডায়িংয়ের ঋণখেলাপি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, তার বড় ছেলে তারেক রহমানসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছিলেন বিজ্ঞ আদালত। মামলার অন্য বিবাদীরা হলেন ড্যান্ডি ডায়িং লিমিটেড, আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান, দুই মেয়ে জাফিয়া রহমান ও জাহিয়া রহমান, খালেদার ভাই প্রয়াত সাঈদ ইস্কান্দারের ছেলে শামস ইস্কান্দার, সাফিন ইস্কান্দার, মেয়ে সুমাইয়া ইস্কান্দার, স্ত্রী নাসরিন আহমেদ, তারেকের বন্ধু বিতর্কিত ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন আল মামুন ও তার স্ত্রী শাহিনা বেগম। মামলার আরজিতে বলা হয়, ১৯৯২ সালে ৩ কোটি টাকার মূলধন নিয়ে যাত্রা শুরু করে ড্যান্ডি ডায়িং লিমিটেড। ১৯৯৩ সালের ৫ মে সোনালী ব্যাংক থেকে ১৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা ঋণ নেন বিবাদীরা। এরপর ১৯৯৬ সালে সাঈদ ইস্কান্দারের আবেদনে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আবার ঋণ মঞ্জুর করে। ২০১০ সালের ৪ এপ্রিল ড্যান্ডি ডায়িংকে দেওয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪২ কোটি ৬৯ লাখ ৯৭ হাজার টাকা। বারবার তাগিদ দেওয়ার পরও ঋণ পরিশোধ করেননি বিবাদীরা। এর আগে ২০০১ সালে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠানটির ১২ কোটি ১৬ লাখ টাকার ঋণের জন্য প্রযোজ্য সুদ মওকুফ করেছিল। তাহলে দেখা যাচ্ছে, গোটা পরিবারই ঋণখেলাপি। বিএনপির যতবারই ক্ষমতায় এসেছে, খালেদা জিয়ার পরিবারের জন্য ব্যাংক ঋণ অনুমোদন এবং ঋণের সুদ মওকুফ করা হয়েছে। অথচ বিএনপির নেতারা সবসময় ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে কথা বলছে। কোনো কোনো বিজ্ঞজন বিএনপির সঙ্গে তাল মিলিয়ে কথা বলতে দেখছি এবং ২৮ অক্টোবরের মতো মহড়াকে কেন্দ্র করে আরও জোরেসোরে বলা শুরু করেছে। দেশের আপামর জনগণ সবই জানেন, বোঝেন এবং পার্থক্যও বোঝেন। ২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশের মহড়া আর ২৮ অক্টোবর কর্ণফুলী নদীর তলদেশে দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ ‘বঙ্গবন্ধু টানেল’-এর উদ্বোধন। মানুষ বুঝেশুনে সিদ্ধান্ত নেবেন।

 

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক; সাবেক সহ-সভাপতি- বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিল, প্রধান সম্পাদক- সাপ্তাহিক বাংলা বিচিত্রা ও এবিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম।

এই বিভাগের আরো সংবাদ