আজকের শিরোনাম :

সংগ্রাম – স্বাধীনতা প্রেরণায় বঙ্গমাতা 

  সুভাষ সিংহ রায়

০৮ আগস্ট ২০২৩, ১৬:২৮ | অনলাইন সংস্করণ

শক্তিমান রাজনীতিবিদ ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জনাব জিল্লুর রহমান বঙ্গভবনে এক বক্তৃতায় মহাত্মা গান্ধীর স্ত্রী কস্তুরবাঈ, জহরলাল নেহেরুর স্ত্রী কমলা এবং দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী বাসন্তী দেবীর সাথে তুলনা করতে গিয়ে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে ‘বঙ্গমাতা’ অভিধায় ভূষিত করেন।শিষ্য তরুণ শেখ মুজিব রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নজরে পড়েছিল। ১৯৪৬-এ বিহারে দাঙ্গা উপদ্রুত অঞ্চলে তিনি শেখ মুজিবকে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তার আগে টুঙ্গিপাড়ার গ্রামের বাড়িতে অসুস্থ স্ত্রীর অনুমতি নিতে বলেছিলেন। স্ত্রী রেণু চিঠি লিখেছিলেন, যাতে তার পূর্ণ সম্মতি ছিল। চিঠির ভাষা প্রণিধানযোগ্য : “আপনি শুধু আমার স্বামী হওয়ার জন্য জন্ম নেননি, দেশের কাজ করার জন্যও জন্ম নিয়েছেন। দেশের কাজই আপনার সবচাইতে বড় কাজ। আপনি নিশ্চিত মনে সেই কাজে যান। আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আল্লার উপর আমার ভার ছেড়ে দেন।” এ চিঠির মর্মার্থ অবহিত হবার পর সোহরাওয়ার্দী মন্তব্য করতে বাধ্য হয়েছিলেন, “মুজিব, সে তোমার জন্য স্রষ্টার দেওয়া অতি অমূল্য দান। অনুগ্রহ করে তাকে অবহেলা কোরো না।” (Mujib, she is a very precious gift to you from God. Don't neglect her, please.) মুজিব কোনোদিন রেণুকে অবহেলা/উপেক্ষা করেননি; এমন মানসিকতা তার ছিল না বা তার সুযোগও তিনি পাননি।
কৈশোরেই কীভাবে শেখ মুজিব ও ফজিলাতুন্নেছার বিয়ে হয়, এ ব্যাপারে অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বলা হয়েছে-“একটা ঘটনা লেখা দরকার, নিশ্চয়ই অনেকে আশ্চর্য হবেন। আমার যখন বিবাহ হয়, তখন আমার বয়স ১২-১৩ বছর হতে পারে। রেণুর বাবা মারা যাওয়ার পরে ওর দাদা আমার আব্বাকে ডেকে বললেন, ‘তোমার বড় ছেলের সাথে আমার এক নাতনীর বিবাহ দিতে হবে। কারণ, আমি সমস্ত সম্পত্তি ওদের দুই বোনকে লিখে দিয়ে যাব।’ রেণুর দাদা আমার আব্বার চাচা। মুরব্বির হুকুম মানার জন্যই রেণুর সাথে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হল। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। তখন কিছুই বুঝতাম না, রেণুর বয়স তখন বোধহয় তিন বছর হবে। রেণুর যখন পাঁচ বছর বয়স, তখন তার মা মারা যান। একমাত্র রইল তার দাদা। দাদাও রেণুর সাত বছর বয়সে মারা যান। তারপর সে আমার মায়ের কাছে চলে আসে। আমার ভাইবোনদের সাথেই রেণু বড় হয়। রেণুর বড়বোনেরও আমার আরেক চাচাতো ভাইয়ের সাথে বিবাহ হয়। এরা আমার শ^শুরবাড়িতে থাকল, কারণ আমার ও রেণুর বাড়ির দরকার নাই। রেণুদের ঘর আমাদের ঘর পাশাপাশি ছিল, মধ্যে মাত্র দুই হাত ব্যবধান।” তিনি লিখেছেন, “অতিথিদের খাবার বন্দোবস্ত করার জন্য আমার মা ও স্ত্রী গ্রামের বাড়ি থেকে গোপালগঞ্জের বাড়িতে এসেছে তিন দিন হলো। আমার শরীরও খারাপ হয়ে পড়েছে অত্যধিক পরিশ্রমে। বিকেলে ভয়ানক জ¦র হলো।... রেণু কয়েকদিন আমাকে খুব সেবা করল। যদিও আমাদের বিবাহ হয়েছে ছোটবেলায়। ১৯৪২ সালে আমাদের ফুলশয্যা হয়। জ¦র একটু ভালো হলো। কলকাতা যাব, পরীক্ষাও নিকটবর্তী।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ৭-৮)
সময়ে সময়ে বঙ্গবন্ধুর অর্থের প্রয়োজন হলে কীভাবে ফজিলাতুন্নেছা হাত বাড়িয়ে দিতেন, এমনকি তিনি নিজে বেশিদূর লেখাপড়া না করলেও বঙ্গবন্ধুর শিক্ষার ব্যাপারে কতটা যতœবান ছিলেন, তাও আমরা দেখি বঙ্গবন্ধুর স্বীকারোক্তি থেকে-“আব্বা ছাড়াও মায়ের কাছ থেকেও আমি টাকা নিতে পারতাম। আর সময় সময় রেণুও আমাকে কিছু টাকা দিতে পারত। রেণু যা কিছু জোগাড় করত, বাড়ি গেলে এবং দরকার হলে আমাকেই দিত। কোনোদিন আপত্তি করে নাই, নিজে মোটেই খরচ করত না। গ্রামের বাড়িতে থাকত, আমার জন্যই রাখত।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ২১)

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়ার পরের ঘটনা কীভাবে সামলান এই সংগ্রামী নারী, তা দেখা যেতে পারে বঙ্গবন্ধুর জবানিতে-“বাসায় এসে দেখলাম, রেণু এখনও ভাল করে সংসার পাততে পারে নাই। তাকে বললাম, ‘আর বোধহয় দরকার হবে না। কারণ মন্ত্রিত্ব ভেঙে দিবে, আর আমাকেও গ্রেফতার করবে। ঢাকায় কোথায় থাকবা, বোধহয় বাড়িই চলে যেতে হবে। আমার কাছে থাকবা বলে এসেছিলা, ঢাকায় ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ হবে, তা বোধ হয় হল না। নিজের হাতের টাকা-পয়সাগুলিও খরচ করে ফেলেছ।’ রেণু ভাবতে লাগল, আমি গোসল করে ভাত খেয়ে একটু বিশ্রাম করছিলাম। বেলা তিনটায় টেলিফোন এল, কেন্দ্রীয় সরকার ৯২(ক) ধারা জারি করেছে। মন্ত্রিসভা বরখাস্ত করা হয়েছে।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ২৭০)

কারাগারের রোজনামচা গ্রন্থে ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর ঘটনাবহুল জেল-জীবনচিত্র স্থান পেয়েছে। এই গ্রন্থেও বঙ্গবন্ধু তাঁর সহধর্মিণী ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের প্রসঙ্গ এনেছেন বারবার। বঙ্গবন্ধুর জেলে থাকার সময়কালে তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে জেলে আসতেন স্ত্রী। ১৫ জুন ১৯৬৬ তারিখে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “সাড়ে চারটায় জেলের লোক এসে বলল-চলুন, আপনার দেখা আসিয়াছে, আপনার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে বসে আছে জেল অফিসে। তাড়াতাড়ি রওয়ানা করলাম। দূর থেকে দেখি রাসেল, রেহানা ও হাচিনা চেয়ে আছে আমার রাস্তার দিকে। ১৮ মাসের রাসেল জেল অফিসে এসে একটুও হাসে না-যে পর্যন্ত আমাকে না দেখে। দেখলাম দূর থেকে পূর্বের মতোই ‘আব্বা আব্বা’ বলে চিৎকার করছে। জেলগেট দিয়ে একটা মালবোঝাই ট্রাক ঢুকেছিল। আমি তাই জানালায় দাঁড়াইয়া ওকে আদর করলাম। একটু পরেই ভিতরে যেতেই রাসেল আমার গলা ধরে হেসে দিল। ওরা বলল, আমি না আসা পর্যন্ত শুধু জানালার দিকে চেয়ে থাকে, বলে আব্বার বাড়ি। এখন ওর ধারণা হয়েছে, এটা ওর ‘আব্বার বাড়ি’। যাবার সময় হলে ওকে ফাঁকি দিতে হয়। ছোট মেয়েটার শুধু একটা আবদার। সে আমার কাছে থাকবে। আর কেমন করে কোথায় থাকি, তা দেখবে।... কে বুঝবে আমাদের মতো রাজনৈতিক বন্দিদের বুকের ব্যথা। আমার ছেলেমেয়েদের তো থাকা-খাওয়ার চিন্তা করতে হবে না। এমন অনেক লোক আছে, যাদের স্ত্রীদের ভিক্ষা করে, পরের বাড়ি খেটে, এমনকি ইজ্জত দিয়েও সংসার চালাতে হয়েছে। জীবনে অনেক রাজবন্দির স্ত্রী বা ছেলেমেয়ের চিঠি পড়ার সুযোগ আমার হয়েছে। সে-করুণ কাহিনি কল্পনা করতেও ভয় হয়।” (কারাগারের রোজনামচা, পৃ. ৯৩-৯৪)
কারাগারের রোজনামচা গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আরও লিখেছেন : “জেল কারাগারে সাক্ষাৎ করতে যারা যায় নাই তারা বুঝতে পারে না সেটা কি বেদনাদায়ক ও মর্মান্তিক। ভুক্তভোগীরা কিছু বুঝতে পারে।... এই সাক্ষাৎকে প্রহসনও বলা চলে।” (পৃষ্ঠা : ১৯৬-৯৭) একই গ্রন্থের ৪০ পৃষ্ঠায় আমরা দেখতে পাই বঙ্গবন্ধু সেখানে লিখেছেন : “আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় একজন আইবি কর্মচারী বসে থাকত, আর জেলের পক্ষ থেকেও একজন ডিপুটি জেলার উপস্থিত থাকতেন।... স্ত্রীর সাথে স্বামীর অনেক কথা থাকে কিন্তু বলার উপায় নেই। আমার মাঝে মাঝে মনে হতো স্ত্রীকে নিষেধ করে দেই যাতে না আসে। ১৯৪৯ সাল থেকে ’৫২ সাল পর্যন্ত আমার স্ত্রীকে নিষেধ করে দিয়েছিলাম ঢাকায় আসতে, কারণ ও তখন তার দুইটা ছেলেমেয়ে নিয়ে দেশের বাড়ি থাকত।”
এরপর তিনি গ্রেফতার হন ওই বছরেরই (১৯৪৯) শেষদিনে। কারাগারে থাকেন দুই বছরের বেশি-১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত। বঙ্গবন্ধু নিজেই লিখেছেন-স্ত্রীকে ঢাকা কারাগারে সাক্ষাৎপ্রার্থী হতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু স্ত্রী ও পিতামাতার মন কি মানে? এই জেল-জীবনের একপর্যায়ে ১৯৫০ সালের শেষদিকে একটি মামলায় বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা থেকে গোপালগঞ্জের আদালতে হাজির করার জন্য স্টিমারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন : মধুমতি নদীর পাটগাতি স্টিমার ঘাটে নামার পর খবর মেলে-“পূর্বের রাতে আমার মা, আব্বা, রেণু ছেলেমেয়ে নিয়ে ঢাকায় রওয়ানা হয়ে গেছেন আমাকে দেখতে। এক জাহাজে আমি এসেছি। আর এক জাহাজে ওরা ঢাকা গিয়েছে। দুই জাহাজের দেখাও হয়েছে একই নদীতে। শুধুু দেখা হল না আমাদের। এক বৎসর দেখি না ওদের। মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল।” (পৃষ্ঠা : ১৭৬)। ত্রিশ বছরের যুবক তখন বঙ্গবন্ধু। স্ত্রীর বয়স ২০ বছর। ‘কারাগারের রোজনামচা’য় লিখেছেন : “নিষ্ঠুর কর্মচারীরা বোঝে না যে স্ত্রীর সাথে দেখা হলে আর কিছু না হউক একটা চুমু দিতে অনেকেরই ইচ্ছা হয়, কিন্তু উপায় কি?” (পৃষ্ঠা : ৪০)

গোপালগঞ্জের আদালতে এ মামলা চলাকালে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব-পরিবারের সদস্যদের নিয়ে থানায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কয়েকবার সাক্ষাতের সুযোগ পান। এ প্রসঙ্গে একটি মর্মস্পর্শী বিবরণ রয়েছে অসমাপ্ত আত্মজীবনীর পৃষ্ঠা ১৮৩-১৮৪ পৃষ্ঠায় এভাবে-“আব্বা, মা, রেণু খবর পেয়ে সেখানেই আসলেন।... কামাল কিছুতেই আমার কাছে আসল না। দূর থেকে চেয়ে থাকে। ও বোধ হয় ভাবত, এ লোকটা কে?” ১৮৫ পৃষ্ঠায় আরেকবার সাক্ষাতের ঘটনা লিখেছেন এভাবে-“হাচু আমাকে মোটেই ছাড়তে চায় না। আজকাল বিদায় নেওয়ার সময় কাঁদতে শুরু করে। কামালও আমার কাছে এখন আসে। হাচু ‘আব্বা’ বলে দেখে কামালও ‘আব্বা’ বলতে শুরু করেছে।” ১৯১ পৃষ্ঠাতেও রয়েছে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বেগম মুজিবের সাক্ষাতের বিবরণ। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন : “রেণু আমাকে যখন একাকী পেল, বলল, ‘জেলে থাক আপত্তি নাই, তবে স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখ। তোমাকে দেখে আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেছে’।’’

কতটা কষ্টের জীবন বেছে নিয়েছিলেন ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, জানতে পারি গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে। ১৯৫৩ সালের ১৪ মে গোয়েন্দারা ‘অসাধারণ দক্ষতায়’ জিপিও থেকে ‘আটক’ করে একটি চিঠি, যাতে ৫ মে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন-“স্নেহের রেণু। আজ খবর পেলাম তোমার একটি ছেলে হয়েছে। তোমাকে ধন্যবাদ। খুব ব্যস্ত, একটু পরে ট্রেনে উঠব। ইতি তোমার মুজিব।” (গোয়েন্দা রিপোর্ট, তৃতীয় খ-, পৃষ্ঠা : ২৩৩)। বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় পুত্র শেখ জামালের জন্মের পর লেখা এ চিঠিটি কি প্রাপক বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কাছে পৌঁছেছিল? পৌঁছালে চিঠিটা চোখের জলে কতটা সিক্ত হয়েছিল? গোয়েন্দা রিপোর্ট থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু ৫ মে ঢাকার ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন থেকে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীসহ ঈশ্বরদীগামী ট্রেনে ওঠেন। ৬ মে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ মাঠের জনসভায় ভাষণ দেন। (গোয়েন্দা রিপোর্ট, তৃতীয় খ-, পৃষ্ঠা : ২২৪)

বঙ্গবন্ধুর স্থান হয় কারাগারে। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয় : “৫ জুন আতাউর রহমান খান ও বেগম শেখ মুজিবুর রহমান বিচারাধীন বন্দি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সাক্ষাৎ করেন। এ সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান স্ত্রীকে গ্রামের বাড়িতে চলে যেতে এবং সন্তানদের যত্ন নিতে বলেন।” (গোয়েন্দা রিপোর্ট, চতুর্থ খ-, পৃষ্ঠা : ৪১-৪২)

সামরিক শাসনামলে জেলগেটে দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে ৩০ অক্টোবর। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বরাবরের মতোই বলা হয়-কোনো রাজনৈতিক আলোচনা হয়নি। পরের সাক্ষাতের তারিখ ছিল ২০ নভেম্বর। বেগম ফজিলাতুন্নেছা এবং হাসিনা, কামাল ও জামালের সঙ্গে ছিলেন রেহানা। এই প্রথমবারের মতো কারাগার-দর্শন ঘটে শিশু রেহানার-আবেদনে বয়স লেখা : ২ বছর। শেখ হাসিনার বয়স লেখা : ১০ বছর ১১ মাস (আনুমানিক)। পরের সাক্ষাৎ ছিল ২৮ নভেম্বর। গোয়েন্দা রিপোর্টে বলা হয়, বেগম মুজিব তাঁর স্বামীকে সাক্ষাতের সময় বলেন, সিদ্ধেশ্বরী এলাকার কোয়ার্টারে সন্তানদের নিয়ে বসবাস করা সম্ভব নয়। এলাকাটি ঝোপ-জঙ্গলে ভরা। পানির কষ্ট। তিনি দালালদের মাধ্যমে নতুন একটি বাড়ি ভাড়া নিতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সকলে বলছে-শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারকে বাড়ি ভাড়া দিলে বিপদ হবে। শেখ মুজিব স্ত্রীকে বলেন, উপযুক্ত বাড়ি না পেলে ছেলেমেয়েদের ফাইনাল পরীক্ষার পর যেন টুঙ্গিপাড়া গ্রামের বাড়ি চলে যায়। এ সময়ে পিস্তলের লাইসেন্স নবায়ন কিংবা সরকারের কাছে হস্তান্তর এবং ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় সরকারের কাছ যে জমি কেনা হয়েছে, তার কিস্তির টাকা পরিশোধের বিষয়েও আলোচনা হয়। পরের সাক্ষাতে (৬ ডিসেম্বর ১৯৫৮) বেগম মুজিবের সঙ্গী ছিলেন কেবল শেখ জামাল। এ মাসেই আরও দুবার ১৭ ও ২১ ডিসেম্বর বেগম মুজিব জেলগেটে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। ৬ জানুয়ারির (১৯৫৯) সাক্ষাতের সময় সন্তানদের মধ্যে কেবল শেখ কামাল উপস্থিত ছিলেন। এ সময় একজন আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন, যার সাহায্যে বঙ্গবন্ধু অ্যান্টিকরাপশন বিভাগের চাহিদা অনুযায়ী সম্পত্তির বিবরণ তৈরি করেন।

২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতারের পূর্বমুহূর্তে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার বার্তা ছড়িয়ে দেন সর্বত্র। তাঁকে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে বরণ করে নিতে হয় কঠোর সামরিক প্রহরায় গৃহবন্দির দুঃসহ জীবন। এমন ভয়ংকর পরিস্থিতিতেও তিনি মুষড়ে পড়েন না, শত্রুর কাছে নতিস্বীকার করেন না। জনগণের জন্য প্রেরণা হয়ে থাকার কর্তব্য ভোলেন না। তিনি দুই পুত্র শেখ কামাল ও শেখ জামালকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণ করেন। বড়মেয়ে শেখ হাসিনা ও তাঁর নবজাত সন্তান জয় এবং নিজের অন্য দুই সন্তান শেখ রেহানা ও শেখ রাসেলকে পরম মমতায় আগলে রাখেন। প্রিয়তম স্বামী শত্রুরাষ্ট্র পাকিস্তানের কারাগারে।

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল তাঁর কবিতায় লিখেছিলেন : “বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।” বেগম মুজিবের জীবনী বিশ্লেষণে আমরা বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই কবিতার যথার্থ প্রতিফলন দেখতে পাই। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতিটি ধাপে বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী হিসেবে নয়, একজন নীরব দক্ষ সংগঠক হিসেবে যিনি নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে ভূমিকা রেখেছেন এবং বঙ্গবন্ধুকে হিমালয়-সম আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন তিনি বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।

কালের বিবর্তনে সেই শেখ মুজিবকে যিনি জাতির পিতা বানিয়েছিলেন, ছায়ার মতো সারাজীবন ছিলেন পাশে, জুগিয়েছেন অনুপ্রেরণা, বানিয়েছেন জাতির পিতা, তিনি বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। বঙ্গমাতা ছিলেন মনে-প্রাণে একজন আদর্শ নারী। বিচক্ষণ উপদেষ্টা ও পরামর্শকারী, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের আদর্শ ভাবী।

দেশের অনেক, এমনকি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নেতারা বেগম মুজিবের কাছে আসতেন দেখা করতে, পরামর্শ নিতে, নির্দেশনা জানতে। আইয়ুব খান ভুট্টোকে মন্ত্রিত্ব থেকে বের করে দিলে তিনিও ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাসায় ছুটে আসেন। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা এলে পর্দার আড়াল থেকে তাদের সঙ্গে কথা বলতেন বেগম মুজিব। কখনোই সামনে আসতেন না। ছেলেমেয়েদের বলতেন, “ওদের সাথে তো আর আমরা থাকব না, কেন দেখা করব? ওদের চেহারাও আমার দেখতে ইচ্ছা করে না।” বঙ্গবন্ধু এমএনএ, এমপি-মন্ত্রী থাকাকালে অনেকবার করাচি গেছেন। বেগম মুজিব একবারের জন্যও তাঁর সঙ্গী হন নাই। কখনও যেতে চাইতেন না। সবার আগে তিনিই বুঝেছিলেন এদেশ স্বাধীন হয়ে যাবে। তাঁর মধ্যে এই চেতনা অত্যন্ত তীব্র ছিল এবং বিশ্বাসও ছিল।

১৯৬৬ সালে ৬-দফা দেওয়ার পর বঙ্গবন্ধু প্রথম তিন মাসে আটবার গ্রেফতার হন। পাকিস্তান সরকার ৮ মে বঙ্গবন্ধুকে আবার গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করে। ৭ জুন ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ও আটক নেতাদের মুক্তির দাবিতে হরতাল সফলভাবে পালনে বেগম মুজিবের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি লুকিয়ে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে তাদের ছোটফুফুর ফ্ল্যাট বাসায় চলে যেতেন। ওখানে গিয়ে নিজের স্যান্ডেল বদলাতেন, কাপড় বদলে, বোরকা পরে একটা স্কুটার ভাড়া করে ঢাকায়  পড়ুয়া ছোটভাইকে নিয়ে ছাত্রনেতা আর আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করতেন। আন্দোলন চালাবে কীভাবে তার পরামর্শ, নির্দেশনা তিনি নিজেই দিতেন। আবার ওই বাসায় ফিরে এসে পোশাক বদল করে ছেলেমেয়েদের নিয়ে নিজের বাসায় ফিরতেন। বঙ্গবন্ধু ও আটক নেতাদের মুক্তির দাবিতে সারাদেশে হরতাল যাতে পালিত হয় এবং চলমান আন্দোলনের সফলতার জন্য তিনি নিরলস কাজ করে যেতেন। সবই করতেন গোপনে এবং রাজনৈতিক মেধায়।

আগরতলা মামলা নিষ্পত্তির জন্য প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান লাহোরে গোলটেবিল বৈঠক ডাকেন। প্রস্তাব দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধুকে জেল থেকে ছাড়া হবে প্যারোলে। বেগম মুজিব স্বামীর কাছে খবর পাঠালেন যেন তাঁর সঙ্গে পরামর্শ না করে তিনি কোনো সিদ্ধান্ত না নেন। জানালেন দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ আছে। মামলা তুলে বঙ্গবন্ধুসহ বন্দি ৩৫ জনের সবাইকে মুক্তি দিলেই গোলটেবিল বৈঠক হতে পারে, অন্যথা একা যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। নানা প্রতিকূলতা অতিক্রম করে যে দূরদর্শিতা তিনি সেদিন দেখিয়েছিলেন, তা পরবর্তী সময়ে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের পথের নির্দেশনা দিয়েছিল।

১০ জানুয়ারি ১৯৭২-এর রাতে একাকিত্বে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে তিনি বলেছিলেন, “তুমি ফিরে এসেছ সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ, আমি উল্লসিত; কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত ধূসর প্রান্তরে, ধ্বংসপ্রাপ্ত গ্রাম, ক্ষুধার্ত শিশু, বিবস্ত্র নারী আর হতাশাগ্রস্ত পুরুষ এবং সন্তানহারা জনক-জননী তোমার প্রতীক্ষায়।” শত কর্মব্যস্ততার মাঝেও তিনি নিজ হাতে রান্না করে খাইয়েছেন ভাসানীসহ দেশ-বিদেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের, যা সম্পূর্ণ ইতিহাস, আদর্শ বাঙালি নারীর প্রতিকৃতি।

এমনও দিন গেছে মামলা চালাতে গিয়ে তাঁর কাগজপত্র, উকিল জোগাড় করতে অনেক খরচ হয়ে গেছে। এদিকে বাজারও করতে পারেননি। কোনোদিন বলেননি যে টাকা নাই, বাজার করতে পারলাম না। চাল-ডাল দিয়ে খিচুড়ি রান্না করেছেন। আচার দিয়ে ছেলেমেয়েদের বলেছেন যে প্রতিদিন ভাত-মাছ খেতে ভালো লাগে না-কি? আসো, আজকে আমরা গরিব খিচুড়ি খাই, এটা খেতে খুব মজা। একজন মানুষ, তাঁর চরিত্র কতটা সুদৃঢ় থাকলে যে-কোনো অবস্থা মোকাবিলা করার মতো ক্ষমতা ধারণ করতে পারেন! বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে পদে পদে তিনি আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করার ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে গেছেন। প্রকাশ্যে প্রচারে কখনোই আসেননি।

বঙ্গমাতা কতটা দৃঢ় মনোবলের অধিকারী ছিলেন সেটি বোঝা যায় এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া বক্তব্যে। ওই বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, “মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস আম্মার যে মনোবল দেখেছি, তা ছিল কল্পনাতীত। স্বামীকে পাকিস্তানিরা ধরে নিয়ে গেছে। দুই ছেলে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করছে। তিন সন্তানসহ তিনি গৃহবন্দি। যোগাযোগ একেবারে বিচ্ছিন্ন; কিন্তু আম্মা মনোবল হারাননি।”

পাকিস্তানিরা ৩২ নম্বরের বাড়িতে আক্রমণ করবে, এ আশঙ্কায় বঙ্গবন্ধু মার্চের প্রথম দিকে ড. ওয়াজেদ মিয়াকে আলাদা একটি বাসা ভাড়া নেওয়ার পরামর্শ দেন। ধানমন্ডি ও হাতিরপুল এলাকায় একাধিক বাড়ি দেখার পর ওয়াজেদ মিয়া ও শেখ হাসিনা ধানমন্ডির ১৫ নম্বর (বর্তমান ৮/এ) রোডের ১৭৭ নম্বর বাড়ির নিচতলা ভাড়া নেন। ২৫ মার্চ রাতে ড. ওয়াজেদ মিয়া, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এই বাড়িতে ছিলেন। এদিকে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হওয়ার পর বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা শেখ জামাল ও শেখ রাসেলকে নিয়ে তাদের পাশের বাড়িতে আশ্রয় নেন। ২৭ মার্চ বঙ্গমাতা, ড. ওয়াজেদ মিয়া, শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল ধানমন্ডি এলাকা ছেড়ে খিলগাঁও এলাকার একটি ভাড়া করা বাড়িতে ওঠেন। সেখানে কিছুদিন থাকার পর মগবাজারে যান, এখানে প্রথমে একটি বাড়ির নিচতলায় এবং পরে অন্য একটি বাড়ির দোতলায় আত্মগোপনে ছিলেন। মগবাজার থেকে ১২ মে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের আটক করে ধানম-ির ১৮ নম্বর (বর্তমান ৯/এ) রোডের ২৬ নম্বর বাড়িতে বন্দি করে রাখে। এই বাড়িতে কোনো আসবাব ও বিদ্যুৎ ছিল না। ৯ মাস তাঁদের ফ্লোরে থাকতে হয়। এই বাড়িতে বন্দিকালে ২৭ জুলাই সজীব ওয়াজেদ জয়ের জন্ম হয়। এখান থেকে ৫ আগস্ট পালিয়ে গিয়ে শেখ জামাল মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টো কর্তৃক বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেওয়ার ঘোষণা ৪ জানুয়ারি (১৯৭২) শোনার পর বঙ্গমাতা ধানম-ির ১৮ নম্বর (বর্তমান ৯/এ) রোডের ২৩ নম্বর বাড়িটি ভাড়া নেন। ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু এই বাড়িতে ওঠেন। পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক বিধ্বস্ত ৩২ নম্বরের বাড়ি মেরামতের পর বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষের দিক থেকে নিজের বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরে বাংলাদেশে যখন বিজয়ের পতাকা উড়ছে, ধানম-ির ১৮ নম্বর সড়কের বাড়িতে তখনও অবরুদ্ধ ছিলেন বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যরা।

১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১, স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের দ্বিতীয় দিন। ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানে মুখরিত দেশ। আজকের মতো সেদিনটিও ছিল শুক্রবার।

সকালবেলা। বিজয়ের ১৬ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে তখনও বন্দি। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর ১০ সদস্যের সশস্ত্র সেনাদল বেগম মুজিবসহ অন্যদের ধানম-ির ১৮ নম্বর সড়কের একটি বাড়িতে জিম্মি করে রাখে। বেগম মুজিবের সঙ্গে বাইরের সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়।

২০ ডিসেম্বর ১৯৭১, দৈনিক ইত্তেফাক-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে থেকে জানা যায়, ১৫ ও ১৬ ডিসেম্বর বেগম মুজিব ও তাঁর পরিবারকে কোনো খাবার দেওয়া হয়নি। এমনকি বাড়িতে নড়াচড়া পর্যন্ত করতে দেওয়া হয়নি। ১৭ ডিসেম্বর সকালে বাড়ির সামনে কয়েকজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই খবর পেয়ে ভারতীয় বাহিনীর মেজর অশোক তারার (পরে কর্নেল) নেতৃত্বে মিত্রবাহিনীর একটি দল ১৮ নম্বর সড়কের ওই বাড়িতে পৌঁছান। এ সময় হানাদার বাহিনীর দলটি গুলি করতে উদ্যত হয় এবং হুমকি দেয় যে তাদের আক্রমণ করা হলে তারা বেগম মুজিবসহ অন্যদের হত্যা করবে। তখনকার বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে মেজর তারা বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের পথ বেছে নেন। নিরস্ত্র হয়ে ১৮ নম্বর সড়কের বাড়ি ভেতরে প্রবেশ করেন তিনি। এরপর মেজর তারা অত্যন্ত কুশলী ভাষায় দখলদার বাহিনীকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান। তাদের বুঝান যে, নিজেদের মঙ্গলের জন্যই তাদের আত্মসমর্পণ করা উচিত।

২০১৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত শুভজ্যোতি ঘোষের প্রতিবেদনে মেজর তারার স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, সেদিন বাড়িটিতে থাকা হানাদার সেনারা মারাত্মক খুনের মেজাজে ছিল। বাড়িটির কিছু দূরেই গুলিবিদ্ধ একটি গাড়ি, তার ভেতরে একজন সাংবাদিকের লাশ দেখতে পান মেজর তারা। লাশটি থেকে তখনও রক্ত ঝরছিল। ওই সাংবাদিক বাড়িটির দিকে এগোনোর চেষ্টা করলে হানাদার বাহিনী তাঁকে গুলি করে। আর আশপাশের লোকজন মেজর তারাকে জানিয়েছিল, আরও সকালের দিকে স্থানীয় একটি পরিবারকেও গুলি করে জখম করে হানাদারেরা সৈন্যরা। স্মৃতিচারণে মেজর তারা বলেন, “আমি তখন দেখলাম, সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার চালানোই একমাত্র রাস্তা। শেখ মুজিবের পরিবারকে বাঁচাতে হলে সেই মুহূর্তে আমার সামনে আর কোনো পথও ছিল না।... আমি হুমকির জবাবে জানালাম, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কমান্ডাররা গতকালই আত্মসমর্পণ করেছে, কাজেই তারাও অস্ত্র ফেলে দিলেই ভালো করবে। মনে হলো ওই সৈন্যদের কাছে আত্মসমর্পণের কোনো খবর পৌঁছায়নি।... একেবারে সামনে আসতেই গেটে যে সেন্ট্রি ছিল, সে তার বন্দুকের সামনে লাগানো ধারালো বেয়নেটটা আমার শরীরে ঠেকিয়ে ধরল।... বললাম, আমি ইন্ডিয়ার আর্মির একজন অফিসার।... একেবারে নিরস্ত্র অবস্থায় আমি একলা তোমাদের এখানে এসেছি। তারপরও কি তোমরা বুঝতে পারছ না সব খেলা চুকে গেছে? তখনই আমাদের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটা হেলিকপ্টার। আমি সঙ্গে সঙ্গে আঙ্গুল তুলে বললাম, ‘তোমরা কি ওই হেলিকপ্টার দেখতে পাচ্ছ? বুঝতে পাচ্ছ কি ঢাকার নিয়ন্ত্রণ এখন কাদের হাতে?’”
এরপরও পাকিস্তানি সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করতে গড়িমসি করে এবং সময় নেয়। মেজর তারা বুঝতে পারেন যে মনস্তাত্ত্বিক সমরে শত্রুপক্ষকে তিনি ধীরে ধীরে ঘায়েল করতে সক্ষম হচ্ছেন। তিনি সতর্কতার সঙ্গে একের পর এক কথার অস্ত্র চালিয়ে যেতে থাকেন। সবশেষে চূড়ান্ত শব্দাস্ত্রটি প্রয়োগ করে বলেন, “এখনই সেরেন্ডার করলে আমি ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তোমাদের কথা দিচ্ছি, অক্ষত শরীরে তোমরা নিজেদের হেডকোয়ার্টারে ফিরে যেতে পারবে। আর না করলে তোমাদের লাশের যে কী হবে, তার কিন্তু কোনো গ্যারান্টি নেই।” পরে পাকিস্তানি সৈন্যরা অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করে। প্রাণে রক্ষা পান বেগম মুজিব ও তাঁর স্বজনরা। মেজর অশোক তারার স্মৃতিচারণে আরও উল্লেখ আছে, ওই বাড়িতে শিশুপুত্র কোলে শেখ হাসিনা ও তার ছোটবোন শেখ রেহানাও ছিলেন। তাঁরা সবাই মেজর তারার অত্যন্ত কুশলী এই কথোপকথন শুনতে পান। উদ্ধারের পর মেজর তারাকে তাঁরা কৃতজ্ঞতা জানান।

১৮ নম্বর সড়কের সেই বাড়িতে তখনও পাকিস্তানের পতাকা উড়ছিল। এ-সময় বঙ্গবন্ধুর ফুফাতো ভাই মমিনুল হক খোকা মেজর তারাকে বাংলাদেশের একটি পতাকা এনে দেন। মেজর তারা বাড়ির ছাদ থেকে পাকিস্তানের পতাকা ছুড়ে ফেলে বাংলাদেশের পতাকা উড়ান। পাকিস্তানের পতাকাটি মাটিতে পড়তেই বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সেটিকে পায়ের নিচে পিষে চিৎকার করে বলেন, “জয় বাংলা।”

পরবর্তীকালে বেগম মুজিবও মেজর তারার প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের কথা উল্লেখ করে প্রশংসা করেন। পরে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেজর অশোক তারাকে বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়ে কৃতজ্ঞতা জানান। একাত্তরে অনবদ্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালে মেজর অশোক তারাকে ‘বন্ধু সম্মাননা’ প্রদান করে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরার কাছে সংঘটিত ‘ব্যাটল অব গঙ্গাসাগর’-এ বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি ভারতের ‘বীরচক্র’ খেতাব পান।

(বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ৯৩তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত স্মরণিকায় সুভাষ সিংহ রায়ের লেখা বিশেষ নিবন্ধ)


লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক; সাবেক সহ-সভাপতি- বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিল, প্রধান সম্পাদক- সাপ্তাহিক বাংলা বিচিত্রা ও এবিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম।

এই বিভাগের আরো সংবাদ