আজকের শিরোনাম :

বিএনপির যত ভুল

  সুভাষ সিংহ রায়

০৮ মে ২০২২, ০৯:৩৬ | অনলাইন সংস্করণ

সুভাষ সিংহ রায় 
বিএনপির বয়স একেবারে কম নয়; দেখতে দেখতে ৪৪ বছর হয়ে গেল। কিন্তু এ দল এখন পর্যন্ত কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন হলো না। ক'দিন আগে বিএনপির একজন যুগ্ম মহাসচিব দুর্নীতি দমন কমিশনের  সচিবের কাছে দুর্নীতিবিষয়ক দুটি 'প্রমাণপত্র' দিয়ে এসেছেন। এর মধ্যে একটি হচ্ছে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারিবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানে কথোপকথন। সেখানে অডিওতে সরকারের দু'জন ব্যক্তি 'ইনফোসরকার' বিষয়ক কথা বলছিলেন এবং 'এলটিএম'বিষয়ক অগ্রগতি নিয়ে কথা হচ্ছিল। এটা নিয়ে দু'চারটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলা হয়েছিল, 'এলটিএম' হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের কোম্পানি। এই হচ্ছে বিএনপির অবস্থা! 'এলটিএম' মানে হচ্ছে- 'লিমিটেড  টেন্ডারিং মেথড'।

অনেকেরই মনে থাকবে, বিএনপি ২০১৯ সালে একবার প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনের গেটে আরেকটি বিষয় নিয়ে হাজির হয়েছিল। বিষয়টা ছিল সরকার সংবিধানের ১৪৫ক ধারা লঙ্ঘন করেছে। এবার দেখা যাক 'আন্তর্জাতিক চুক্তি' শিরোনামে সংবিধানের ১৪৫ক ধারায় কী বলা হয়েছে- 'বিদেশের সহিত সম্পাদিত সব  চুক্তি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করা হইবে, এবং রাষ্ট্রপতি তাহা সংসদে পেশ করিবার ব্যবস্থা করিবেন।'

বিএনপির অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরের সময় ফেনী নদীর পানি বণ্টন নিয়ে ভারতের সঙ্গে চুক্তি করেছেন এবং তা সংসদে উপস্থাপিত হয়নি। বিএনপি খতিয়ে দেখল না যে, বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ভারত সরকারের ফেনী নদীর পানি নিয়ে কোনো চুক্তি আদৌ হয়েছে কিনা। যেটা হয়েছিল সেটা 'সমঝোতা'; আর 'সমঝোতা' হলে সেটা সংসদে উপস্থাপনের কোনো প্রয়োজন হয় না। এই সামান্য বিষয়টুকু বোঝার সক্ষমতা বিএনপির এখনও হয়নি। 
বিএনপি হঠাৎ সরব হয়ে উঠল এই বলে যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির মামলায় পরাজয় হয়েছে। কিন্তু আসল ঘটনাটি কী ছিল? গত ৮ এপ্রিল নিউইয়র্ক কাউন্টি সুপ্রিম কোর্ট আলোচ্য মামলার আংশিক রায় ঘোষণা করেন। ২০২১ সালের ১৪ জুলাই অনুষ্ঠিত শুনানির ভিত্তিতে ওই রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় অভিযুক্ত ২০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দুটি ক্যাসিনো প্রতিষ্ঠানকে (ব্লুমবেরি ও ইস্টার্ন হাইওয়ে) অব্যাহতি দেওয়া হয়। তবে আদালত থেকে কিম অংয়ের অব্যাহতির আবেদন নাকচ করে দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের অভিযোগের জবাব দিতে বলা হয়েছে। তা ছাড়া গত ১৪ অক্টোবর শুনানিসংশ্নিষ্ট আলোচ্য মামলার অন্যতম বিবাদী রিজল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশন-আরসিবিসি, লরেঞ্জো তান ও রাউল তানের বিষয়ে আদালত এখনও কোনো রায় দেননি বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র।

রিজার্ভের চুরি যাওয়া অর্থের বড় একটি অংশ উদ্ধারে নিউইয়র্কের আদালতে বাংলাদেশ ব্যাংকের করা মামলা খারিজ হয়ে গেছে বলে ফিলিপাইনের সংবাদমাধ্যমেও নাকি  খবর বেরিয়েছে। বলা হয়েছে, নিউইয়র্কের সুপ্রিম কোর্ট রায়ে 'পর্যাপ্ত এখতিয়ার নেই' উল্লেখ করে তিন বছর আগে করা বাংলাদেশ ব্যাংকের এ মামলা খারিজ করে দিয়েছেন। এর সূত্র কী? বিশ্বজুড়ে আর্থিক খাতে সাইবার হ্যাকিংয়ের চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় ২০১৯ সালে এ মামলায় পক্ষভুক্ত ফিলিপাইনের একটি ক্যাসিনো মালিকের প্রতিষ্ঠানের বরাত দিয়ে দেশটির এনকোয়ারার ও ফিলস্টার এ খবর প্রকাশ  করে।

সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক 'বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট- রিকভারি অ্যান্ড রেজিলিয়েন্স এমিড গ্লোবাল আনসার্টেইনটি' প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে- ২০২০ সালের তুলনায় বাংলাদেশে ২০২১ সালে দারিদ্র্যে শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ কমেছে এবং দারিদ্র্য যেখানে আগে ১২ দশমিক ৫ শতাংশ ছিল, সেটি এখন ১১ দশমিক ৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অথচ বিএনপি নেতারা হরহামেশা বলে যাচ্ছেন, গত দুই বছরে বাংলাদেশের দুই কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী আক্ষেপ করে বলেছেন- দেশে শক্তিশালী বিরোধী দলের অভাব। এক দশকের অধিক সময় বিএনপি আত্মহননমনস্কতা দিয়ে প্রমাণ করেছে- দলটি কখনোই শক্তিশালী বিরোধী দল হতে চায়নি। কেননা, দলটি শুধু ক্ষমতায় বিশ্বাসী। বিরোধী দল শক্তিশালী হলে ক্ষমতায় না থেকেও যে গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে এবং দেশের জন্য কাজ করতে পারে, তার একটা উদাহরণ দেওয়া যাক।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে নৌবাহিনী অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে কোস্টগার্ডের ভূমিকা পালন করত। এতে তার নিজস্ব কর্মকাণ্ড ব্যাহত হতো এবং কিছু আইনি সমস্যা সৃষ্টি হতো। এ সমস্যা নিরসনে সরকার একটি কোস্টগার্ড গঠনের জন্য সংসদে আইন পাস করে, যা কোস্টগার্ড অ্যাক্ট ১৯৯৪ নামে পরিচিত। কোস্টগার্ড বিলটি সংসদে উত্থাপন করেছিল তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। কেননা, উত্থাপিত বিষয়ে বিএনপি গুরুত্বই দেয়নি; তাদের সংসদ সদস্যদের কেউ কেউ অনুপস্থিত ছিলেন। তখনকার বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার  সৃজনশীলতা ও দক্ষতায় স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলী সংসদ অধিবেশন সেদিনকার মতো মুলতবি করতে পারেননি। প্রায় দু'দশক পর সমুদ্রসীমা জয়লাভের পর আবার প্রমাণিত হয়েছিল- 'কোস্টগার্ড' আইন কত জরুরি ছিল।

মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির পর ২০১৪ সালের ৭ জুলাই আবারও বাংলাদেশের বিজয় দেখেছে বিশ্ববাসী। প্রতিপক্ষ সেবার ছিল ভারত। বঙ্গোপসাগরে দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে চলা সমুদ্রসীমা নিয়ে এ বিরোধের অবসান ঘটায় বাংলাদেশ লাভ করেছে একটি স্থায়ী সমুদ্রসীমা, যার আয়তন ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কি.মি.। গত ১৩ বছরের ইতিহাসে বিএনপি ওই একবারই সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছিল। কিন্তু মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই সে অভিনন্দন প্রত্যাহার করেছিল।
ভারতের আইনসভায় স্থল সীমান্ত চুক্তি পাস হওয়ার পর ৬৮ বছরের ছিটমহল ও অপদখলীয় ভূমি সমস্যার সমাধান হয়েছে। এটি আওয়ামী লীগ সরকারের কূটনৈতিক সাফল্য। ছিটমহল বিনিময়ের ফলে ভারত যে প্রায় ১০ হাজার একর জমি বেশি হারিয়েছিল এবং সে জন্য কোনো ক্ষতিপূরণ পাবে না বলে ২০১১ সালে দুই দেশের স্বাক্ষরিত প্রটোকলে উল্লেখ রয়েছে। এতে ভারত অপদখলীয় ২৭৭৭ একর জমির মালিকানা পায়। আর ২২৬৭ একর জমির ওপর বাংলাদেশের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়।
কারও কারও মনে থাকার কথা, ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তিন দিনের সফরে ভারত গিয়েছিলেন।  কিন্তু  সেখানে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে ফারাক্কা, তিস্তা এবং অমীমাংসিত সীমানা প্রশ্নে কোনো আলোচনা করতে পারেননি। ফারাক্কা নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কিনা- দেশে ফিরে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন- 'প্রসঙ্গটি ভুলে গিয়েছিলাম।'

এমন ডজন ডজন ঘটনার উল্লেখ করা যাবে, যেখানে বিএনপি নিজের ক্ষতি করেছে; দেশের তো ক্ষতি করেছেই। যেমন ক্ষমতায় থেকে, তেমনই বিরোধী দলে থেকেও ভুলের পর ভুল করে গেছে বিএনপি।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক; সাবেক সহ-সভাপতি- বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিল, প্রধান সম্পাদক- সাপ্তাহিক বাংলা বিচিত্রা ও এবিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম।

এই বিভাগের আরো সংবাদ