আজকের শিরোনাম :

মুক্তিযুদ্ধ প্রতিদিন : ৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৮ ডিসেম্বর ২০২১, ২০:৪০

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা নিয়ে ‌‘মুক্তিযুদ্ধ প্রতিদিন’ নামের এই আয়োজন।

এবিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম পাঠকদের জন্য মুক্তিযুদ্ধের আজকের দিনে (৮ ডিসেম্বর) ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার বিবরণ তুলে ধরা হল-

দিল্লিতে একজন সরকারি মুখপাত্র ৮ ডিসেম্বর বলেন, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব কোনো চাপের মুখেই ভারত মানবে না। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাংলাদেশ সরকারকে ভারত একটি বৈধ সরকার বলে মনে করে।

ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার রাজনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত কমিটির বৈঠকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর সর্বশেষ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। বৈঠকে সবাই একমত হন যে বাংলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতির স্বীকৃতি ছাড়া পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তে কোনো যুদ্ধবিরতি মানা সম্ভব নয়। 

দিল্লিতে একজন সরকারি মুখপাত্র সাংবাদিকদের বলেন, ভারত উপমহাদেশে যুদ্ধ বাধার আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন নতুন কোনো প্রস্তাব করেছিলেন বলে ভারতের জানা নেই। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য দেশকে ভারত বারবার বলেছে, রাজনৈতিক সমাধান করার একমাত্র উপায় শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে নির্বাচিত সহকর্মীদের সঙ্গে তাঁকে আলোচনা করতে দেওয়া।

জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের অনুরোধে এদিন তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। পরে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগা শাহিও উ থান্টের সঙ্গে দেখা করেন। উ থান্ট ভারত উপমহাদেশের পরিস্থিতিতে উদ্বেগ জানান। জাতিসংঘের লোকজন ও বিদেশি নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনীয় সাহায্যের জন্য দুই দেশের সরকারকেও অনুরোধ জানানো হয়।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিতে দেশটির কোয়ালিশন মন্ত্রিসভার সহকারী প্রধানমন্ত্রী এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টির সভাপতি জুলফিকার আলী ভুট্টো নিউইয়র্কের পথে রওনা দেন।

বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভুটানের রাজা জিগমে দর্জি ওয়াংচুকের কাছে এক ধন্যবাদ বার্তায় বলেন, বাংলাদেশ-ভুটান বন্ধুত্বের সম্পর্ক ভবিষ্যতে আরও সুদৃঢ় হবে।

বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এক বেতার ভাষণে বলেন, মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় সেনারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করছেন। ভারত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি জানিয়েছে। বাংলাদেশের সর্বশ্রেণির জনসাধারণের পক্ষে এ বিজয় তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের, বিজয় তাদের মুক্তিবাহিনীর। ইন্দিরা গান্ধীর প্রজ্ঞায় বাঙালি কৃতজ্ঞতা বোধ করছে। তিনি বলেন, উপমহাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবটি অন্ধতার পরিচায়ক। চীনও নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছে। প্রস্তাবে ভেটো প্রয়োগ করায় সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি বাংলাদেশ কৃতজ্ঞ।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী অধিকৃত বাংলাদেশের রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর অগ্রযাত্রা এদিনও অব্যাহত থাকে। বিমানঘাঁটিসহ কুমিল্লা শহর এরই মধ্যে পাকিস্তানি সেনামুক্ত। মুক্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া। এদিন শুরু হয় ময়নামতি সেনানিবাস দখলের লড়াই। দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনে যশোর, মাগুরা, সাতক্ষীরা এখন স্বাধীন। উত্তর-পূর্ব রণাঙ্গনে সৈয়দপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে তীব্র আক্রমণ করা হয়। চট্টগ্রামের রামগড় থেকে পাকিস্তানি সেনাদের হটিয়ে দেয় মুক্তিবাহিনী।

যশোর শহর থেকে যৌথ বাহিনী চতুর্মুখী অভিযান চালায়। একটি দল ঝিনাইদহ হয়ে মাগুরা দখল করে। এতে একটি গুরুত্বপূর্ণ রেলসংযোগ মুক্তিবাহিনীর অধিকারে আসে। যৌথ বাহিনীর তাড়া খেয়ে পাকিস্তানি সেনারা মাগুরা থেকে ফরিদপুরের দিকে পালিয়ে যায়।

যশোর থেকে একটি দল এগোয় নড়াইলের দিকে। আরেকটি দল সাতক্ষীরা ও কলারোয়া দখল করে। যশোর-কালীগঞ্জ খণ্ডে খুলনার পথে লেবুতলা যৌথ বাহিনীর দখলে। কুষ্টিয়া এখনো অবরুদ্ধ।

পদ্মার উত্তর তীরে রাজশাহী ও পাবনার মধ্যে মুক্তিবাহিনী যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। রাজশাহী ও পাবনার সঙ্গে গোয়ালন্দ ঘাটের যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন। চুয়াডাঙ্গা অবরুদ্ধ। মেহেরপুর মুক্ত করে যৌথ বাহিনী চুয়াডাঙ্গায় গোলাবর্ষণ করে। খুলনা শহরে গোলাবর্ষণ অব্যাহত। ঝিনাইদহের কাছে পিছু হটার সময় পাকিস্তানি বাহিনী একটি সেতু ধ্বংস করে যায়। এখানে যৌথ বাহিনীর অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়।

উত্তর-পশ্চিম রণাঙ্গনে রংপুর শহরের পতন আসন্ন। পীরগঞ্জ এখন মুক্ত। সৈয়দপুরের উত্তরে একটি পাকিস্তানি ঘাঁটি যৌথ বাহিনীর দখলে।

রাতের মধ্যে মুক্ত হয় সিলেটের শ্রীমঙ্গল, রংপুর-দিনাজপুরের দুর্গাপুর ও বাদুড়িয়া এবং যশোর-খুলনার রূপদিয়া ও লেবুতলা।

পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা পঞ্চম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রায় ১৫০ জন সেনা এদিন মুজিবনগরে এসে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল (অব.) এম এ জি ওসমানী তাঁদের স্বাগত জানান। এই সেনারা লাহোরে ছিলেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ায় চারজন কর্মকর্তাসহ ওই সেনারা অস্ত্রশস্ত্রসহ সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন।

যৌথ বাহিনীর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা এদিন মুক্ত কুমিল্লা পরিদর্শন করেন। সকালে যৌথ বাহিনী বিমানবন্দরসহ কুমিল্লা শহর দখল করে। অরোরা বাংলাদেশ-ভারতের পতাকা লাগিয়ে কুমিল্লা বিমানবন্দরে পৌঁছালে জনতা হর্ষধ্বনি দিয়ে তাঁকে স্বাগত জানান। ভারতীয় বাহিনীর পদস্থ কোনো কর্মকর্তা হিসেবে তিনিই প্রথম বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল সফর করলেন।

সূত্র: তাজউদ্দীন আহমদ: ইতিহাসের পাতা থেকে, প্রতিভাস, ঢাকা; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ৯ ও ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১।

এবিএন/জনি/জসিম/জেডি

এই বিভাগের আরো সংবাদ