পান্তা-ইলিশে সীমাবদ্ধ নয় পহেলা বৈশাখ

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৪ এপ্রিল ২০২৩, ১০:১৭

পহেলা বৈশাখ বা পয়লা বৈশাখ (বাংলা পঞ্জিকার প্রথম মাস বৈশাখের ১ তারিখ) বঙ্গাব্দের প্রথম দিন, তথা বাংলা নববর্ষ। দিনটি সব বাঙালি জাতির ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণের দিন। বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ হিসেবে বিশেষ উৎসবের সঙ্গে এ দিনটি পালিত হয়। ত্রিপুরায় বসবাসরত বাঙালিরাও এ উৎসবে অংশ নিয়ে থাকে। আর বাংলাদেশে এটি জাতীয় উৎসব। আবার পহেলা বৈশাখ বাঙালিদের কাছে সর্বজনীন লোকউৎসব হিসেবেও বিবেচিত। দীর্ঘদিন ধরে এই দিনের শুরুতে পান্তা ভাতের সঙ্গে ইলিশ মাছ খাওয়ার রেওয়াজ থাকলেও এর বিশেষ কোনও কারণ বা সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পহেলা বৈশাখ মানে পান্তা-ইলিশে সীমাবদ্ধ নয়।

পান্তার সঙ্গে ইলিশ থাকতেই হবে— এমন কোনও ঐতিহ্যের কথা ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় না। অথচ কালের পরিক্রমায় এখন যেন পান্তা এবং ইলিশই পহেলা বৈশাখ উদযাপনের মূল আইটেম হিসেবে আখ্যা পেয়ে গেছে। তবে প্রাচীন কোনও গ্রন্থেই পান্তা-ইলিশ খাওয়ার কোনও নিদর্শন পাওয়া যায় না। নদী বহুল বাংলায় স্বাভাবিকভাবেই খাদ্য তালিকায় মাছ অন্যতম জায়গা করে নিয়েছিল। তবে বাঙালির এই মৎস্যপ্রীতি আর্য সভ্যতার সংস্কৃতিও কোনোদিন সুনজরে দেখেনি বলে জানা গেছে।

হাজারো ছন্দ-কবিতা ও প্রাণের উচ্ছ্বাসে বছর ঘুরে আসে পহেলা বৈশাখ। সুস্বাদু মাছ, জাতীয় মাছ ইলিশ বছরের যেকোনও সময়ে খেতেই পারেন। এটা নিয়ে কোনও সমস্যাই নেই। কিন্তু বিশেষ দিবসে এই মাছই খেতে হবে এমন কোনও বাধ্যবাধকতাও  নেই।  বৈশাখে ইলিশ খাওয়া নিয়ে ইতিহাসেও কোনও রীতিনীতির ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায়নি।

বিভিন্ন গবেষণা আর ইতিহাসবোদ্ধাদের মতে, বাঙালির নববর্ষ উদযাপনের চিরায়ত সংস্কৃতির সঙ্গে ইলিশের কোনও সম্পর্ক নেই। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে এর কোনও যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। ইতিহাসবিদদের মতে, বৈশাখের সকালে পান্তা ভাতের সঙ্গে ইলিশ মাছ খাওয়ার চর্চাটি মূলত ঢাকায় শুরু হয়। পরবর্তীকালে তা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। এতে পয়লা বৈখাশের প্রাক্কালে ইলিশের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। এছাড়া এপ্রিল মাস ইলিশের মৌসুমও নয়। এ সময় ইলিশ পাওয়াটাও মুশকিল। এপ্রিলে ইলিশের নামে যা পাওয়া যায়, তা ইলিশ নয়, মূলত জাটকা। আইন অনুযায়ী ৯ ইঞ্চি আকৃতির ইলিশকে জাটকা হিসেবে গণ্য করা হয়।

এদিকে সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রতি বছর ১ নভেম্বর থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত দেশব্যাপী জাটকা আহরণ, পরিবহন, মজুত, বাজারজাতকরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও বিনিময় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। দেশে ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে প্রতি বছরই পহেলা নভেম্বর থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত জাটকা ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সরকার। নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় এ সময়ে দেশের নদনদীতে সাড়ে ৯ ইঞ্চির কম ব্যাসের জাল ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা কার্যকরের জন্য সচেতনতামূলক বিভিন্ন প্রচার কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়। এ ছাড়া সর্বত্র ভ্রাম্যমাণ আদালত সার্বক্ষণিক কাজ করে। এ সময়ে ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় চার মাস ধরে জেলেদের জন্য প্রতি মাসে জনপ্রতি ৩০ কেজি করে চাল সহায়তা দেওয়া হয়।

মৎস্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, ২০০৩ সালে মৎস্য সংরক্ষণ আইনের আওতায় প্রতি বছরের ১ নভেম্বর থেকে ৩১ মে পর্যন্ত সাত মাস জাটকা ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা নির্ধারিত ছিল। কিন্তু ইলিশের প্রজনন মৌসুমে হেরফের হওয়ায় সরকার এই সময়সীমা এক মাস বাড়িয়ে ৩০ জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করে।

মৎস্য সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, নিষেধাজ্ঞাকালীন জাটকা ধরা, সংরক্ষণ, পরিবহন, বিপণন দণ্ডনীয় অপরাধ। প্রথমবার কেউ এই আইন অমান্য করলে এক থেকে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা একইসঙ্গে সর্বোচ্চ এক হাজার টাকা জরিমানা হতে পারে। কিন্তু দ্বিতীয়বার কেউ একই অপরাধ করলে আইনে শাস্তির পরিমাণ দ্বিগুণের বিধান রাখা হয়েছে। এ সময়ে যারা জাটকা আহরণ, বিপণন, পরিবহন করবেন, তাদের বিরুদ্ধে এই আইন প্রয়োগ হবে। এ আইন বাস্তবায়নে বাংলাদেশ নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড, পুলিশ, জেলা প্রশাসন ও মৎস্য অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সম্পৃক্ত থাকেন।

পহেলা বৈশাখের সঙ্গে ইলিশ মাছের আসলেই কি কোনও সম্পর্ক আছে? এমন প্রশ্ন সবার। ইলিশ মাছের স্বাদ ও গন্ধ এবং এর সহজপ্রাপ্যতার কারণেই জাতীয় মাছের স্বীকৃতি পেয়েছে। এই মাছ পছন্দ করে না এমন লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। একটা সময় ছিল যখন বাড়িতে প্রায় প্রতি দিনই ইলিশের কোনও না কোনও পদ থাকতো। কালের পরিক্রমায় পহেলা বৈশাখে এখন সেই পান্তা ও ইলিশ যেন একমাত্র উদযাপনীয় আইটেম হিসেবে আখ্যা পেয়ে গেছে। সেই সুযোগে বাজারে ইলিশের দাম হয় আকাশচুম্বি।  কোথাও আবার বৈশাখে একটা ইলিশ মাছ জোগাড় করতে না পারা মানে অক্ষমতা ও ব্যর্থতা। কিন্তু কত দেশি সুস্বাদু আর কমদামি ঐতিহ্যবাহী মাছ আছে, সেগুলোর দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না কেউ।

অনেকের মতে, পয়লা বৈশাখে ইলিশ নয়, বরং লবণ-পান্তা-তেল-মরিচই উপযুক্ত খাবার। সঙ্গে আলু ভর্তা বা ডিম ভাজিই যথেষ্ট। দেশীয় বিভিন্ন মাছ তো রয়েছেই। এগুলো দিয়েও তো বৈশাখ উদযাপন হয়, আমাদের জাতীয়তা বা বাঙালিয়ানা ধরে রাখা যায়। সেখানে ইলিশ মাছ কখনোই বাধ্যতামূলক না। এটা নিছকই আমাদের ‘তৈরি ঐতিহ্য’। অনেকে আবার বলছে, ইলিশ প্রজননের এ সময়টাতে ইলিশ উৎসব হলে ইলিশের সংখ্যাই তো কমে যাওয়ার কথা।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কাওরান বাজারের মাছ ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘এক সময় দেশে পহেলা বৈশাখের উসিলায় ইলিশের চাহিদা থাকতো। তখন ইলিশের সরবরাহ বেড়ে যেতো। বাড়তো ক্রেতা ও দাম। বৈশাখে এখন আর সেই জৌলুস নেই। আইনের বাধ্যবাধকতা থাকায় ইলিশের সরবরাহ কমে গেছে। এই সিজনে বড় ইলিশ পাওয়া যায় না। যা পাওয়া যায় তা জাটকা।  আইনে এ সময় জাটকা আহরণ, বিতরণ, বিপণন, মজুত সবই নিষিদ্ধ।’

জানতে চাইলে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের নেতা গোলাম কুদ্দুস বলেন, ‘পহেলা বৈশাখের সঙ্গে ইলিশ মাছের আসলেই কোনও সম্পর্কের বিষয়টি কোথাও  খুঁজে পাওয়া যায় না। এটা একটা রেওয়াজ ছিল। তবে এখন সেই ভুল ভেঙেছে। এখন আর পহেলা বৈশাখ মানে পান্তা-ইলিশে সীমাবদ্ধ নয়।’

এবিএন/শংকর রায়/জসিম/পিংকি

এই বিভাগের আরো সংবাদ