আজকের শিরোনাম :

যে সাত উপায়ে অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৪:৩১

বাংলাদেশে বেশিরভাগ ভবন ও বাসাবাড়িতে অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়া হয় না এবং এ কারণেই এ ধরনের দুর্ঘটনার সময় ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা যায় না। অগ্নিনিরাপত্তা-বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেকোনো ভবন বা বাসাবাড়িতে অগ্নি দুর্ঘটনা ঠেকাতে বা এর ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে হলে ভবন নির্মাণ পর্যায় থেকেই নিতে হবে প্রস্তুতি।

বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সাবেক পরিচালক এবং অগ্নিনিরাপত্তা সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠান বিএম ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেজর একেএম শাকিল নওয়াজ বলেন, আগুন লাগলে সেটি ছড়িয়ে পড়া অনেকাংশেই ঠেকানো সম্ভব যদি আগে থেকেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া যায়।

তার মতে, কোনো ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে ভবনে দুটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। একটিকে তিনি উল্লেখ করেছেন অ্যাকটিভ সিস্টেম বা সক্রিয় ব্যবস্থা এবং অন্যটি প্যাসিভ সিস্টেম বা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা।

নওয়াজ বলেন, অগ্নিনিরাপত্তায় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাটাই সবচেয়ে জরুরি। এটা বাড়ি নির্মাণের সময় মূল নকশার সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে হবে এবং সিভিল ইঞ্জিনিয়ারকে তা নিশ্চিত করতে হবে।

আর সক্রিয় ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে আগুন ধরে গেলে সেটির ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে নানা ধরনের পদক্ষেপ।

বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পের সঙ্গে জড়িত ভবনগুলোয় এ ধরনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার কারণে সেখানে আগুন লাগার মতো দুর্ঘটনা কমে এসেছে এবং আগুন লাগলেও তা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থাকছে বলে উল্লেখ করেন নওয়াজ। একই কারণে এসব ভবনে আগুন লাগলে প্রাণহানি কম হয় বলেও জানান তিনি।

কোনো ভবনে আগুন দুর্ঘটনা ঠেকাতে যেসব বিষয় নিশ্চিত করতে হবে তা হলো-

ডাক্ট লাইন ও ক্যাবল হোল সিল করা
আধুনিক বহুতল ভবনগুলোয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, হিটিং, বিদ্যুৎ এবং গ্যাস সংযোগের জন্য যে পাইপগুলো টানা হয়, সেগুলো যায় ডাক্ট লাইন ও ক্যাবল হোলের ভেতর দিয়ে। এই ডাক্ট লাইন ও গর্ত দিয়ে ধোঁয়া এবং আগুন খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। শাকিল নওয়াজ বলছেন, এ জন্য ডাক্ট লাইন ও ক্যাবল হোলগুলো আগুন প্রতিরোধক উপাদান দিয়ে ভালো করে বন্ধ করে দিতে হবে।

এ ছাড়া ভবনের অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জার জন্য ব্যবহৃত কোনো কিছুর মাধ্যমেও যাতে আগুন ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

আগুনপ্রতিরোধী উপাদান ব্যবহার
একটি ভবন নির্মাণের সময় কী ধরনের উপাদান ব্যবহার করা হচ্ছে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভূমিকম্প এবং আগুন লাগার মতো দুর্ঘটনা ঠেকাতে এ ধরনের উপাদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এক্ষেত্রে দরজা এবং দেয়াল আগুনপ্রতিরোধী হলে ভাল হয়।

এ ছাড়া ঘরের সিলিং, রান্নাঘরের আসবাবপত্র আগুনপ্রতিরোধী পদার্থে নির্মাণ এবং আগুন প্রতিরোধী তার ব্যবহার করলে আগুন লাগলেও সেটি ছড়িয়ে পড়ার ভয় থাকে না।

সিনথেটিক বা হাইড্রোকার্বন উপাদান থাকে এমন কোন পদার্থ দিয়ে ভবনের ভেতরের সাজসজ্জা না করাই ভালো।

নওয়াজ বলেন, ‘এগুলো হলো আগুনের কাছে পোলাও, কোরমা, বিরিয়ানির মতো খাবার।’

এসব উপাদানের মাধ্যমে একদিকে যেমন আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে অন্যদিকে তেমনি আগুন লাগলে এসব উপাদান পুড়ে বিষাক্ত ধোয়া তৈরি হয় যা নিঃশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করলে মানুষ প্রায় সঙ্গে সাথেই অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। ফলে আগুনে প্রাণহানির সংখ্যা বাড়ে। আবার এসব ধোঁয়ার কারণেই অনেক সময় মানুষ মারা যায়।

অ্যালার্ম সিস্টেম বসানো
প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেওয়ার পরও যদি কোন ভবনে আগুন লাগে তাহলে সেক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতিয়ে কমিয়ে আনার একটা উপায় হচ্ছে ফায়ার এবং স্মোক অ্যালার্ম সিস্টেম বসানো এবং সেটি ঠিক মতো কাজ করে কি না, তা নিয়মিত পরীক্ষা করা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, অ্যালার্ম সিস্টেম কাজ করলে কোন এক জায়গায় আগুন লাগলে পুরো ভবনের বাসিন্দারাই আগুন সম্পর্কে জানতে পারে এবং দ্রুত তারা ভবন খালি করে নিচে নেমে আসতে পারে। ফলে প্রাণহানি ব্যাপকভাবে কমানো সম্ভব।

জরুরি বহির্গমন পথ নিশ্চিত করা ও ব্যবহার

যেকোনো ভবনেই আগুন লাগলে সেটি থেকে বের হয়ে আসার জন্য বাইরে একটা জরুরি বহির্গমন পথ থাকতে হবে। এটা হতে হবে এমন একটি পথ যেখানে আগুন এবং ধোঁয়া প্রবেশ করতে পারবে না। কারণ কোন ভবনে আগুন লাগলে বা ভূমিকম্প হলে ওই ভবনের লিফট ব্যবহার না করার পরামর্শ দেয়া হয়।

ফায়ার এক্সটিংগুইশার রাখা ও ব্যবহার করা
প্রতিটি ভবনেই অগ্নিনির্বাপণ সিলিণ্ডার বা ফায়ার এক্সটিংগুইশার থাকাটা নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে এগুলো ব্যবহার করতে জানতে হবে ভবনের বাসিন্দাদের।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো একটি ভবনে আগুন লাগার পর সেটি ছড়িয়ে পড়তে কিছুটা হলেও সময় লাগে। এই সময়ের মধ্যে যদি অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা দিয়ে সেটি নিভিয়ে ফেলা যায় তাহলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব।

আগুন লাগার পর প্রথম দুই মিনিটকে বলা হয় প্লাটিনাম আওয়ার বা সবচেয়ে মূল্যবান সময়। এই সময়ে ঘাবড়ে না গিয়ে ঠান্ডা মাথায় ব্যবস্থা নিয়ে ক্ষয়ক্ষতি অনেক কমানো যায় বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের সাবেক পরিচালক একেএম শাকিল নওয়াজ।

স্প্রিঙ্কলার সিস্টেম
আগুন নেভানোর জন্য একটা প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা হচ্ছে স্প্রিঙ্কলার সিস্টেম। এটি কোনো একটি ভবনের পানি সরবরাহ ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত থাকে।

এই ব্যবস্থায় কোনো একটি স্থানে তাপমাত্রা ৫৭ ডিগ্রির বেশি হলে এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিস্ফোরিত হয়ে পানি ছিটিয়ে পড়তে থাকে।

ফলে আগুন নিভে যায়। বড় বড় বাণিজ্যিক বা কারখানা ভবনে সাধারণত এগুলো ব্যবহার করা হলেও বর্তমানে আবাসিক ভবনগুলোতেও এগুলোর ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।

নিয়মিত মহড়া
এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান বলেন, প্রাথমিকভাবে সবাইকেই জানতে হবে যে, ফায়ার এক্সটিংগুইশার কিভাবে ব্যবহার করতে হয়, আগুন লাগলে কীভাবে ফায়ার সার্ভিসকে ডাকতে হবে।

ভবনে আগুন লাগলে সেখান থেকে কীভাবে বের হয়ে আসতে হবে তার জন্য নিয়মিত মহড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ভবনের সব বাসিন্দাদের অংশগ্রহণে মাসে অন্তত এক বার এ ধরণের মহড়া করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

আগুন লাগলে কার কী দায়িত্ব তা আগে থেকেই ভাগ করে দিতে হবে। আগুন থেকে উৎপন্ন ধোয়া যাতে কেউ নিঃশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ না করে, ভবন থেকে নামতে যাতে সিঁড়ি ব্যবহার করে, ভেজা তোয়ালে দিয়ে মুখ ঢেকে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে হবে- এ বিষয়গুলো অবশ্যই জানতে হবে। এছাড়া কোন অবস্থাতেই উদ্বিঘ্ন না হওয়া বা ঘাবড়ে গিয়ে ভবন থেকে লাফিয়ে পড়া থেকে বিরত থাকতে হবে।

এ ছাড়া বহুতল ভবনগুলোতে অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম এমন দক্ষ জনবল নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। যাতে করে আগুন লাগলে তারা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে পারে।
তথ্যসূত্র : বিবিসি বাংলা

এবিএন/এসএ/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ