কাম বাসনা কি শুধু পুরুষের বিষয়, নারীকে কেন নিরুৎসাহিত করা হয়?

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২১ জানুয়ারি ২০২২, ২১:১৭ | আপডেট : ২১ জানুয়ারি ২০২২, ২১:২৩

নারীর যৌনতা, তার কাম বাসনা, বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বহু দেশে একটি নিষিদ্ধ বিষয়। এই প্রসঙ্গে কথা বলা খুব মুশকিল। নারীর যৌন আকাঙ্ক্ষা থাকতে নেই- এমনটাই সামাজিকভাবে নারীকে শেখানো হয়।

নারীর শরীর, যৌনতা তার নিজের জন্য নয়, বরং পুরুষের ভোগের বিষয়, সন্তান জন্মদানের প্রক্রিয়ার অংশ। নারী নিজেও এক সময় এভাবেই ভাবতে শুরু করে।

যে কথা যায় না বলা

যৌনতা, কাম বাসনা- এসব বিষয়ে খুব খোলামেলাভাবে কয়জন নারী বলতে পারবেন? তা জানার জন্য যখন কথা বলার চেষ্টা করলাম, শুরু থেকেই না শুনতে হল বারবার।

অনেকে বিষয়টি নিয়ে সরাসরি কথা বলতে নাকচ করে দিলেন, কেউ বিষয়বস্তু শুনেই হকচকিয়ে গেলেন, আবার কেউ লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে ফেললেন।

"আই এনজয় সেক্স", আমি যৌন মিলন খুব উপভোগ করি," অবশেষে একজনকে পাওয়া গেলো যিনি সরাসরি এমনটাই বললেন, তবে নিজের নাম, পরিচয় লুকিয়ে রাখার শর্তে।

"আমি দু'একবার দুষ্টামি করে লাইনটা বলেছি। প্রথমে সবাই মনে করেছে আমি ঠাট্টা করছি। তারপর যখন বুঝতে পেরেছে যে না আমি আসলে সিরিয়াস, পরে শুনেছি যে তারা আমার চরিত্র খারাপ এমন একটা লেবেল লাগিয়ে দিয়েছে। পরে দেখা হলে আমার দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়েছে," বলেন তিনি।

একটি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন এই নারী। বয়স ৪৫ বছর। যৌন জীবনে খুব সক্রিয় বলে নিজেকে তুলে ধরেছেন তিনি।

ছোটবেলা থেকে যৌনতা সম্পর্কে কী শিখেছেন তা বর্ণনা করে বলছিলেন, "যখন কিশোরী ছিলাম, এই ধরেন স্কুলের গার্হস্থ্য অর্থনীতি বইয়ে একটুখানি ধারণা পেলাম। তারপর বান্ধবীদের কাছ থেকে যখন রোমান্টিক উপন্যাস ধার করে পড়লাম তখন বিষয়টা সম্পর্কে আরও একটু বিস্তারিত ধারণা পেলাম।

কিন্তু সেই সময় আমি বা আমার বান্ধবীরা প্রেম ভালোবাসা নিয়ে কথা বলতাম কিন্তু তার মধ্যে সেক্স বিষয়ে কোন আলাপ হতো না। আর তখন শরীরের এই অনুভূতিটাও বুঝতাম না। তখন ধারণা করতাম যে এটা নিয়ে কথা বলা পাপ, এটা করলে তুমি অশুদ্ধ, পরিবার থেকে এভাবেই শেখাত।"

যৌনতায় আগ্রহী নারীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন

নারীর যৌনতা, তার কাম বাসনা, বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বহু দেশে একটি নিষিদ্ধ বিষয়। বিশ্বের বহু সংস্কৃতিতে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, নারীরা যৌনতায় পুরুষের পাশাপাশি অংশগ্রহণ করে না বরং তারা নিজেরা যৌনতার বস্তু।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের শিক্ষক জোবায়দা নাসরিন 'আনপ্যাকিং সেক্সুয়ালিটি' বা 'যৌনতার মোড়ক উন্মোচন' এবং 'যৌনতার ইতিহাস'- এই শিরোনামে দুটি গবেষণা করেছেন।

তিনি বলছেন, নারীর যৌনতার বিষয়ে সমাজের কী ধারণা সেটা তিনি তার গবেষণায় দেখতে পেয়েছেন।

তিনি বলছেন, "আমাদের এখানে নারীর যৌনতা নিয়ে একটা ট্যাবু আছে- যৌনতার দিক থেকে নারী প্যাসিভ থাকবে, নারীর শরীর রাখঢাকের বিষয়। আমাদের গবেষণার অভিজ্ঞতা বলছে যে আমাদের দেশে নারী যদি যৌনতা সম্পর্কে জানে, তার ফ্যান্টাসি আছে এসব নিয়ে, এমনকি যদি পার্টনারের সাথেও এবিষয়ে আলাপ করে, তখন সন্দেহ করা হয় যে নিশ্চয়ই তার যৌন অভিজ্ঞতা আছে।

তার যৌনতা-কেন্দ্রিক আগ্রহকে সমাজ ভালোভাবে দেখে না। যে নারী তার যৌনতাকে এক্সপ্রেস করবে, সমাজের চোখে সে খারাপ নারী," বলেন তিনি।

একই বিষয়ে পুরুষদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে অভিজ্ঞতা হল অন্যরকম:

ধমকের সুরে কয়েকজন জানিয়ে দিলেন- কথা বলার মতো কোন বিষয় এটি হতে পারে না। কেউ হেসে উড়িয়ে দিলেন, এমনকি যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ খিস্তি বের হয়ে এলো দু'একজনের মুখ থেকে।

পটুয়াখালীতে একটি ব্যাংকে কাজ করেন জহিরুল ইসলাম। নারীর যৌনতার ধারণা তার কাছে অস্পষ্ট বলেই মনে হল।

তিনি বলছেন, যৌন আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেন এমন নারীদের তিনি এড়িয়ে যাবেন।

"আমি এদের ভালোভাবে দেখি না। কারণ আমাদের সমাজ এদের নেগেটিভলি নেয়। আমি এদের সঙ্গ এড়িয়ে যাব। আমি এদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখবো। ধরেন আমার একটা ইজ্জত আছে। সেইটা থাকে না।"

নিজের স্ত্রীর যৌনতাকে তিনি কিভাবে দেখেন এমন প্রশ্ন তিনি এড়িয়ে গেলেন।

নারীর যৌনতা কি অবদমন করা হয়?

জোবায়দা নাসরিন বলছেন তার গবেষণা বলছে, ছোটবেলা থেকে নারীরা যৌনতাকে ভয় পেতে শেখে, উপভোগ করতে নয়।

পরিবার থেকে নারী শেখে যে নিজের যৌন আকাঙ্ক্ষার কথা মুখ ফুটে বলতে নেই। কারণ হিসেবে মনে করা হয় যে এই অনুভূতি তার জন্য নয়।

জোবায়দা নাসরিনের ভাষায়: সমাজে নারীর যৌনতাকে অবদমন করা তাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার একটি প্রক্রিয়া।

"পুরুষ যৌনতাকে তার মতো করে ব্যাবহার করবে, যৌনতা-কেন্দ্রিক সব ধরনের স্বাধীনতা ভোগ করবে, সকল ধরনের অভিপ্রায় প্রকাশ করবে, এর মধ্যে নারীর দেহকে নিয়ন্ত্রণের বিষয় থাকে। নারীর শারীরিক সেক্সুয়াল প্লেজার ও পেইনের যত ধারণা আছে, সবকিছু নির্ভর করবে পুরুষের উপরে।

"নারীর দেহ-কেন্দ্রিক প্লেজার, সেক্সুয়াল সম্পর্ক করার সিদ্ধান্ত পুরুষের সিদ্ধান্তে হচ্ছে, পুরুষের আগ্রহের জন্য হচ্ছে, পুরুষের আনন্দের জন্য হচ্ছে। এভাবে নারীর দেহের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় পুরুষের হাতে। নারী যেমন একদিকে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে না, অন্যদিকে অন্যের মাত্রাতিরিক্ত যৌন এক্সপ্রেশন ও আধিপত্যের বলিও তাকে হতে হয়।"

নারীর যৌনতা তার নিজের জন্য নয়

বেশিরভাগ সমাজে নারীর যৌনতা যেন তার নিজের জন্য নয়, বরং পুরুষের ভোগের জন্য। যৌনতার ইতিহাস সম্পর্কে পড়তে গিয়ে, বিভিন্ন সাহিত্যকর্মে এর উল্লেখ, যৌন পল্লী ও পর্নোগ্রাফির আবির্ভাব -এসব ক্ষেত্রে নারীর যৌন আকাঙ্ক্ষা একটি উপেক্ষিত বিষয়, যৌন সুখ শুধু পুরুষের জন্য এমনটাই মনে হয়।

এমনকি বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যেও যৌন মিলনে নারীর সম্মতিকে অগ্রাহ্য করার প্রবণতার কথা শোনা যায় প্রায়শই।

বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে ধর্ষণকে জাতিসংঘ ভয়াবহ ধরনের পারিবারিক সহিংসতা বলে মনে করে।

আবার যৌন চাহিদা সম্পর্কে নারীর পছন্দের বিষয়টিও আমলে নেয়া হয় না। ১৮ বছরের বৈবাহিক জীবনে নিয়মিত অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন।

"প্রায়ই দেখা যায় আমি ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছাইতে পারি নাই। কিন্তু আমার স্বামীর শেষ হয়ে গেছে। সে কিছু ভাবেই না। উঠে চলে যায় অথবা ঘুমায়ে যায়। আমি এই বিষয়ে কিছু বলতেও পারি না, যতই অস্থির লাগুক না কেন, লজ্জা লাগে। ও কী মনে করবে, কী বলবে - ভয় লাগে। আবার আমার ইচ্ছা করতেছে না সে তাও চায়। আমার যাতে ইচ্ছা করে সেজন্য সে কোন চেষ্টাও করে না।"

এমন বিষয়ে কথা বলায় দ্বিধা থেকেই সমাজে নারীর যৌনতার ধারণা অনেকটাই স্পষ্ট হয়।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মেখলা সরকার বলছেন, এক পর্যায়ে যৌনতা নিয়ে নারীদের নিজেদেরও ফ্যান্টাসি বা আগ্রহ কমতে থাকে। মা হবার পর, বিশেষ করে সন্তান বড় হবার পর।

ডা. মেখলা সরকার বলছেন, এ বিষয় নিয়ে নারীরা পুরুষের আগ্রহেই চিকিৎসকের কাছে যান, নিজের আগ্রহে নয়।

যৌনতা নিয়ে নারীর উদ্বেগের কথা বলছিলেন তিনি, "অনেক নারীর এ ব্যাপারে একটা অ্যাংজাইটি থাকে তাই তারা উপভোগ করতে পারে না। তারপর যেহেতু বিষয়টা সম্পর্কে ধারণা কম, শিক্ষা কম, তাই তাদের অনেকের মধ্যে এক ধরনের ভীতি কাজ করে।

"নারীদের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র শারীরিক না, আবেগের দিক থেকেও যদি ইনভলভমেন্ট না থাকে, বা সে ফিল করে যে আমাকে প্রায়োরিটি দিচ্ছে না, কিন্তু শুধু ওই সময়টায় তাকে গুরুত্ব দিচ্ছে, তাহলে সেটাও সে এনজয় করবে না।"

নারীর শরীর ও অপবিত্রতার ধারণা

বাংলাদেশের সমাজে নারী ও কন্যা শিশুরা জীবনের কোন কোন না সময়ে যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়। সেটিও অনেক সময় নারীর যৌনতায় নিরুৎসাহের কারণ, বলছিলেন ডা. মেখলা সরকার।

আর এ কারণে যৌনতা নারীর কাছে অনেকাংশেই ভয়ের বিষয়। তবে নারীর শরীরকে অপবিত্র হিসেবে ফুটিয়ে তোলার যে সংস্কৃতি সেটি নারীকে যৌনতায় নিরুৎসাহিত করার একটি পদ্ধতি বলে মনে করেন তিনি।

"আমি বলবো যদি তার আত্মবিশ্বাস কম থাকে, নিজের শরীরের প্রতি তার অ্যাপ্রিসিয়েশন না থাকে, বডিটাকে যদি সে মনে করে এটা খুব খারাপ, নোংরা, এ থেকেও বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়। যেমন ধরেন যে একটা খাবার শুরু থেকেই জানলেন যে খাবারটা খারাপ, তাহলে খাবারটা আপনার আর ভালো লাগবে না। সেটাও একটা ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করতে পারে।"

কিন্তু তরুণ প্রজন্মের কাছ থেকে ভিন্ন বক্তব্যও পাওয়া যায়, যারা সঙ্গিনীর কাছে তার অনুভূতি, চাওয়া নিয়ে জানতে চান। কারণ যৌনতা তার নিজের একার বিষয় নয়- এমন ধারণা ক্রমশই বাড়ছে।

যদিও 'আমি সেক্স এনজয় করি' এমন কথা বলতে পারা নারীদের দিকে কপাল কুচকানো মানুষের সংখ্যা এখনও বেশি বলেই মনে হয়।

এবিএন/মমিন/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ