আজকের শিরোনাম :

কালকেউটে দংশন করলে মানুষ বুঝতে পারে না কেন, কী করে বুঝবেন

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৫:৪৫

কেউটে বা কালকেউটে বাংলাদেশে খুবই পরিচিত সাপ। বাংলাদেশে যে কয়টি সাপের ছোবলে মানুষের মৃত্যু সবচেয়ে বেশি হয়, এটি তার অন্যতম। 

বাংলাদেশে ৮০ প্রজাতির সাপ রয়েছে। এর মধ্যে দেশের সবচাইতে বিষধর না হলেও, কিছু ক্ষেত্রে বলা হয় কেউটে সাপের ছোবলেই বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যান। কারণ এ সাপের দংশন হলে অনেক সময়ই সাথে সাথে বোঝা যায় না। আর সাপের দংশনে মৃত্যুর প্রধান কারণ দংশনের পর ব্যবস্থা নিতে দেরি হওয়া।

বাংলাদেশে বর্ষা মৌসুমে প্রতিবছর প্রায় ৬ লাখের মতো মানুষ সাপের দংশনের শিকার হন, এবং অন্তত ৬ হাজার মানুষ মারা যান।

শঙ্খিনী জাতের সাপ
এই সাপের বৈজ্ঞানিক নাম কমন ক্রেইট, মূলত ইলাপিডি গোত্রের বিষাক্ত সাপ। বাংলাদেশে কমন ক্রেইট সাধারণত কালকেউটে, কালো কেউটে, কালনাগ, কালাচ এমন নানা নামে পরিচিত।

অঞ্চলভেদে আরও কিছু নাম রয়েছে, বরিশালে কালাঞ্জিরি, চট্টগ্রামে হানাস, উত্তরবঙ্গে জাতিসাপ নামেও ডাকা হয় এ সাপকে।

বাংলাদেশ টক্সিকোলজি সোসাইটির প্রধান অধ্যাপক এমএ ফায়েজের লেখা ‘সর্প-দংশন ও এর চিকিৎসা’ নামে বইয়ে কালকেউটের যে পরিচিতি দেয়া আছে, তাতে বলা হয়েছে, এই সাপ কালচে রংয়ের ও এদের গায়ে অর্ধ-চন্দ্রাকৃতি সাদা বলয় আছে। বলয়গুলো শুরু হয়েছে ঘাড়ের কিছুটা পেছন থেকে।

চোখের সামনে সাদা দাগ, উপরের চোয়াল ও পেট দেখতে সাদা রঙের। এই সাপের মাথা চ্যাপ্টা, শরীর গোলাকৃতি, পেছন দিক সরু। লেজ ছোট, কিছুটা ভোঁতা আকৃতির।

চোখ ছোট ও চোখের তারা গোলাকার অমসৃণ, চকচকে। এ সাপ ফণা তোলে না। বড় সাপের দৈর্ঘ্য দুই মিটারের চেয়ে কম হয়।

বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়াতে বলা হয়েছে বাংলাদেশে যে পাঁচ প্রজাতির শঙ্খিনী সাপ আছে, কালকেউটে তাদের একটি।

বাংলাপিডিয়াতে কালকেউটে সম্পর্কে বলা হয়েছে, এ সাপের দেহের রং ধূসর কালো, তাতে অন্য কোনো রঙের দাগ থাকে না। খাদ্য হিসেবে এরা প্রাণী ভালোবাসে।

কালকেউটে শঙ্খিনী জাতের অন্য সাপের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বিষহীন ও বিষধর দুই ধরনের ছোট সাপ, ব্যাঙ, টিকটিকি ও ইঁদুরসহ ছোট প্রাণী খায়।

অধ্যাপক এমএ ফায়েজের লেখা ‘সর্প-দংশন ও এর চিকিৎসা’ নামে বইয়ে বলা হয়েছে, কালকেউটে সাধারণত গ্রামাঞ্চলে সমতল ভূমিতে ও চাষাবাদের জমির নিচে লুকিয়ে থাকে। জঙ্গলেও থাকে এই সাপ।

সেই সঙ্গে ইঁদুরের গর্ত, পুরনো বাড়ি, খোলা মাঠ, ইটের স্তূপ, বাগান, বাড়ির ছাদ এবং মানুষের বসতবাড়ির আশেপাশে বাসা বানায়।

কেবল রাতে চলাচল করে এই সাপ। এরা সাধারণত শান্ত প্রকৃতির, উত্যক্ত করলে দংশন করে।

মাটিতে বা শুকনো পাতার স্তূপে এক সঙ্গে ছয় থেকে ১২টি ডিম দেয়। জুলাই-অগাস্ট মাসে বাচ্চা ফুটে বের হয়।

এদের বিষদাঁত ছোট। ‘সর্প-দংশন ও এর চিকিৎসা’ নামে বইয়ের তথ্য বলছে, কেউটে বা কালকেউটে গোখরা সাপের চেয়ে ৬ থেকে ৮ গুণ বেশি বিষধর সাপ।

এদের এক দংশনে ৮ থেকে ১২ মিলিগ্রাম বিষ বের হয়, যার দুই থেকে তিন মিলিগ্রাম বিষ একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মৃত্যু ঘটাতে যথেষ্ট।

কালকেউটে কেন এত ভয়ংকর?
পৃথিবীতে ক্রেইট বা শঙ্খিনী জাতের সাপের মোট ৮টি প্রজাতি রয়েছে, এর মধ্যে ৫টি প্রজাতি বাংলাদেশে পাওয়া যায়। এর মধ্যে দুইটি প্রজাতি ভয়ংকর যার একটি কালকেউটে।

কালকেউটে বাংলাদেশের সবচেয়ে বিষধর সাপ নয়। কিন্তু দেশে যে কয়টি সাপের দংশনে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা পড়েন, এ সাপ তাদের অন্যতম।

বাংলাদেশ টক্সিকোলজি সোসাইটির সদস্য ডা. আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছেন, সাপে কাটলে একজন মানুষের শরীরে তিন ধরনের প্রভাব পড়ে... হেমোটক্সিন বা রক্ত দূষণ, মায়োটক্সিন বা মাংসপেশি অকার্যকর এবং নিউরোটক্সিন বা মস্তিষ্ক অকার্যকর।

এর মধ্যে কালকেউটে কাটলে মূল সমস্যা হবে নিউরোটক্সিসিটি বা মস্তিষ্কে অসাড়তা এবং অকার্যকর হয়ে পড়া।

এ ছাড়া কালকেউটের দংশনে মাংসপেশি অসাড় বা অনুভূতিশূণ্য হয়ে যাবে, যা থেকে দ্রুত বিষ ছড়িয়ে কিডনি বিকল হয়ে পড়বে।

ডা. আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছেন, কেউটে প্রজাতির কোনো সাপই উঁচুতে উঠতে পারে না। ফলে সাধারণত নিচে থাকে এমন অবস্থায় দংশন করে।

এ জন্য বিশেষত রাতে খাবারের সন্ধানে বের হয়ে বাড়িঘরে মাটিতে ঘুমন্ত মানুষ, ফসলের ক্ষেত বা ফসল সংরক্ষণ করা হয়েছে এমন জায়গার আশেপাশে থাকা মানুষ এর দংশনের শিকার হয়।

তবে আঘাত পেলেই দংশন করে এ সাপ। এক্ষেত্রে বেখেয়ালে মানুষ হয়ত সাপের গায়ে আঘাত করে থাকে, যার ফল হিসেবে দংশিত হয়।

কিন্তু কেউটের দংশনের বড় বিপদ হচ্ছে, দংশনের পর অনেকেই বুঝতে পারেন না, সর্প-দংশনের শিকার হয়েছেন। এরপর চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার আগেই মৃত্যু ঘটে বেশিরভাগ আক্রান্ত মানুষের। আর এ জন্যই একে মারাত্মক বলা হয়।

কীভাবে বুঝবেন কেউটে কেটেছে?
কেউটের বিষদাঁত খুব সরু, ফলে এ সাপে কাটলে অনেকেই বুঝতে পারেন না, সর্প-দংশনের শিকার হয়েছেন। এমনকি শরীরে কোন দৃশ্যমান দাগও হয় না অনেক সময়ই।

তবে যেসব লক্ষণ দেখে বোঝা যাবে যে কেউটের দংশনের শিকার হয়েছেন কেউ, তার মধ্যে রয়েছে দংশিত স্থানে সামান্য ব্যথা, চুলকানি, অবশ বোধ করা বা ঝিনঝিনানি ব্যথা।

আর যেহেতু এ সাপ রাতে কাটে, শারীরিক প্রতিক্রিয়া প্রকাশ হতে হতে কয়েক ঘণ্টা পার হয়ে যায়।

ততক্ষণে রোগীর হাত-পা-গলা অবশ হয়ে যেতে পারে, ঢোক গিলতে পারবে না। সাথে বমি হতে পারে। পেট ব্যথা, মাংসপেশিতে ব্যথা এবং কাঁপুনি হতে পারে। শেষে মস্তিষ্ক অসাড় হয়ে অকার্যকর হয়ে পড়বে।

দংশিত হলে কী করবেন?
টক্সিকোলজি সোসাইটির ডা. আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ বলছেন, কারও যদি সন্দেহ হয় যে তিনি কেউটের দংশনের শিকার হয়েছেন, তৎক্ষণাৎ হাত ও পায়ের নড়াচড়া বা চলাচল বন্ধ করে প্রেশার ইমমোবিলাইজেশনের ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রেশার ইমমোবিলাইজেশন বলতে তিনি বলছেন, আক্রান্ত স্থান শরীরের যেকোন জায়গাই হতে পারে। কিন্তু তখন হাত ও পায়ে শক্ত কোন বস্তু বসিয়ে তার ওপর গামছা বা সুতি কোন কাপড় হালকা করে বেধে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

শক্ত করে বাঁধা যাবে না। মনে রাখতে হবে শরীরে নড়াচড়া যত বেশি হবে, তত বিষ সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকবে।

দংশনের জায়গায় কোনো কাটাছেঁড়া করা যাবে না।

হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নেয়ার সময় আক্রান্ত ব্যক্তিকে কাত করে শুইয়ে দিতে হবে, কারণ বিষক্রিয়ার কারণে এ সময় বমি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
তথ্যসূত্র : বিবিসি বাংলা

এবিএন/সাদিক/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ