‘বাংলাদেশের সঙ্গে চলমান সম্পর্ক রক্ষায় ভারত সজাগ’

প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২৪, ১১:৪৫

ভারতের জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক শ্রী রাধা দত্ত
শ্রী রাধা দত্ত ভারতের জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক। সিঙ্গাপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর নতুন বই ‘বাংলাদেশ অন এ নিউ জার্নি: মুভিং বিয়ন্ড দ্য রিজিওনাল আইডেন্টিটি’। ভারতীয় থিঙ্কট্যাঙ্ক ভারতের বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের সদস্য। গতকাল শনিবার নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীদের শীর্ষ বৈঠক প্রসঙ্গে তিনি একটি জাতীয় দৈনিকে সাক্ষাৎকার দেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফারুক ওয়াসিফ। সাক্ষাৎকারটি নিচে হুবহু তুলে ধরা হল-
প্রশ্ন: কূটনৈতিক প্রথা অনুযায়ী ভারতে নতুন সরকার নির্বাচিত হওয়ার পরে বাংলাদেশের সরকারপ্রধানের আনুষ্ঠানিক সফর হয়। দ্বিপক্ষীয় স্বার্থ নিয়ে আলোচনা ও চুক্তিও হয়। বাংলাদেশে শেখ হাসিনা চতুর্থবারের মতো এবং ভারতে নরেন্দ্র মোদি তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করেছেন। নয়াদিল্লিতে দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় শীর্ষ বৈঠকে ১০টি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এর বাইরে চলমান সমস্যাগুলোর ব্যাপারে কী কী প্রত্যাশা করা যেতে পারে?
শ্রী রাধা দত্ত: শোনা যাচ্ছে, এবারে বাংলাদেশের সঙ্গে নতুন ‘লাইন অব ক্রেডিট’ বা ঋণচুক্তি হবে। ২০১০ সালের যে ঋণচুক্তি, তাতে অনেক শর্ত কঠোর থাকায় ঋণ ছাড় করা যাচ্ছিল না। তাই প্রকল্পগুলো থমকে আছে।
প্রশ্ন: কিন্তু ২০১০, ২০১৬ ও ২০১৭ সালের তিনটি ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) আওতায় ঋণ পাওয়া গেছে চার ভাগের মাত্র এক ভাগ।
রাধা দত্ত: সে জন্যই এবার কিছুটা নমনীয় শর্তে ‘লাইন অব ক্রেডিট’ বিষয়ে সমঝোতার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া দুই প্রধানমন্ত্রী কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্টের (সিইপিএ) অগ্রগতি, বাণিজ্য, সংযোগ, জ্বালানি, নতুন প্রযুক্তিসহ নানা বিষয়ে আলোচনা করতে পারেন। এসব বিষয়ে চুক্তির পর্যায়ে পৌঁছাতে পারলে অমীমাংসিত আরও অনেক সমস্যা সমাধানের দুয়ার খুলে যেতে পারে।
প্রশ্ন: তিস্তার পানি বণ্টন বিষয়ে বাংলাদেশের এবং প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্প নিয়ে ভারতের আগ্রহ রয়েছে। এ দুটি ব্যাপারে নজরকাড়া কোনো অগ্রগতি কি হলো?
রাধা দত্ত: তিস্তা নিয়ে কথা উঠছে। প্রথমত, তিস্তার পানির ভাগাভাগি নিয়ে পশ্চিম বাংলার সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের ইস্যুটা কিন্তু এখনও সমাধান হয়নি। সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতায় আর সেই নরেন্দ্র মোদিই তো দিল্লিতে আছেন। তা ছাড়া তিস্তার পানিপ্রবাহও অনেক কমে গেছে। তাই ২০১১ সালের পানিপ্রবাহের ভিত্তিতে এখন আলোচনা করা কঠিন।
প্রশ্ন: কিন্তু বাংলাদেশের উজানে পানিপ্রবাহ তো প্রাকৃতিক কারণে নয়, ভারতের আরও উজানে পানি সরানোর জন্য কমে গেছে। আন্তর্জাতিক আইনে তাই পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ার যুক্তি ধর্তব্য নয়।
রাধা দত্ত: মূল সমস্যাটা পশ্চিম বাংলার সঙ্গে। সে জন্যই আমি পানি বণ্টন চুক্তির কোনো জায়গা দেখছি না। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে নতুন কিছু আমি শুনিনি। তবে তিস্তার ম্যানেজমেন্ট নিয়ে কথা হতে পারে। প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্পে ভারত-বাংলাদেশ একসঙ্গে কাজ করতে পারে। ভারতও জানে বাংলাদেশের জন্য এটা স্পর্শকাতর বিষয়। কিন্তু ভারতের জন্য এটা আন্তঃসীমান্ত প্রকল্প– এ ব্যাপারে তাদের উদ্বেগ আছে। এ ব্যাপারে ভারতীয় পরিভাষা হলো, ‘তিস্তা অর্থনৈতিক অঞ্চলে ভারতীয় বিনিয়োগ।’ দুই পক্ষেরই যাতে ভালো হয়, সে ব্যাপারে এগিয়ে যাওয়ার উপায় খুঁজছে ভারত।
প্রশ্ন: তিস্তা প্রকল্পে ভারত জড়িত হলে উন্নয়ন-সহযোগী চীনের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হতে পারে। বিশেষ করে, বাংলাদেশের যখন চীনা ঋণ খুব প্রয়োজন।
রাধা দত্ত: বাংলাদেশে শুনেছি, চীন তিস্তা প্রকল্পে অর্থায়নে আগ্রহী। অনেকে বলছেন, ভারত জড়িত হলে চীন অসন্তুষ্ট হতে পারে। দেখুন, চীন তো বাংলাদেশে অনেকগুলো রেলসেতু, সড়ক অবকাঠামো, ফ্লাইওভার, এনার্জি প্রকল্পসহ পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্পে জড়িত। বাংলাদেশের সামরিক অবকাঠামোর মূল সরবরাহকারীও চীন। চীন তিস্তার জন্য এত সব সম্পর্ক ছেড়ে দেবে না। বাংলাদেশও ভারতের ক্ষতি করে তিস্তা প্রকল্পের পুরোটা চীনকে দেবে না। তাই এমন না যে, চীন রেগে গেল বাংলাদেশ তা নিয়ে খুব ভাববে। ভারত এত দিন নিজের অভ্যন্তরীণ কারণে এগিয়ে আসতে পারেনি। যেখানে ভারত পিছিয়ে, সেখানে চীন এগিয়ে এসেছে। তবে এখন ভারত এগিয়ে আসতে সক্ষম।
প্রশ্ন: আপনি জানেন বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার সংকটসহ সার্বিক অর্থনৈতিক সংকট যাচ্ছে। সময়টা নাজুক। এমন পরিস্থিতিতে চীনের ঋণ ও বিনিয়োগ হারানোর ঝুঁকি কি বাংলাদেশ নিতে পারে?
রাধা দত্ত: অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কঠিন যাচ্ছে, তা ঠিক। কিন্তু বাংলাদেশ তো আইএমএফের ঋণ পাচ্ছে, তৃতীয় কিস্তিও ছাড় হচ্ছে বলে শুনেছি। ভারতের লাইন অব ক্রেডিটও থাকছে। এর আগে বাংলাদেশ চীনের আপত্তি সত্ত্বেও ইন্দো প্যাসিফিক আউটলুক প্রকাশ করেছে। কই, চীন কি তাতে সম্পর্ক শেষ করে ফেলেছে? বাংলাদেশ তো চীন ও ভারত উভয়ের সঙ্গেই কাজ করে যাচ্ছে।
প্রশ্ন: অতীতের ভারতীয় ঋণের যে অভিজ্ঞতা, তাতে কি ভারত এত বড় প্রকল্প অর্থায়নে সক্ষম?
রাধা দত্ত: আমি মনে করি, ভারত সক্ষম। বাংলাদেশ যদি কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ চেয়ে থাকে, আমার মনে হয়, ভারত তা দেবে।
প্রশ্ন: এবারে দুই দেশের মধ্যে ব্যাপকতম সংযুক্তির কথা আসছে। ইতোমধ্যে সড়ক-রেল-নৌ-আকাশপথে সংযুক্তি হয়েছে। এর পরে নতুন কী আসতে পারে?
রাধা দত্ত: হয়তো প্রতিরক্ষা খাতে সংযুক্তির কথা আসছে। দুই প্রধানমন্ত্রীর সমঝোতা স্মারকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল এটি। বাংলাদেশকে ভারতের দেওয়া ৫০০ মিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা-বিষয়ক ঋণচুক্তি এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। এর অধীনে বাংলাদেশে ভারতীয় সামরিক যানবাহন বিক্রি করা যেতে পারে। উত্তর-পূর্ব ভারতে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতীয় কার্গো নিরবচ্ছিন্নভাবে যেতে পারে। বর্তমানে তা মিয়ানমারের যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে আটকে আছে। বাংলাদেশের মোংলা বন্দরে রেলসংযোগ এবং কার্গো টার্মিনাল করার কথা। এবারে তা নিয়েও অগ্রগতি আছে। রিজিয়নালিজম ও অর্থনৈতিক করডোর বিষয়েও কাজ এগোচ্ছে।
প্রশ্ন: রিজিয়নালিজম বলতে তো পুরো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বোঝায়। এর মধ্যে ভারত-পাকিস্তান যেমন আছে, তেমনি আফগানিস্তান, মালদ্বীপ, নেপাল, ভুটানও আছে। অথচ ভারতের সঙ্গে যেটা হচ্ছে, সেটা তো দ্বিপক্ষীয় ব্যাপার। এখানে রিজিয়নালিজম কোথায়?
রাধা দত্ত: দুটি দেশই চেষ্টা করছে দ্বিপক্ষীয় বন্ধন দৃঢ় করতে। দেখুন, আফগানিস্তান বা শ্রীলঙ্কার যা দরকার, তা বাংলাদেশ বা মালদ্বীপের দরকার নেই। একেকটা দেশের অর্থনীতি এতটাই আলাদা রকমের। এ জন্যই সার্ক কাজ করেনি। তাই সাব-রিজিয়নালিজমের দিকে যেতে হয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত-নেপাল-ভুটান মিলিয়ে যোগাযোগ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। সবগুলো দেশের মধ্যে কমন হলো ভারত। ভারত যেমন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যেতে চায়, বাংলাদেশও তেমন চায়। বাংলাদেশ ভারতকে ট্রানজিট দিয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে কলকাতার জাহাজ আগরতলায় পণ্য পাঠিয়েছে। মোংলা বন্দরের কাজ শেষ হলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেও মালপত্র নিতে পারবে। বাংলাদেশও তা পারবে। ভারত-বাংলাদেশ-নেপাল-ভুটান সাব-রিজিয়নালিজমকে আরও বড় করা যায়। এদিকে বিমসটেক (বিআইএমএসটিইসি) ও মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম বাস্তবায়িত হলে পুরো অঞ্চলে যে অগ্রগতি হবে, তার সুফল বাংলাদেশও পাবে।
প্রশ্ন: সীমান্ত হত্যা পুরোপুরি বন্ধে কোনো অগ্রগতি কি হলো?
রাধা দত্ত: দুটি নিবিড়তম বন্ধু দেশের মধ্যে সীমান্ত হত্যা নিন্দনীয় ব্যাপার। গুলি হচ্ছে, বিএসএফের প্রটোকলের জন্য। অন্যদিক থেকে দেখলে, এই দুই দেশের সীমান্তে অসম্ভব রকম চোরাচালান হয়। সেটা বন্ধে গুলি হয়। বাণিজ্যচুক্তি হয়ে গেলে দুই দেশের মধ্যে ‘নিষিদ্ধ’ জিনিস ছাড়া সবই বৈধ পথে যেতে পারবে।
প্রশ্ন: কিন্তু গুলি তো হয় এক দিক থেকে, নিহতরা প্রায় সবাই বাংলাদেশি! অনেকে সীমান্তের ভেতরে গরু চরাতে গিয়েও গুলি খেয়েছেন। অন্তত প্রাণঘাতী বুলেট ব্যবহার তো বন্ধ হতে পারে।
রাধা দত্ত: সেটা আমি বলতে পারব না। তবে বিএসএফ যা বলছে, ভারতে যা বলা হয় তা হলো, সীমান্তে রাতের অন্ধকারে চলাচল বন্ধ করা দরকার। রাতেই চোরাচালান বেশি হয় এবং অন্ধকারে কে কী করছে, তা বোঝা সম্ভব না। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ রাজি হয়নি। নিশ্চয়ই দু’দিকেই সমস্যা রয়েছে। দু’দিকের লোকই জড়িত। উচ্চ পর্যায়ে বসে সেটা সমাধান করতে হবে।
প্রশ্ন: আপনি একটি আলোচনায় বলেছিলেন, বাংলাদেশে শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি হলে ভারত বসে থাকবে না। এর দুটি অর্থ হতে পারে: শ্রীলঙ্কার মতো অর্থনৈতিক ধস এবং সেখানকার মতো জনবিক্ষোভ। আপনি কী অর্থে কথাটা বলেছিলেন?
রাধা দত্ত: বাংলাদেশ যাতে স্থিতিশীল থাকে, ভারতের সঙ্গে বর্তমানের যে সম্পর্ক, তা যাতে বজায় থাকে, তার জন্য ভারত সজাগ। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত এতটাই জড়িত যে, এসবে কোনো সমস্যা হলে ভারত তো উদ্বিগ্ন হবেই।
প্রশ্ন: আপনাকে ধন্যবাদ।
রাধা দত্ত: আপনাকেও ধন্যবাদ।
সৌজন্যে : দৈনিক সমকাল। এবিএন/জেডি
সৌজন্যে : দৈনিক সমকাল। এবিএন/জেডি
এই বিভাগের আরো সংবাদ