আজকের শিরোনাম :

‘বাজেটের মূল চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ’

  এ এস এম সাদ

২৭ মে ২০২৩, ১৪:৪৭ | অনলাইন সংস্করণ

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ
কোভিড-১৯ ও ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বাইরের দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। বাংলাদেশেও এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। এ অবস্থায় আগামী অর্থবছরের বাজেটে মূল চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।  সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ এস এম সাদ। সাক্ষাৎকারটি নিচে তুলে ধরা হল-

প্রশ্ন : গত কয়েক মাস ধরেই দেশের মূল্যস্ফীতি চড়া। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজেটে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া জরুরি বলে মনে করেন?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর একটি দেশ। প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্য বাইরে থেকে আমদানি করতে হয়। এসব পণ্যের দাম বাড়ছে। দুটি কারণে দাম বাড়তে পারে। প্রথমত, এসব পণ্যের সরবরাহ কম। যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকু সরবরাহ হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকলে সঠিকভাবে মজুত করা হয়নি। কারসাজির মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা সংকট তৈরি করছে। এ জন্য এসব নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। অন্যদিকে বহির্বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও নানা রকমের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। কোভিড-১৯ ও ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে পুরো বিশ্বের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বাইরের দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। বাংলাদেশেও মূল্যস্ফীতির প্রভাব পড়েছে। আয় না বাড়লেও ব্যয় বাড়ছে। এতে মানুষের জীবনমানের অবনতি হয়েছে। আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী জ্বালানি থেকে ভর্তুকি উঠিয়ে দেবে সরকার। ফলে জ্বালানির দাম সামনে আরও বাড়বে। জ্বালানির দাম বাড়লে মধ্যবিত্তরা আরও চাপের মধ্যে পড়বে। কারণ সবকিছুর দাম বাড়তে থাকে। অন্যদিকে গত এক বছর ধরে টাকার মানের অবমূল্যায়ন হয়েছে। এতে আমদানির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এলসি খুলতে হিমশিম খাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। কারণ মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি করতেই হবে। না হলে দেশের উৎপাদন ব্যাহত হবে। উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বেসরকারি বিনিয়োগ এবং বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। সমন্বিত পরিকল্পনা ছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।

প্রশ্ন : বিভিন্ন খাত থেকে ভর্তুকি উঠিয়ে দেয়া হবে বলে জানা যাচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : আইএমএফ যতই শর্ত দিক না কেন কৃষি খাত থেকে ভর্তুকি উঠানো যাবে না। কৃষি খাত থেকে ভর্তুকি উঠিয়ে দিলে বিপর্যয় নেমে আসবে। কারণ কৃষক তার ন্যায্যমূল্য পান না। তার মধ্যে আমদানি বাড়িয়ে দিতে হবে। এটি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আরও হুমকির মধ্যে ফেলবে। জ্বালানি খাত থেকে ধীরে ধীরে ভর্তুকি উঠিয়ে দেয়া যায়। বিভিন্ন খাতকে সরকার বিশেষ সুবিধা দেয়। এর মধ্যে রয়েছে গার্মেন্ট খাত। তাদের জন্য নানা ধরনের সুবিধা দেয়া হয়। রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) থেকে তাদের জন্য নানা রকমের সুযোগ দেয়া হয়েছে। তবে গার্মেন্ট খাতের ব্যবসায়ীদের এটাও বোঝা জরুরি, স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে নিজেদের দাঁড়ানোর সময় হয়েছে। তাই সরকারকে এমন জায়গায় মনোযোগী হওয়া জরুরি- যেখানে সর্বসাধারণ উপকৃত হন। ফলে ভর্তুকি থাকবে। একেবারে যেন না উঠিয়ে দেয়া হয়। সরকার মাছের খামারি ও পোলট্রি খাতে ভ্যাট বসিয়েছে। এসব খাত থেকে ভ্যাট-ট্যাক্স উঠিয়ে দেয়া জরুরি। কারণ এসব খাতে উৎপাদনে যত কম খরচ হবে, তত কম দাম পাওয়া যাবে। বরং যেসব খাতে ট্যাক্স বাড়ানোর দরকার, সেসব খাতে ট্যাক্স বাড়িয়ে দেয়া উচিত। সেবা খাত মূল্যস্ফীতি কমাতে সাহায্য করে না। খাদ্যপণ্যের দাম কমলে মূল্যস্ফীতি কমবে। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাত থেকে অপ্রয়োজনীয় ভ্যাট-ট্যাক্স উঠিয়ে দেয়া জরুরি বলে আমি মনে করি।

প্রশ্ন : সমাজে বৈষম্য কমানোর জন্য বাজেট কী রকম হওয়া জরুরি?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : দেশে জিডিপির অনুপাতে প্রত্যক্ষ কর আহরণের পরিমাণ অনেক কম। এটিই দেশে ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্যের অন্যতম বড় কারণ। তাই আয়বৈষম্য কমাতে ও কর–জিডিপির অনুপাত ি বাড়াতে হলে প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেয়া কর অব্যাহতি সুবিধাও বাদ দেয়া যায় কি না, তা ভেবে দেখতে হবে। অনেকের আয় বছরে ১০ লাখ টাকা। আবার অনেকের ১০০ কোটি টাকা। কিন্তু দেখা যায় কম বেতন পাওয়া নাগরিকরা সঠিকভাবে কর প্রদান করছে। কিন্তু মাসে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করার পরও অনেকে সঠিক নিয়মে কর প্রদান করছে না। ফলে সমাজে কর দেয়া না দেয়া নিয়ে এক ধরনের বৈষম্য তৈরি হয়েছে। এ বৈষম্য দূর করা জরুরি। রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। কারণ এই আয়ের মাধ্যমে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় হয়। রাজস্ব আয় যত বেশি হবে, এসব খাত তত বেশি উন্নত হবে। সুফল ভোগ করবে দেশের গরিব ও সাধারণ জনগণ। এটি নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছাড়া একটি সফল বাজেট তৈরি করা সম্ভব নয়। স্বাস্থ্য খাতের কথা উঠলেই দেখা যায় সরকারি হাসপাতালে ১০০ টাকার মধ্যে ৭০ টাকা খরচ হয়। আর বেসরকারি হাসপাতালে আরও বেশি। বেসরকারি হাসপাতাল ছাড়া তো এখন কোনো চিকিৎসাই পাওয়া যায় না।

প্রশ্ন : আর্থিক খাতে সবচেয়ে দুর্বল দিক কোনটি?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : আর্থিক খাতে সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ব্যাংক ব্যবস্থায়। এ খাতে কোনো ধরনের সুশাসন নেই। কারণ ব্যাংক থেকে অনেকে ঋণ নেয়। কিন্তু সেই ঋণের টাকা আর ফেরত দেয় না। সেসব টাকা তারা বিদেশে পাচার করে দিয়েছে। ফলে ব্যাংক খাতে এক ধরনের অরাজকতা তৈরি হয়েছে। প্রভাবশালীরা বিভিন্ন কায়দায় ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোরও দোষ রয়েছে। প্রথমে একটি ব্যাংকে একই পরিবার থেকে ২ জন পরিচালক থাকতে পারত। পরে চারজন করা হলো। আবার ৩ জনের নিয়ম করা হলো। এসব কিছু তো প্রভাবশালীদের প্রভাবেই হয়েছে। এটা কোনো নিয়ম হতে পারে না। আবার ব্যাংকে যাদের ইন্ডিপেনডেন্ট ডিরেক্টর করা হয় তারা ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা চেয়ারম্যানের বন্ধু। খেলাপি ঋণের বিষয়টি পুরোপুরি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেখভাল করা উচিত। কারণ ব্যাংক এসব খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সক্ষম হবে না। আইনেও নানা ধরনের দুর্বলতা রয়েছে। একটি ব্যাংকে চেয়ারম্যান ও পরিচালক নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করে। চেয়ারম্যান এমডিদের নানাভাবে খুশি করেন আবার এমডিরাও চেয়ারম্যানদের খুশি করেন। এ ছাড়া রাজনৈতিক প্রভাবও রয়েছে।

প্রশ্ন : প্রতিবছর বাজেটের দুর্বল দিকগুলো সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : প্রতিবছরই বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) পুরো বাস্তবায়ন হয় না। কারণ প্রতিবছর বড় বড় বাজেট ঘোষণা করলেও বাস্তবায়ন হয় না। বাজেট বাস্তবধর্মী হওয়া জরুরি। ছোট বাজেট ঘোষণা করলেও সেটি বাস্তবায়ন করা ভালো। প্রকল্পগুলোর গুণগতমান খুবই দুর্বল। ফলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রকল্প নির্বাচন, পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেয়া, যথাসময়ে বাস্তবায়ন এবং গুণগতমান নিশ্চিত করা জরুরি। কিছু বরাদ্দ একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। এরপরও রাজনৈতিক কারণে বরাদ্দ দেয়া হয়। এটি যৌক্তিক নয়। দুর্নীতিও বাজেট বাস্তবায়নে বড় বাধা। সরকারের অনেক কেনাকাটায় দুর্নীতি ও অপচয় হয়। এগুলো বাজেটের উল্লেখযোগ্য দুর্বল দিক। এডিপিতে রাস্তাঘাট উন্নয়নে অনেক বরাদ্দ দেয়া হয়। তবে সামগ্রিক দিক বিবেচনা করলে কোনো কাজই ঠিকমতো করা হয় না। ফলে সার্বিক দিক থেকে বিবেচনায় আনতে হবে কোন খাতে উন্নয়নের জন্য কত বরাদ্দ দেয়া জরুরি।

প্রশ্ন : রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দেশের অর্থনীতিতে কী প্রভাব ফেলতে পারে?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থব্যবস্থা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। শ্রীলঙ্কার পর পাকিস্তানের অবস্থাও নাজুক। এই যুদ্ধ কবে থামবে কেউ বলতে পারছে না। কাঙ্ক্ষিত রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না। আমদানির চিত্রও প্রায় একই। বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। কারণ বিনিয়োগের অনেকটাই আমদানিনির্ভর। মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এগুলোর আমদানি কমে গেলে বুঝতে হবে বিনিয়োগ কমে গেছে।

প্রশ্ন : বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে করণীয় কী?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : যুদ্ধ পরিস্থিতির উন্নয়ন না হলে বিনিয়োগ বাড়বে না। যদিও যুদ্ধের আগে থেকেই বেসরকারি বিনিয়োগ পরিস্থিতি খারাপ ছিল। বিনিয়োগের পরিবেশটা আগে তৈরি করতে হবে। আস্থাহীনতা দূর করতে হবে। শুধু ট্রেড বাণিজ্য নয়, শিল্পায়নে নজর দিতে হবে। তাহলে বেসরকারি বিনিয়োগ কিছুটা হলেও ঘুরে দাঁড়াবে। বিনিয়োগ বাড়লে বাড়বে কর্মসংস্থান। দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা জরুরি।

প্রশ্ন : দেশে বেকারত্ব সমস্যা কীভাবে দেখছেন?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : বেকারত্ব বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা। তাই বাজেটে এ বিষয়ে দিকনির্দেশনা থাকা জরুরি। প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে অসংখ্য শিক্ষার্থী বের হচ্ছে। সে হিসাবে চাকরি তারা পাচ্ছেন না। সার্বিক দিক থেকে বিবেচনা করলে দেশে কর্মসংস্থান বাড়ছে না। প্রবৃদ্ধি অনেক কম। ফলে এসব বিষয় নিয়ে ভাবার সময় হয়েছে।


সৌজন্যে : দৈনিক বাংলা।

এবিএন/জেডি

এই বিভাগের আরো সংবাদ