‘২০৩০ সালের মধ্যে অর্থনীতিতে ৪০ বিলিয়ন ডলার যোগ করবে বেজা’

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১১ মার্চ ২০২৩, ১২:৫৪

বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন।
শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন ও বিকেন্দ্রিকরণের লক্ষ্যে ২০৩০ সালের মধ্যে সারাদেশে ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য সরকারের। কর্মসংস্থানের লক্ষ্য এক কোটির বেশি মানুষের। ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) এ লক্ষ্যে কাজ করছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ শেষ হয়েছে যেখানে দেশি-বিদেশি বড় বড় কোম্পানি বিনিয়োগও করেছে। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর সর্বশেষ অগ্রগতি ও বিনিয়োগের অবস্থা নিয়ে একটি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন।  সাক্ষাৎকারটি নিচে তুলে ধরা হল-

প্রশ্ন : বেজা এখন পর্যন্ত কতগুলো অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ শেষ করেছে, ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০ অঞ্চল প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে কি-না?

শেখ ইউসুফ হারুন : এখন পর্যন্ত ৯৭টির অনুমোদন হয়েছে। অন্যদিকে ১০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ শেষ হয়ে উৎপাদন শুরু হয়েছে। বাস্তবায়নাধীন অর্থনৈতিক অঞ্চল ২৯টি। সরকারি, বেসরকারি, পিপিপি, জিটুজিসহ ৬ ধরনের অর্থনৈতিক অঞ্চল রয়েছে। সরকারিগুলো ছাড়া বাকিগুলো চাহিদা অনুযায়ী ডেভেলপ হচ্ছে।  সরকারিভাবে জামালপুর অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ শেষে জমি বরাদ্দও শেষ। কলকারখানা প্রতিষ্ঠাও শুরু করেছে। সিটি, মেঘনাসহ বেসরকারি ১০টি ইকোনমিক জোন গড়ে তোলার কাজ শেষে উৎপাদন শুরু হয়েছে।  দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগর (বিএসবিএন) পর্যায়ক্রমে গড়ে তোলা হচ্ছে। সেখানে কিছু প্রতিষ্ঠান উৎপাদনও শুরু করেছে। এ শিল্প নগরীর মোট ৩৩,৫০০ একর আয়তনের মধ্যে বেজা পেয়েছে ১৭ হাজার একর জমি।  জিটুজি-ভিত্তিক জোনের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার জাপানিজ অর্থনৈতিক অঞ্চল সবচেয়ে এগিয়ে। ওখানের প্রথম পর্যায়ের ভূমি হস্তান্তর শেষ এবং দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ চলমান।  ভারতে সঙ্গে দুইটি জিটুজি জোনের কাজ শুরুর অপেক্ষায়। চাইনিজ অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য ডেভেলপাপার কোম্পানির সঙ্গে  আমাদের প্রথম নেগোসিয়েশন মিটিং হয়েছে। ডি-৮ (ডেভেলপিং এইট) সচিবালয় সদস্যভুক্ত দেশগুলোর জন্য আরো একটি নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছে।  এর বাইরে সৌদি আরব ৩০০ একর জমিতে 'কান্ট্রি স্পেসিফিক' জোন করতে চায়। সিঙ্গাপুরও আমাদের কাছে জমি চেয়ে প্রস্তাব দিয়েছে। সুতরাং, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য ২০৩০ সালের মধ্যেই ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা হবে।  এসব অঞ্চল ১ কোটি লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি বার্ষিক অতিরিক্ত ৪০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি করবে।

প্রশ্ন : বেজার উন্নয়ন করা জমির দাম বেশি বলে অভিযোগ করছেন উদ্যোক্তারা, ছোট শিল্পের জন্য এটি বহন করা কঠিন দাবি কারো কারো…এটা কি সত্যি?

শেখ ইউসুফ হারুন : ইকোনমিক জোনের বাহিরে জায়গার দাম আমাদের  চেয়ে ৪-৫ গুণ বেশি। আমরা নিচু জায়গা ভরাট করেছি, রাস্তাঘাট করেছি, সব ধরনের ইউটিলিটি সংযোগ দিয়েছি। এসবের মূল্য যোগ করে 'কস্ট বেনিফিট' চিন্তা করলে আমরা যে দামে দিচ্ছি সেটাকে স্বস্তাই বলা যায়।  এছাড়া কোনো বিনিয়োগকারী আমাদের কাছে এসে ডেভেলপ এবং আনডেভেলপ উভয় ধরনের জমি নিতে পারবেন। আনডেভেলপ জমি নিলে তার দাম অনেক কম হবে। আমাদের হাতে ডেভেলপ হয়নি এমন ৬২ হাজার একর জায়গা রয়েছে।

প্রশ্ন : জমি ইজারা চুক্তির পর নতুন করে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের অভিযোগ করছেন উদ্যোক্তারা। এক্ষেত্রে আপনাদের পদক্ষেপ কি?

শেখ ইউসুফ হারুন : অনেক অর্থনৈতিক অঞ্চলে চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার ভ্যাট আইন হয়েছে। ভ্যাট আইনটি সাধারণ অন্যান্য আইন ও চুক্তির ঊর্ধ্বে। ফলে চুক্তির পর উদ্যোক্তাদের জমির ওপর ভ্যাট আরোপ হয়েছে। ইজারা নেয়া জমির মূল্যের ওপর বাড়তি ১৫% ভ্যাট দিতে বিনিয়োগকারীরা অপারগতা প্রকাশ করছেন। আমরাও বিষয়টি নিয়ে অংশীজনদের সাথে আলোচনা করেছি।  আমরা  জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) বলেছি, বেজা ভূমি উন্নয়ন সংস্থা। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ভূমি উন্নয়ন করে আবাসনের জন্য দেয় তাতে ভ্যাট ২ শতাংশ। আমাদের বেলায় ভ্যাট ১৫% কেন হবে? আমি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কেও বলেছি। নীতিগতভাবে এনবিআর একমত হয়েছে। আমরা ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পাওয়ার অপেক্ষা করছি।

প্রশ্ন : বেজার অন্যতম একটি উদ্যোগ ছিল ওয়ান স্টপ সার্ভিস, যা ২০১৫  সালে শুরু করার পর এখনো অধিকাংশ সার্ভিস না পাওয়ার অভিযোগ করছেন ব্যবসায়ীরা। কেন এমনটা হচ্ছে?

শেখ ইউসুফ হারুন : এখন পর্যন্ত বেজা  ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার থেকে ১২৫ ধরনের সেবা প্রদান করা হচ্ছে। এর মধ্যে ৫০টি সেবা প্রদান করা হচ্ছে অনলাইনে। এ সেবাগুলো আমরা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই দিচ্ছি। বাকি যে ৭৫টি সেবা রয়েছে তা এককভাবে আমাদের হাতে নেই। আমরা নিজেদের প্রদত্ত সেবা বৃদ্ধি ও ব্যবসায়ীদের ভোগান্তি কমানোর চেষ্টা করছি।  ব্যবসায়ীরা শিগগিরই ট্রেড লাইসেন্স, জমি রেজিস্ট্রেশন, নামজারি, পরিবেশ ছাড়পত্র, নির্মাণ অনুমোদন, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি-সংযোগ, টেলিফোন-ইন্টারনেট সংযোগ, বিস্ফোরক লাইসেন্স, বয়লার সার্টিফিকেটসহ সব সেবা এক ছাতার নিচ থেকে এবং অনলাইনে পেয়ে যাবেন।

প্রশ্ন : বেজা বিনিয়োগকারীদের আর কি কি সেবা দিচ্ছে?

শেখ ইউসুফ হারুন : বেজা মূলত সমন্বয়কারী প্রতিষ্ঠান। বিনিয়োগকারী সঙ্গে সরকার বা সরকারি বিভিন্ন বিভাগ/অধিদফতরের সঙ্গে আমরা লিংক করে দেই। বিনিয়োগকারীদের সমস্যাগুলো শুনে আমরা সাধ্যমতো সমাধানের চেষ্টা করি। আর যেগুলো অন্য বিভাগের কাজ সেগুলো আমরা চিঠি দিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগকে জানাই।  উদাহরণ হিসাবে, গত বছর আমেরিকান প্রতিষ্ঠান  হান্টসম্যান কর্পোরেশন- এর ওয়ারহাউজ সিঙ্গাপুর থেকে বাংলাদেশে ট্রান্সফার করলো। কিন্তু তাদের বন্ড লাইসেন্স না থাকায় পারছিল না। আমরা তখন প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের তৎকালীন মুখ্য সচিবসহ এনবিআর চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করি। এবং এনবিআর চেয়ারম্যান তাৎক্ষণিকভাবে এ সমস্যার সমাধান করে দেন।

প্রশ্ন : বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ইজ অব ডুয়িং বিজনেস সূচকে এ পিছিয়ে থাকাকে দায়ী করছেন উদ্যোক্তারা। বিশ্বব্যাংক ২০২১ সাল থেকে এ সূচকের কাজ বন্ধ রেখেছে। নিজেদের উন্নয়নে আপনারা তা অব্যাহত রেখেছেন কিনা?

শেখ ইউসুফ হারুন : ব্যবসা সহজীকরণের প্রতিটি ইনডেক্স নিয়ে আমরা কাজ করছি। ভূমি পাওয়া, নামজারি, পরিবেশ ছাড়পত্র, নির্মাণ অনুমোদন, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি-সংযোগসহ সব সার্ভিস যেন সহজে পাওয়া যায়- আমরা তা নিশ্চিত করতে চাই।  কাস্টমস ও বন্দরে পণ্য খালাস যেন সহজে হয়- সেজন্য অটোমেশন করা হচ্ছে। বিদেশি কোম্পানি দেশে বিনিয়োগ করলে তাদের মুনাফা সহজে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছি। আমাদের মিশন হলো ব্যবসার পরিবেশ সহজতর করা ।

প্রশ্ন : বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিধির তুলনায় সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই ১ শতাংশের কম। এটা এত কম কেন?

শেখ ইউসুফ হারুন : অনেক বিদেশি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের কোম্পানির সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগ করছে। এসব বিনিয়োগকে এফডিআই হিসাবে ধরা হয় না। করলে এফডিআই আরো বেশি হতো।  গত এক দশক ধরে আমরা যেসব উদ্যোগ নিয়েছি, তাতে আশা দেখছি। বাংলাদেশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বরাদ্দ নেয়া জাপানি প্রতিষ্ঠানগুলো আসলে আমাদের এফডিআই টার্গেট পার করে চলে যাবে। এ জোনের প্রথম ফেজ চালু হলেই তা বেড়ে যাবে।

প্রশ্ন : ভারত, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া রেখে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কেন বাংলাদেশে আসবে? আপনারা কী সুবিধা দিচ্ছেন?

শেখ ইউসুফ হারুন : বিদেশি কোম্পানির বাংলাদেশে আসার প্রথম কারণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। এক্ষেত্রে উপমহাদেশের যেকোনো দেশের চেয়ে আমরা ভালো পজিশনে রয়েছি। তাইওয়ানের একজন শিল্পপতির মায়ানমারে ১৯টি শিল্প প্রতিষ্ঠান ছিল। ওখানকার রাজনৈতিক সমস্যার কারণে তারা বাংলাদেশে শিফট করতে চায়।  দ্বিতীয় বিষয় হলো- আমাদের দেশে অন্য দেশের তুলনায় সহজে দক্ষ শ্রমিক পাওয়া যায়। আমরা যে সাপোর্ট দিচ্ছি সেটা অনেক দেশের তুলনায় ভালো। আমাদের আকর্ষণীয় প্রণোদনা রয়েছে।

প্রশ্ন : বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্যে আপনি কী বলতে চান?

শেখ ইউসুফ হারুন : আমরা নিষ্কন্টক জমি দিচ্ছি। অনেক ক্ষেত্রে জমি ডেভলপ করে দিচ্ছি। সকল ইউটিলিটি সাপোর্ট পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস টেলিফোন আমরা তাদের দোরগোড়ায় দিচ্ছি। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো আমাদের জোনের মধ্যে যারা বিনিয়োগ করে তারা আকর্ষণীয় প্রণোদনা পায়। ১০ বছর পর্যন্ত কর-সুবিধাসহ অন্যান্য সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।  এরপরও যেসব বিনিয়োগকারী জমি নেওয়ার দুই বছর পরও শিল্প কারখানা স্থাপন করছেন না তাদেরকে দ্রুতই কাজ শুরুর আহ্বান জানাচ্ছি। জমি নেয়ার দুই বছরের মধ্যে শিল্প কলকারখানা স্থাপনের শর্ত রয়েছে। করোনার কারণে অনেকেই তা পারেননি। তবে এখন শুরু না করলে আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

 


সৌজন্যে : দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।
প্রতিবেদক : আব্বাস উদ্দিন নয়ন ও জহির রায়হান।

এবিএন/জনি/জসিম/জেডি

এই বিভাগের আরো সংবাদ