আজকের শিরোনাম :

‘নিজেদেরই খাদ্য উৎপাদন করে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে হবে’

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ৩১ জুলাই ২০২২, ১৬:৩০

অর্থনীতিবিদ এবং কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ড. গোলাম রসুল
ড. গোলাম রসুল। অর্থনীতিবিদ এবং কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ। বর্তমানে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি, ঢাকার অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক। করোনা পরিস্থিতি ও এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর বৈশ্বিক খাদ্যবাজারে অস্থিরতা এবং বাংলাদেশে এর প্রভাব নিয়ে সম্প্রতি তিনি একটি জাতীয় দৈনিকের সঙ্গে কথা বলেছেন।  সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাফসান গালিব।  সাক্ষাৎকারটি নিচে তুলে ধরা হল-

প্রশ্ন: করোনার কারণে বিশ্বজুড়ে খাদ্যসংকট ও দুর্ভিক্ষের নানা আশঙ্কা ছিল। এরপর এল ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা। এখন পরিস্থিতি কোন জায়গায় আছে?

গোলাম রসুল: মহামারির পর সারা বিশ্ব অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পথে চলছিল। তখন ইউক্রেন যুদ্ধ এসে আবার বিশ্বকে বড় সংকটে ফেলে দিয়েছে। বাংলাদেশেও এর বড় প্রভাব পড়েছে, ইতিমধ্যে কিছু বিষয় আমরা লক্ষও করেছি। আসলে গোটা বিশ্ব এখন একটা মন্দার দিকে চলে যাচ্ছে। এ মন্দার ধরন গত কয়েক দশকের তুলনায় একটু অন্য রকম মনে হচ্ছে। একদিকে মন্দা বাড়ছে, অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে এবং একই সঙ্গে কর্মসংস্থান কমে যাচ্ছে। এটি গুরুতর সংকট, গোটা বিশ্বের জন্যই। ১৯৭০ সালের মন্দায় অনেকটা এমন দেখা দিয়েছিল। ভবিষ্যতের যেকোনো খারাপ পরিস্থিতির জন্য আমাদের প্রস্তুত হতে হবে।

প্রশ্ন: ইউক্রেন যুদ্ধের পর ফুড সভরেনটি বা খাদ্য সার্বভৌমত্ব নামে একটি পরিভাষা বেশ আলোচিত হচ্ছে। বিষয়টি কি ব্যাখ্যা করবেন?

গোলাম রসুল: ফুড সভরেনটির বিষয়টি আগেও প্রচলিত ছিল। তবে এখন এটি নিয়ে বেশি শোনা যাচ্ছে। বিশ্বায়নের শুরুতে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ অনেকে আমাদের বলল, ফুড সভরেনটির চেয়েও ফুড সিকিউরিটি বা খাদ্যনিরাপত্তার দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। ফুড সিকিউরিটি হচ্ছে হাতে টাকা থাকলে প্রয়োজনীয় খাদ্য আমি যেকোনো জায়গা থেকে কিনে নেব। কিন্তু গত দুই বছরের পরিস্থিতি দেখাল, টাকা থাকলেই এখন আর খাদ্য কেনা যায় না। ২০০৮-২০০৯ সালের বৈশ্বিক সংকটের সময় বাংলাদেশেও প্রভাব পড়তে শুরু করে। অনেকের মনে থাকতে পারে, ভারত বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের আমদানি করা পণ্যের ট্রাক সীমান্তে আটকে দিয়েছিল। কারণ, ভারতের মধ্যেও আশঙ্কা ঢুকে গিয়েছিল তাদের দেশেও খাদ্যসংকট দেখা দেবে কি না। ভারতের সঙ্গে সরকারের অনেক আলাপ-আলোচনার পর সেসব পণ্য ছাড় করানো গিয়েছিল। তারপর বাংলাদেশ টাকা নিয়ে থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম এমন আরও দেশের কাছে দৌড়াদৌড়ি করে খাদ্য কিনে সেবারের পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সক্ষম হলো।

ইউক্রেন যুদ্ধের পরে আবার এমন একটি পরিস্থিতি দেখলাম। উৎপাদন ভালো হওয়ায় ভারত এ বছর ১০ মিলিয়ন টন গম রপ্তানি করতে পারবে বলে আশা করেছিল। তখন ভারত তাদের গম রপ্তানি বন্ধ করে দিল। ভারত এখন বাংলাদেশকে গম দিচ্ছে, ইটস ভেরি গুড। তো এবারের বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে খাদ্যকে এখন আর শুধু খাদ্য হিসেবে দেখা হচ্ছে না, এখন এটি একটি অস্ত্র হয়ে উঠেছে। যে কেউ এখন আমার সংকট বুঝে খাদ্যকে আমার বিরুদ্ধে একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। সবার মধ্যে এখন এই উপলব্ধি হয়েছে যে অধিক পরিমাণে অন্য দেশের খাদ্যপণ্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকলে বড় ঝুঁকি তৈরি হবে। এ জন্য নিজের খাদ্য নিজেকেই উৎপাদন করতে হবে, স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে হবে। সেটিই হচ্ছে ফুড সভরেনটি বা খাদ্য সার্বভৌমত্ব। ইতিমধ্যে অনেক দেশ এ ধারণাকে গুরুত্ব দিয়ে খাদ্য উৎপাদন বাড়িয়ে দিয়েছে।

প্রশ্ন: ইন্টারন্যাশনাল গ্রেইনস কাউন্সিল বলছে, ২০২২-২৩ সালে বৈশ্বিক খাদ্য উৎপাদন কমে যাবে। মজুতও গত আট-নয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন হবে। এটি আমাদের জন্য কতটা শঙ্কার হতে পারে?

গোলাম রসুল: এটি বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনেরই শঙ্কার। যেহেতু আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ নই। খাদ্যের একটি বড় অংশ আমাদের আমদানি করতে হয়। একটি পণ্যের উদাহরণ দিয়ে বলি। গম এখন আমাদের প্রধানতম খাদ্য হয়ে উঠেছে, চালের পরেই তার স্থান। আমরা ক্যালরির ৭-৮ শতাংশ এখন গম থেকে নিচ্ছি। এটি বিশাল অংশ। এ চাহিদা আরও বাড়ছে, কিন্তু গমের উৎপাদন তো বাড়ছে না। আমাদের গমের প্রায় ৮০ ভাগই আমদানি করি। এর বেশির ভাগই আমদানি করি আবার রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। ভারত এবং কানাডা থেকেও আমরা গম আমদানি করে থাকি, যদিও সেটি কম। এখন বৈশ্বিকভাবে উৎপাদন কমে গেলে সেটির ধাক্কা সরাসরি এসে পড়বে। আমদানি খরচ বাড়বে, খাদ্যদ্রব্যের দাম তো বাড়বেই। কিছুদিন আগে আমরা ভোজ্যতেল নিয়ে সংকট দেখেছি। এমনিতেই দরিদ্র্য বা নিম্ন আয়ের মানুষেরা তাদের খাদ্যচাহিদা পূরণের জন্য রীতিমতো সংগ্রাম করে যাচ্ছে। এখন গ্রেইনস কাউন্সিলের প্রতিবেদন যা বলছে, তাতে আমাদের জন্য ভয়াবহ দিন অপেক্ষা করছে। বিষয়টি আসলেই গুরুতর।

প্রশ্ন: রাশিয়া-ইউক্রেন গম রপ্তানি চুক্তি কেমন প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন?

গোলাম রসুল: দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক খাদ্যবাজারে একটা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল। এখন এ চুক্তির মাধ্যমে সেটি কিছুটা কাটল বলে আমি মনে করি। এ চুক্তি জরুরি ছিল। এটি শুধু মানবিকতার জন্যও নয়, দুই দেশের নিজ নিজ অর্থনীতি টিকিয়ে রাখার স্বার্থেও। এ চুক্তি বৈশ্বিক বাজারে ইতিবাচক সিগন্যাল দেবে। গম রপ্তানিকারক অন্য দেশগুলোরও আচরণগত পরিবর্তন আসবে। আর আমাদের গমের চাহিদার বিষয়টি তো বললামই এবং সেই গমের বেশির ভাগই এ দুই দেশ থেকেই আসে। এ চুক্তি আমাদের বাজারের জন্য এমনকি ভোক্তাদেরও স্বস্তি তৈরি করবে।

প্রশ্ন: খাদ্যনিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশ কী করছে বা কী করা উচিত?

গোলাম রসুল: কিছু পদক্ষেপ তো নেওয়া হচ্ছে। যার ফলে কৃষি উৎপাদন বাড়ছে, যদিও সেটি চাহিদা অনুসারে বাড়ছে না। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূল এলাকায়, বিশেষ করে দক্ষিণবঙ্গে কৃষি উৎপাদনে পরিবর্তন আনার চেষ্টা চলছে। সেসব এলাকায় লবণাক্ত পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর মতো ফসল উৎপাদনে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী কিন্তু বারবার একটা কথা বলছেন—এক ইঞ্চি আবাদি জমিও যাতে পতিত না থাকে। জনগণকে একটি ভালো বার্তা তিনি দিচ্ছেন। আমাদের মাথাপিছু জমির পরিমাণ খুবই অল্প এবং দিন দিন সেটি আরও কমে যাচ্ছে। এখন তা–ও যদি আমরা পরিপূর্ণ ও যথাযথভাবে ব্যবহার করতে না পারি, তাহলে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাব।

আরেকটা বিষয় হচ্ছে, আমাদের প্রচুর খাদ্যশস্য নষ্ট বা অপচয় হয়। দেড় দুই দশক আগেও ক্যালরি বাড়াতে আমাদের অগ্রাধিকার ছিল ভাত খাওয়া। কিন্তু এখন একটি শিক্ষিত শ্রেণি গড়ে উঠেছে, যাদের আর্থিক সক্ষমতার কারণে ভারসাম্যপূর্ণ খাদ্যাভ্যাস তৈরি হয়েছে। যারা ভাতের পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে মাছ, মাংস, দুগ্ধজাতীয় খাবার, শাকসবজি ও ফলফলাদির খাওয়ার পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে সেসব পণ্যের চাহিদাও অনেক বেড়ে গেছে। এখন এসব পণ্যের পোস্ট হারভেস্ট লস রোধ করাটা জরুরি। কোনো পণ্যই যাতে রাস্তায় ফেলে দিতে না হয়। 

আমাদের স্টোরিং, প্রসেসিং ও প্যাকেজিংয়ের টেকসই ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। এর জন্য সরকারি–বেসরকারি বিপুল বিনিয়োগ দরকার। এবার আমের এত ফলন হলো, এক–দেড় মাসেই কিন্তু আম বাজার থেকে উধাও হয়ে গেল। অথচ আরও দীর্ঘ সময় ধরে এ আম বাজারে থাকতে পারত। এটি অন্যান্য ফল বা শাকসবজির ক্ষেত্রেও। সেটি থাকলে কৃষক বা চাষিও লাভবান হতেন আর ভোক্তারাও একটি পণ্য দীর্ঘদিন ধরে সাশ্রয়ী মূল্যে পেতেন।

আমাদের ফুড ডাইভার্সিটি বা খাদ্যে বৈচিত্র্য বাড়াতে হবে। আমাদের কৃষি ও উৎপাদনব্যবস্থা চালকেন্দ্রিক হয়ে আছে। পোলট্রি ও মাছের উৎপাদনের খাতটা বেশ ভালোভাবেই এগিয়ে গেছে। যদিও করোনার কারণে সেটি কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ খাতগুলোকে যেভাবেই হোক আমাদের রক্ষা করতে হবে। আলুতে আমরা বিশ্বের অন্যতম উৎপাদক দেশ। দামও কম। কিন্তু তরকারি ছাড়া আলুর ব্যবহার কম। থাইল্যান্ডে দেখেছি আলু থেকে প্রায় ৫০ ধরনের খাদ্য তৈরি হয়। আমাদেরও তেমন ভাবার দরকার আছে। আমাদের আলু খাওয়ার পরিমাণ বাড়ানো যায়। এটি অবশ্যই কালচারের বিষয়। এক সময় মানুষ কিন্তু আটার রুটি পছন্দ করতো না, এখন সেটিই তার খাদ্যাভ্যাসের অংশ হয়ে গিয়েছে। আমাদের এখানে আলুর এত বেশি ফলন হয়, রপ্তানিও তেমন হয় না, নষ্টও হয় প্রচুর। খাদ্যনিরাপত্তায় আলু এখানে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

প্রশ্ন: আমাদের কৃষিজমি তো কমে যাচ্ছে। আমরা আমদানিনির্ভর দেশ হয়ে পড়েছি। এটি ভবিষ্যতে অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে। এর থেকে বের হওয়ার উপায় কী?

গোলাম রসুল: চলমান পরিস্থিতিই শিক্ষা দিচ্ছে যে এ ব্যাপারে এখন থেকেই নীতিগত কৌশল গ্রহণ শুরু করতে হবে। অপরিহার্য খাদ্যপণ্যগুলোর একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অংশ নিজেদেরই উৎপাদন করতে হবে। ভূমির পরিমাণ কম হলেও এখনো এখানে মাটির উর্বরতা ভালো, ভালো বৃষ্টিপাত হয়, পানির জোগানও ভালো; ফলে উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগ আছে। সেটি যাতে কোনোভাবেই কমে না যায়। একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, কৃষিতে কিন্তু খরচ বেড়ে যাচ্ছে। কৃষি উপকরণের দাম বেড়ে যাচ্ছে। কৃষিশ্রমিকও এখন আর আগের মতো সহজলভ্য নয়। নতুন নতুন কৃষিপ্রযুক্তি আসছে, সেগুলোর সঙ্গে কৃষককে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে, সেগুলো কেনার জন্য সহজ শর্তে ঋণ দিতে হবে। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ব্রাজিল বা ভারত কিন্তু এখনো পুরো কৃষিজমি সেচের আওতায় আনতে পারেনি। আমরা সেদিক দিয়ে অনেক এগিয়ে গেছি। আমাদের সেচের বাইরে তেমন জমি নেই বললেই চলে। তার মানে উৎপাদনের পুরো পরিবেশই এখানে দারুণভাবে বিরাজমান। এখন কৃষি খাতে সরকার যেসব ভর্তুকি বা প্রণোদনা দেয়, সেগুলো যাতে সরাসরি কৃষকের কাছে যায়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। আর কৃষক যাতে তার পণ্যের যৌক্তিক মূল্য বা মুনাফাটা পান। এখন একটি পণ্যের উৎপাদন ভালো, আবার সেটি আমদানিও করা হলো। তখন কিন্তু কৃষকের ক্ষতি হয়ে গেল। সেটি কোনোভাবেই করা যাবে না।

প্রশ্ন: খাদ্য চাহিদা যথার্থভাবে নির্ণয় করতে জনসংখ্যার হিসাব জরুরি। কিন্তু বর্তমান জনশুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদনের ফলাফলে সেটি প্রতিফলন হয় কি না?

গোলাম রসুল: জনশুমারি, ভোক্তার মূল্য সূচক বা এ ধরনের আরও পরিসংখ্যান এমনভাবে নির্ণয় করতে হবে, যাতে সেগুলো সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়। কিন্তু অনেক অর্থনীতিবিদ বা পরিসংখ্যানবিদ এসব তথ্য নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, এসব তথ্য বা পরিসংখ্যান হচ্ছে প্ল্যানিংয়ের টুলস। খাদ্যের চাহিদা, সে অনুসারে উৎপাদন ও আমদানির জন্য আমাকে জনসংখ্যার সঠিক তথ্য জানতে হবে। এখানে পরিবার বা বয়সভেদে চাহিদা নিরূপণও গুরুত্বপূর্ণ। ফলে সঠিক তথ্য না পেলে নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত বা কৌশল গ্রহণে জটিলতা তৈরি হবে। সরকারের হিসাব-নিকাশে ভুল হবে। এটি কিন্তু বড় বিপদ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

প্রশ্ন: অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থায় মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাবের বিষয়টি বারবার আলোচনায় আসে। বড় বড় কোম্পানি বা গোষ্ঠীও এখানে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে, আমদানি খাতও তারা নিয়ন্ত্রণ করছে। পণ্যের দাম নির্ধারণে তাদের স্বার্থ বড় হয়ে উঠছে। এতে ভোক্তাদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ ক্ষেত্রে সরকারের নীতি কেমন হওয়া উচিত?

গোলাম রসুল: মধ্যস্বত্বভোগী বলতে যারা কৃষকের কাছ থেকে পণ্য সংগ্রহ করে, সেগুলো কিছুদিন সংরক্ষণ করে, এরপর বিক্রি করে থাকে। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, তারা ওয়ান অব দ্য প্লেয়ার অব ফুড সিস্টেম। গোটা প্রক্রিয়ায় তারাও একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কৃষক বা সরাসরি আমদানিকারক তো ভোক্তাদের কাছে পণ্য বিক্রি করে না। কিছুদিন আগে আমরা দেখলাম ভোজ্যতেলের দাম বেড়ে গেল, কিছু লোককে গ্রেপ্তার করা হলো। এসব কর্মকাণ্ডে সরকার প্রশংসিত হয়। এতে কিন্তু সেই প্লেয়ারদেরও নিরুৎসাহিত করা হয়। 

মধ্যস্বত্বভোগীরা বাজার নিয়ন্ত্রণ করে বললে ভুল হবে। সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে সরকার কতটাই–বা চাল–গম কেনে, সেই প্রক্রিয়ার মধ্যেও নানা জটিলতা আছে। তো মধ্যস্বত্বভোগী বা ফড়িয়ারা কৃষকদের কাছ থেকে শস্য সংগ্রহ করে, তারা সরকারের কাছেও বিক্রি করে, আবার বাজারে সরবরাহ করে। তাদের কারণে তো কৃষক উপকৃতই হন। এখন সেখানে অনিয়ম ঠেকাতে সরকারের মনিটরিং বাড়াতে হবে। সেটি না করে কিছু মানুষকে গ্রেপ্তার বা হেনস্তা করায় বরং হিতে বিপরীত হয়। 

অর্থনীতিবিদ ড. আকবর আলি খানের কাছে এ নিয়ে একটি গল্প শুনেছিলাম। ষাটের দশকে পাকিস্তান সরকার দুধে পানি মেশানোর বিরুদ্ধে কড়াকড়ি করল, জরিমানা হয়ে গেল দ্বিগুণ। তিনি নড়াইল বা খুলনার এদিকে এসডিও ছিলেন। তিনি বাজারে পরিদর্শক পাঠালেন, যিনি অনেক মানুষকে ধরে ধরে জরিমানা করলেন। তিনি কাউকে ধরলেন, কাউকে ছেড়ে দিলেন। পরিদর্শকের উপরি ইনকামও বেড়ে গেল। দেখা গেল, দুধে পানি মেশানোর হার আরও বেড়ে গেল। কারণ, পরিদর্শকের পেছনে খরচ যুক্ত হয়েছে সেখানে। 

কথা হচ্ছে, মার্কেট নিয়ন্ত্রণ করতে হবে মার্কেট মেকানিজম বা ইকোনমিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট দিয়ে। সেখানে পুলিশ বা ম্যাজিস্ট্রেট পাঠিয়ে মার্কেট নিয়ন্ত্রণ কখনো সফল হয় না। আগেও এমন অনেক চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। বড় কোনো সংকট তৈরি হলে সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারে, অন্যথা নয়। ভোজ্যতেলের বাজার কিন্তু মাত্র আট-দশজন মানুষ নিয়ন্ত্রণ করে, এখন তাদের কাছে না গিয়ে যেসব মানুষের কাছ থেকে ২০০-৩০০ লিটার তেল পাওয়া গেল, তাদের ধরা হলো। যারা বাজার ম্যানিপুলেট করতে পারে, তাদের ধরতে হবে। বড় বড় গোষ্ঠীকে ভেঙে দিতে হবে, এর জন্য প্রতিযোগিতা বাড়াতে হবে। মুক্ত বাজারের সাফল্য নির্ভর করে এর ওপরে।

প্রশ্ন: পণ্য আমদানির বিষয়টি ভূরাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। ভারত চাইলেই রাশিয়া থেকে গম ও জ্বালানি কিনতে পারে, আমরা সেটি পারছি না। আমদানিতে এখন আমরা কোন কোন পণ্যকে প্রাধান্য দেব এবং সে ক্ষেত্রে আমাদের কূটনীতি কেমন হওয়া উচিত?

গোলাম রসুল: ভূরাজনীতির সঙ্গে বৈশ্বিক খাদ্যবাজার জড়িয়ে পড়াটা বিপজ্জনক। মুক্তবাজার অর্থনীতি যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল, সেটিও বাধাগ্রস্ত হবে। মহামারি এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তেমনটাই আমরা দেখতে পারছি। বিশ্বায়নের দর্শনের ওপরে আঘাত চলে এসেছে। এখানে এক দেশ আরেক দেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে। কূটনৈতিকভাবে খাদ্য আমদানি-রপ্তানিতে নানা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ বাধা আসছে। এখানে অনেক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানও জড়িয়ে পড়েছে, তারা রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের মতো ছোট দেশগুলোর জন্য নানা ঝুঁকি তৈরি হবে। ইতিমধ্যে হয়েছেও। ফলে খাদ্য আমদানিতে আমাদের পরিকল্পনামাফিক এগোতে হবে এবং সে অনুসারে রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। 

আমাদের আমদানিতে ১ নম্বরে আছে পোশাক খাতের কটন, ২ নম্বরে জ্বালানি, এরপর ভোজ্যতেল, যার চাহিদার প্রায় শতভাগই আমদানি করতে হয়। চতুর্থ নম্বরে আছে সার। তবে প্রাধান্য দিতে হলে আমি বলব খাদ্যশস্য, ভোজ্যতেল, সার, কটন এবং মেডিকেল পণ্য। সারের ক্ষেত্রে কোনোভাবে ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। এটির সঙ্গে খাদ্য উৎপাদন জড়িত। শ্রীলঙ্কার সংকটের পেছনে বড় প্রভাব ফেলে সার আমদানি বন্ধ করে দেওয়া। এখন এসব পণ্য রপ্তানিকারক দেশের সঙ্গে আমাদের কমবেশি সুসম্পর্ক আছে। তবে এ ক্ষেত্রে আমাদের আরও কৌশলী হতে হবে। আমাদের কূটনীতিক বা কর্মকর্তারা সেদিকে পিছিয়ে আছে। সেখানে আরও চৌকষ লোকের দরকার আছে। লাঠিও যাতে না ভাঙ্গে, সাপও যাতে না মরে তেমন ভূমিকার রাখতে হবে তাদের।

প্রশ্ন: আপনাকে ধন্যবাদ।

গোলাম রসুল: আপনাকেও ধন্যবাদ।


সৌজন্যে : দৈনিক প্রথম আলো। 

এবিএন/জনি/জসিম/জেডি

এই বিভাগের আরো সংবাদ