আজকের শিরোনাম :

‘কারিগরি দিক দিয়ে পদ্মা সেতু অন্য সেতুর চেয়ে আলাদা’

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৮ জুন ২০২২, ০৯:২৭

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক খান মাহমুদ আমানত।  তিনি পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্য। বিশ্বের অন্যতম চ্যালেঞ্জিং নদীশাসন–ব্যবস্থায় নির্মিত পদ্মা সেতুর কারিগরি বিভিন্ন দিক নিয়ে একটি জাতীয় দৈনিকের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শফিকুল ইসলাম। সাক্ষাৎকারটি এবিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল:

প্রশ্ন : আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে কোন কোন ক্ষেত্রে পদ্মা সেতুর বিশেষত্ব রয়েছে?

খান মাহমুদ আমানত: বিশ্বে পদ্মা সেতুর চেয়ে দীর্ঘ অনেক সেতু আছে। তবে কিছু কারিগরি দিক থেকে এটি অন্যগুলোর চেয়ে আলাদা। প্রথমত, এটি একই সঙ্গে সড়ক ও রেল সেতু। এতে বিশ্বের গভীরতম (১২২ মিটার) পাইল ফাউন্ডেশন ব্যবহার করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ভূমিকম্পের ঝুঁকি কমাতে এতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পেন্ডুলাম বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়েছে। তৃতীয়ত, বিশ্বের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং নদীশাসন–ব্যবস্থা এই প্রকল্পে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রায় ৩ হাজার ৬০০ টন উত্তোলন ক্ষমতার বৃহৎ ভাসমান ক্রেন ব্যবহার করে স্টিলের স্প্যান বসানো হয়েছে। শুধু এই প্রকল্পের জন্য বিশ্বের বৃহত্তম ও সবচেয়ে শক্তিশালী হ্যামার জার্মানি থেকে বানিয়ে আনা হয়েছে। এসব কারণে সারা বিশ্বের প্রকৌশলীদের মধ্যে এই সেতুর একটা বিশেষ অবস্থান আছে। আশা করছি, পদ্মা সেতুর পাইল ফাউন্ডেশন নকশা আন্তর্জাতিক পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত হবে।

প্রশ্ন : পদ্মা সেতু কেন স্টিলের কাঠামোয় বানানো?

খান মাহমুদ আমানত: সাধারণত সেতুর স্প্যান ১০০ মিটারের বেশি হলে কংক্রিটের স্থাপনা সাশ্রয়ী হয় না। তখন স্টিলের কাঠামো বেশি উপযোগী। স্টিলের কাঠামো কংক্রিটের তুলনায় হালকা হওয়ায় সেতুর ভিত্তির ওপর চাপ কম পড়ে, ভূমিকম্পের ধাক্কাও কম লাগে। পদ্মা সেতুর প্রতিটি স্প্যান ১৫০ মিটার লম্বা।

প্রশ্ন : স্টিল ও কংক্রিটের মিশেলে সেতু বানাতে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ ছিল?

খান মাহমুদ আমানত: চীনের নানজিং ইয়াংজি সেতু (১৯৬৮ সাল), জাপানের সেতো সেতু (১৯৮৮ সাল), ভারতের বগীবিল সেতুসহ (২০১৮ সাল) উন্নত দেশগুলোতে আগে থেকেই এমন স্থাপনা তৈরি হচ্ছে। তবে আগেই বলেছি, পদ্মা নদীর গতিপ্রকৃতি ও বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় এখানে যেকোনো সেতু নির্মাণ অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং ছিল।

প্রশ্ন : সেতুর মান, স্থায়িত্ব ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ কেমন হবে?

খান মাহমুদ আমানত: আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে পদ্মা সেতুর নকশা ও নির্মাণকাজ করা হয়েছে। যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করলে এই সেতুর স্থায়িত্ব ১০০ বছরের বেশি হবে। স্টিলের তৈরি কাঠামোর রক্ষণাবেক্ষণ খরচ কংক্রিটের তুলনায় বেশি। তবে পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে স্টিলের কাঠামোর উপযোগিতা বিবেচনায় নিলে এটি গ্রহণযোগ্য।

প্রশ্ন : সেতুতে রেল–সংযোগ যুক্ত হওয়ায় কী সুবিধা পাওয়া যাবে?

খান মাহমুদ আমানত: ঢাকা থেকে বঙ্গবন্ধু ও হার্ডিঞ্জ সেতু হয়ে রেলপথে খুলনা যেতে প্রায় ১২ ঘণ্টা লাগে। পদ্মা রেল সেতু হলে সময় লাগবে মাত্র চার ঘণ্টা। এতে মোংলা বন্দরের সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ সহজ ও সাশ্রয়ী হবে।

প্রশ্ন : উত্তাল পদ্মায় সেতু বানাতে কী ধরনের প্রতিকূলতা ছিল?

খান মাহমুদ আমানত: পদ্মা গত ৩০ বছরে একাধিকবার আড়াআড়ি প্রায় ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার গতিপথ পরিবর্তন করেছে। খরস্রোতা নদীটির স্বাভাবিক গভীরতা প্রায় ১৫ থেকে ২৫ মিটার, যা বর্ষায় সর্বোচ্চ ৬০ মিটার পর্যন্ত হয়। এসব প্রতিকূলতার কথা বিবেচনায় রাখতে হয়েছে।

প্রশ্ন : সেতুর নিচ দিয়ে জলযান চলাচলের ক্ষেত্রে কী ধরনের সতর্কতা মেনে চলা উচিত?

খান মাহমুদ আমানত: সেতুর নিচ দিয়ে চলাচলকারী নৌযানের উচ্চতা কোনোভাবেই পানির ওপর ১৬-১৭ মিটারের বেশি হওয়া ঠিক হবে না। খরস্রোতের সময় ফিটনেসবিহীন নৌযান নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সেতুর পিলারে ধাক্কা দিতে পারে। এ ধরনের ঘটনা এড়াতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও নৌযানের চালকদের বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে।

প্রশ্ন : নির্মাণ–পরবর্তী সময়ে কোন কোন দিকে নজর রাখতে হবে?

খান মাহমুদ আমানত: পদ্মা সেতুর পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের বিস্তারিত নির্দেশিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কোরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে করপোরেশন টোল আদায়, যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ, দুর্ঘটনা বা জরুরি পরিস্থিতিতে ব্যবস্থা নেওয়া, নদীশাসন, সেতুর নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধানের কাজ করবে। নির্ধারিত সীমার বেশি ওজনের যানবাহন সেতুতে ঢুকতে দেওয়া যাবে না। সেতুর কাছাকাছি এলাকায় নদী থেকে বালু উত্তোলন, নৌকা বা বার্জ ভেড়াতে যত্রতত্র খুঁটি গাড়া নদীশাসন ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এ জন্য সেতুর উভয় পাশের জনগণকে সচেতন করার কার্যক্রম চালাতে হবে।


সৌজন্যে : দৈনিক প্রথম আলো

এবিএন/জনি/জসিম/জেডি

এই বিভাগের আরো সংবাদ