আজকের শিরোনাম :

‘কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় রাজস্ব আদায়ে কর কমিশন দরকার’

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৮ মে ২০২২, ১২:০৪ | আপডেট : ২৮ মে ২০২২, ১৬:৫৮

সাবেক সিনিয়র অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ
বৈশ্বিক সংকট ও করোনার মহামারি বিশ্ব অর্থনীতিকে ধাক্কা দিয়েছে। ঝাঁকুনি পড়েছে দেশের অর্থনীতিতেও। বেকারত্বের পাশাপাশি বাড়ছে মূল্যস্ফীতির হার। চাপ বেড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর। ভোক্তার নাগালের বাইরে চলে গেছে অনেক খাদ্যপণ্যের দাম। ঠিক এমন পরিস্থিতিতে অর্থ মন্ত্রণালয় আগামী এক বছরের আয় ও ব্যয়ের রূপরেখা (জাতীয় বাজেট) প্রণয়ন করেছে।

তবে এ বছর জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ও মূল্যস্ফীতির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে উন্নয়নের ধারাকে সামনে নিয়ে যাওয়া হবে মূল চ্যালেঞ্জ। সাবেক সিনিয়র অর্থসচিব মাহবুব আহমেদের বক্তব্যে এমনটি উঠে এসেছে। কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় রাজস্ব আদায়ের জন্য সমস্যা শনাক্ত করে সুপারিশ দেওয়ার জন্য একটি কর কমিশন গঠনের প্রস্তাব করেছেন তিনি। ডলার সাশ্রয় করতে বিদেশে নেওয়ার সীমা অর্ধেকে নামিয়ে আনার কথা বলেছেন। আগামী বাজেটে করণীয় নিয়ে সম্প্রতি এক জাতীয় দৈনিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজান চৌধুরী। সাক্ষাৎকারটি এবিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল

প্রশ্ন : আগামী (২০২২-২৩) অর্থবছরের বাজেটের চ্যালেঞ্জ এবং তা মোকাবিলায় করণীয় কী হতে পারে?

মাহবুব আহমেদ : সারা বিশ্ব একটা অস্বাভাবিক সময় পার করছে। এই অস্থির সময়ের পটভূমিতে বাজেট ভাবনা নিয়ে আমরা কথা বলছি। তিন বছর আগেও (২০১৯-২০) অর্থবছরের বাজেট আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি এবং এর ফলে সৃষ্ট বৈষম্য হ্রাস। বিনিয়োগ বাড়িয়ে, না আইসিওআর (ইনক্রিমেন্টাল কেপিটাল আউটপুট রেসিও) কমিয়ে প্রবৃদ্ধি বাড়ানো হবে-এ নিয়ে তর্কবিতর্ক হতো। কিন্তু কোভিডকালীন দুটি বছরের বাজেট প্রস্তুতির মূল চ্যলেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় জীবন ও জীবিকার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা। আগামী বছর অর্থাৎ ২০২২-২৩-এর বাজেট ভাবনার মূল বিষয় হওয়া উচিত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ও মূল্যস্ফীতির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে উন্নয়নের ধারাকে সামনে নিয়ে যাওয়া হবে আসন্ন বাজেট প্রস্তুতির মূল চ্যালেঞ্জ।

প্রশ্ন : কোনটি অধিক গুরুত্ব দেওয়া উচিত-প্রবৃদ্ধি না মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ?

মাহবুব আহমেদ : স্বাভাবিক অবস্থায় প্রবৃদ্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনীতিকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার মূল নিয়ামক প্রবৃদ্ধি। এটা না হলে অর্থনীতিতে স্থবিরতা নেমে আসবে। শুরু হবে জনদুর্ভোগ। তবে এটাও মনে রখতে হবে উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে উচ্চ প্রবৃদ্ধির মূল সুবিধা পায় ধনীরা। গরিব জনগণ ‘চুইয়ে পড়া’র (trickle down effect) মাধ্যমে কিছুটা সুবিধা পায়। আসন্ন বাজেটে মূল্যস্ফীতি ও প্রবৃদ্ধির হারের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করার সময় মনে রাখতে হবে-প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশ হলো নাকি ৭ শতাংশ, তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মাথাব্যথা নেই। দ্রব্যমূল্য নিয়েই তারা বেশি মাত্রায় উদ্বিগ্ন। এছাড়া অধিক মাত্রার মূল্যস্ফীতি দারিদ্র্য ও বৈষম্য বাড়ায়। তাই ভারসাম্য রক্ষার সময় এ বছর মূল্যস্ফীতিকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।

প্রশ্ন : মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসছে বাজেটে কী ধরনের পদক্ষেপ থাকা প্রয়োজন?

মাহবুব আহমেদ : কোভিড-উত্তর পরিস্থিতি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় সব পণ্যের মূল্যই বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ঢেউ আমাদের বাজারেও লেগেছে। সরকার ভর্তুকি দিয়ে অনেক পণ্যের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রেখেছে। জ্বালানি ও সারে প্রদত্ত ভর্তুকির পরিমাণ অনেক। কিন্তু অর্থনীতির স্বার্থে জ্বালানি ও সারের ভর্তুকি এ বছর অব্যাহত রাখতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি স্বল্পমূল্যে নিু আয়ের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাযক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। সুদের হার মূল্যস্ফীতি হারের নিচে হলে তা সঞ্চয়কে নিরুৎসাহিত করে। উন্নয়নশীল দেশে সঞ্চয়ই বিনিয়োগে রূপান্তরিত হয়। সঞ্চয় না হলে বিনিয়োগযোগ্য মূলধন পাওয়া যাবে না। এতে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। সুদের হার নিয়ে ভাবতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত ইতোমধ্যে সুদের হার পুনর্নির্ধারণ করেছে। আমাদের অর্থনীতির আকার ৪০ লাখ কোটি টাকার অধিক। ডিগ্রি অব ওপেননেস ৩৮-৪০। তাই মুদ্রা বিনিময় হার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বিনিময় হার কীভাবে ব্যবহার করা যায়, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন। এ মুহূর্তে অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। ডলার খরচের বিষয়ে অধিক মিতব্যয়ী হওয়া প্রয়োজন। বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে বার্ষিক কোটা ১০ হাজার ডলার হতে কমিয়ে ৫ থেকে ৬ হাজার করা যেতে পারে। ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড পুনঃবিনিয়োগ সুবিধা তুলে নেওয়ার কারণে অনেকে নিজ নিজ ডলার বিদেশে নিয়ে যাচ্ছেন। ডলার আউট ফ্লো বন্ধ করার জন্য ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ডের পুনঃবিনিয়োগ সুবিধা চালু করা যেতে পারে। কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে আপাতত অর্থায়ন স্বগিত রাখার সিদ্ধান্ত যথাযথ। বরাদ্দ প্রদানের ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।

প্রশ্ন : ইউক্রেন যুদ্ধ ও শ্রীলংকা পরিস্থিতির পটভূমিতে আগামী বাজেটে কোন ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার?

মাহবুব আহমেদ : ইউক্রেন যুদ্ধ সারা বিশ্বকেই নানাভাবে প্রভাবিত করেছে। আমাদের অর্থনীতিও এর বাইরে নয়। ইউক্রেন ও রাশিয়া হতে আমরা গম, ভুট্টা ও ভোজ্যতেলের কাঁচামাল আমদানি করি। যুদ্ধ ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার কারণে তা বন্ধ রয়েছে। সিআইএসভুক্ত দেশগুলোয় আমাদের রপ্তানিও সমস্যায় পড়েছে। গম ও ভোজ্যতেলের জন্য বিকল্প বাজার খুঁজে বের করা হয়েছে। বিকল্প উৎস থেকে আমদানি ব্যয়বহুল হবে। বাজেটে এজন্য অধিক বরাদ্দ রাখতে হবে।

শ্রীলংকার বর্তমান অবস্থার সঙ্গে আমাদের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্নতর। তাদের অর্থনীতির আকার মাত্র ৮০ থেকে ৮৫ বিলিয়ন ডলার। আর আমাদের ৪০০ বিলিয়ন ডলারের অধিক। ঋণ জিডিপির হার ১১৯ শতাংশ, বৈদেশিক ঋণ জিডিপির হার ৬৪ শতাংশ। বাংলাদেশে উল্লিখিত উপাত্ত দুটি যথাক্রমে ৩৮ শতাংশ ও ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ। বাংলাদেশে বৈদেশিক ঋণের মূল উৎস বিশ্বব্যাংক (৩৬ শতাংশ) ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (২৩ শতাংশ)। শ্রীলংকার ঋণের সিংহভাগ নেওয়া হয়েছিল বেসরকারি উৎস থেকে সার্বভৌম গ্যারান্টির মাধ্যমে। তাদের রিজার্ভ এখন প্রায় শূন্য, বাংলাদেশের এখনো রিজার্ভ ৪২ বিলিয়ন ডলার। প্রতিদিনই রেমিট্যান্স ও রপ্তানি উৎস থেকে ডলার আসছে। তবে শ্রীলংকা বৈদেশিক মুদ্রার জন্য মূলত দুটি উৎস-ট্যুরিজম ও রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভরশীল ছিল। কোভিডজনিত কারণে ট্যুরিজম থেকে আয় প্রায় ৯০ শতাংশ কমে গেছে। বিদেশে অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। রেমিট্যান্সও কমেছে তাদের ভীষণভাবে। তবে ওই দেশের মতো আমরাও একটি পণ্যের ওপর নির্ভরশীল (তৈরি পোশাক)। রপ্তানি বহুমুখীকরণ অনেকদিন ধরেই আলোচিত হচ্ছে। অবিলম্বে তৈরি পোশাকবহির্ভূত খাতগুলোকে নানাভাবে সহায়তা দিতে হবে। এজন্য বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রাখতে হবে।

প্রশ্ন : বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো সতর্কতামূলক অবস্থানের প্রয়োজনীতা আছে কি?

মাহবুব আহমেদ : ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অদ্যাবধি প্রায় ক্ষেত্রে পরিপক্বতার পরিচয় দিয়েছে। সরকারি ঋণের ৬৩ শতাংশ অভ্যন্তরীণ এবং ৩৭ শতাংশ বৈদেশিক উৎস থেকে নেওয়া। বৈদেশিক ঋণের ৬১ শতাংশই নেওয়া হয়েছে বিশ্বব্যংক (৩৬ শতাংশ), এডিবি (২৩ শতাংশ), আইডিবি (১ শতাংশ), এআইআইবি (১ শতাংশ) থেকে। এগুলো বেশির ভাগই স্বল্প সুদের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ। ১৯ শতাংশ নেওয়া হয়েছে জাপান থেকে সহজ শর্তে। চীন, রাশিয়া ও ভারতীয় ঋণের হিস্যা যথাক্রমে ৭, ৭ ও ২ শতাংশ। দীর্ঘদিন ধরেই ক্রেডিট রেটিং সংস্থা মুডি এবং ফিচ বাংলাদেশের ঋণ পরিস্থিতিকে টেকসই বলে বিবেচনা করে আসছে। এরপরও বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কারণে আমাদেরও সতর্ক হওয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে। বৈদেশিক সহায়তার পাইপলাইনে যে ৫০ বিলিয়ন ডলারের কমিটমেন্ট আছে, তা ছাড় করানোর জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

প্রশ্ন : আগামী অর্থবছরে রাজস্ব বাড়াতে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন?

মাহবুব আহমেদ : রাজস্ব বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রতিবছর বাজেটের সময় আলোচনা হয়। রাজস্ব বাড়ে; কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বৃদ্ধি পায় না। সরকারি রাজস্ব আদায়ের মূল দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আয়কর ও শুল্ক মূসক বিভাগ দুটিতে নানাবিধ সমস্যা রয়েছে। এসব সমস্যা দূর করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে ঢেলে সাজাতে হবে। এ দুটি বিভাগেই অনেক সৎ, মেধাবী, সাহসী ও উদ্যমী কর্মকর্তা রয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তারা কাজ করতে পারছেন না। শুধু রাজস্ব আহরণ নয়, সম্পদ পুনর্বণ্টন, শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণেও আয়কর ও মূসক-শুল্ক বিভাগের ভূমিকা অপরসীম। এসব সমস্যা ও সম্ভাবনা চিহ্নিত করে সরকারি রাজস্ব কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে সুপারিশ প্রণয়নের জন্য একটি কর কমিশন গঠন করা যেতে পারে।


সৌজন্যে: দৈনিক যুগান্তর

এই বিভাগের আরো সংবাদ