আজকের শিরোনাম :

‘রাইস ব্র্যান তেলের উৎপাদন বাড়াতে হবে’

  জসিম উদ্দিন বাদল

২১ মে ২০২২, ১৩:৪০ | অনলাইন সংস্করণ

এ কে এম ফখরুল আলম
এ কে এম ফখরুল আলম; সাবেক আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক (বাংলাদেশ ও নেপাল), মালয়েশিয়ান পাম অয়েল কাউন্সিল। সম্প্রতি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন একটি জাতীয় দৈনিকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জসিম উদ্দিন বাদল।  সাক্ষাৎকারটি এবিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল-

প্রশ্ন : ভোজ্যতেলের আমদানি ও দেশে উৎপাদন পরিস্থিতি কেমন?

ফখরুল আলম : দেশে বছরে প্রায় ৩০ লাখ টন ভোজ্যতেলের দরকার হয়। এর মধ্যে পাম এবং সয়াবিন প্রায় ২৫ লাখ টন। এর মধ্যে ৫৫ শতাংশ পাম অয়েল এবং ৪৫ শতাংশ সয়াবিন তেল। এর বাইরে কানাডা এং অস্ট্রেলিয়া থেকে কিছু ক্যানোলা বীজ আসে। দেশের মোট চাহিদার ৯০ শতাংশ তেল আমদানি করা হয়। বাকি ১০ শতাংশ দেশে উৎপাদন করা হয়।

দেশে প্রধান তেলবীজ হচ্ছে সরিষা। পৌনে ৫ লাখ হেক্টর জমিতে সরিষা ও সয়াবিন, বাদাম ও তিল উৎপাদন হয়। এর পৌনে ৩ লাখ হেক্টর জমিতে সরিষা উৎপাদন হয়। তবে সরিষা থেকে তেল উৎপাদন হয় খুবই কম। সরিষা থেকে ৩৩ শতাংশের বেশি তেল পাওয়া যায় না। প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার টন সরিষা তেল উৎপাদন হয়। সরিষার বেশিরভাগই সয়ামিল বা হাঁস-মুরগি ও মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তবে উন্নতমানের বীজ এবং চাষাবাদে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারলে আরও বেশি তেল উৎপাদন সম্ভব। এভাবে সরিষার তেলের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব।

প্রশ্ন : এই সংকটের সময়ে রাইস ব্র্যান তেল কী ভূমিকা রাখতে পারে?

ফখরুল আলম : রাইস ব্র্যান বড় একটা সম্ভাবনাময় খাত। থাইল্যান্ডে বেশি ধান উৎপাদন হয়। সেখানে অসংখ্য রাইস ব্র্যান মিল রয়েছে। দেশটি প্রচুর পরিমাণে রাইস ব্র্যান তেল উৎপাদন করে। কিন্তু বাংলাদেশে এখনও পুরোপুরি এর বিকাশ ঘটেনি। এই তেলের উৎপাদন বাড়ালে ভোজ্যতেলের আমদানি কমে যাবে। দামে অস্থিরতাও থাকবে না। ধান থেকে চাল আলাদা হওয়ার পর যে খোসা বা তুষ বের হয়, সেই তুষের মধ্যে এক ধরনের লালচে আবরণ থাকে। স্থানীয় ভাষায় এটাকে ব্র্যান বলা হয়। এই ব্র্যান থেকে তেল উৎপাদন করা যায়। যেটাকে রাইস ব্র্যান বলা হয়।

প্রশ্ন : দেশে কী পরিমাণ রাইস ব্র্যান তেল উৎপাদন করা সম্ভব?

ফখরুল আলম : একটি বছরকে উদাহরণ হিসেবে ধরে অনুমান করা যায়। যেমন- সরকারের তথ্যমতে, ২০২০ সালে দেশে সাড়ে ৫ কোটি টন ধান উৎপাদন হয়েছে। ধান থেকে বিভিন্ন মানের তুষ হয়। এই ধান থেকে প্রায় ৮০ লাখ টন তুষ বের হয়েছে। তুষে সাধারণত তেল থাকে ২০ থেকে ২১ শতাংশ। তবে পুরো তেল আহরণ করা সম্ভব হয় না। ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ তেল আহরণ করা যায়। সেই হিসাবে এই তুষ থেকে প্রায় সাড়ে ১২ লাখ টন তেল উৎপাদন করা সম্ভব হতো, যা দিয়ে দেশের মোট চাহিদার অর্ধেকের কাছাকাছি জোগান দেওয়া যেত। এই হিসাবে আমার ধারণা, দেশে গড়ে ১২ থেকে ১৫ লাখ টন উৎপাদন করা সম্ভব।

প্রশ্ন : রাইস ব্র্যান তেল উৎপাদন বাড়াতে কোনো সমস্যা রয়েছে?

ফখরুল আলম : অটো মিলের পাশাপাশি রাইস ব্র্যান মিল স্থাপন করতে হবে, যাতে তেল আহরণের জন্য তুষ দ্রুত প্লান্টে নেওয়া যায়। তুষে যে তেল থাকে তা জ্যামিতিক হারে ভেঙে যায় বা নষ্ট হয়ে যায়। সে কারণে ধান থেকে তুষ আলাদা হওয়ার আট ঘণ্টার মধ্যে তেল আহরণ করতে হবে। তুষগুলো হয় বিভিন্ন হাসকিং মিলে। উৎপাদিত সব ধান যদি অটোম্যাটিক রাইস মিলে ভাঙানো হয়, তাহলে তুষের অপচয় কম হয়। এতে তুষের আহরণ সহজ হয়। কিন্তু দেশে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে ছোট ছোট হাসকিং মিল। ফলে সেগুলো থেকে তুষ সরবরাহ করা কিছুটা সমস্যা হয়। যদি পরিকল্পনা করে অটো মিলগুলো একসঙ্গে করা যায় তাহলে তুষ আহরণ করা সহজ হবে। প্রায় ৪০ লাখ টন তুষ সংগ্রহ করা যায় না। সেগুলো সাধারণত হাঁস, মুরগি ও পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহার হয়ে যায়। সরকারের যদি একটা প্রকল্প থাকত তাহলে এসব তুষ সংগ্রহ করে তেল উৎপাদন করা যেত।

প্রশ্ন : পাম ও সয়াবিন এবং রাইস ব্র্যান তেলের মধ্যে গুণগত পার্থক্য কী?

ফখরুল আলম : বর্তমানে পাম ও সয়াবিন তেলের দাম বাড়ার প্রেক্ষাপটে রাইস ব্র্যান তেলের গুরুত্ব বাড়ছে। এ ধরনের তেল সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় জাপান ও কোরিয়ায়। রাইস ব্র্যান তেলে এমন কিছু পুষ্টি রয়েছে, যা অন্য তেলে নেই। তেল হচ্ছে তিন ধরনের ফ্যাটি অ্যাসিডের সমন্বয়। যেমন- এই তেলে ২৫ ভাগ সম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড, একক অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড ৩৮ ভাগ এবং মাল্টি ফ্যাটি অ্যাসিড ৩৭ ভাগ থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর হচ্ছে একক সম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড, যা সয়াবিন বা পাম অয়েলের চেয়ে বেশি থাকে রাইস ব্র্যানে। সয়াবিন তেলের তরকারি বারবার গরম করলে এর গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়। রাইস ব্র্যান তেলের ক্ষেত্রে গুণাগুণ অক্ষুণ্ণ থাকে।

প্রশ্ন : রাইস ব্র্যান তেলের বাজার বিকশিত হচ্ছে না কেন?

ফখরুল আলম : বর্তমানে বাজারে যেসব রাইস ব্র্যান তেল পাওয়া যায় সেগুলোর বেশিরভাগই কিছুটা ঘোলাটে। ভোক্তাদের বেশি পছন্দ স্বচ্ছ ঝকঝকে তেল। সেজন্য আধুনিক প্লান্ট দরকার। উদ্যোক্তারা বেশিরভাগ রাইস ব্র্যান প্লান্ট আমদানি করে ভারত থেকে। এগুলো একেবারেই পুরোনো প্রযুক্তির এবং যথাযথভাবে তেল উৎপাদন করা যায় না। পাম ও সয়াবিন তেল পরিশোধনের প্রযুক্তির মতো এখানেও উন্নত প্রযুক্তি দরকার। এ ছাড়া রাইস ব্র্যান তেলের উৎপাদন বাড়িয়ে ভোক্তার জন্য সাশ্রয়ী করতে হবে। তাহলে এর ভোগ বাড়বে।

প্রশ্ন : সরকারের পক্ষ থেকে কী উদ্যোগ নেওয়া দরকার?

ফখরুল আলম : বাংলাদেশে রাইস ব্র্যান ও সরিষার তেল উৎপাদনের যথেষ্ট সুযোগ আছে। চাহিদাও আছে। তাই সরকার এ খাতে উদ্যোগ নিলে দেশের তেলের আমদানিনির্ভরতা কমানো যাবে। রাইস ব্র্যান তেলের তুষের জোগান বাড়াতে হবে। ধান অটোরাইস মিলে ভাঙানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এ ধরনের মিলের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য সরকার উদ্যোক্তাদের প্রণোদনাসহ বিভিন্ন সহায়তা করতে পারে। এতে স্থানীয়ভাবে এ শিল্পের বিকাশ ঘটবে। কর্মসংস্থান বাড়বে। এতে আমদানিনির্ভরতা কমে আসবে ভোজ্যতেলের। একই সঙ্গে লাখ লাখ ডলার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা সম্ভব হবে।


সৌজন্যে : দৈনিক সমকাল।

এবিএন/জনি/জসিম/জেডি

এই বিভাগের আরো সংবাদ