‘উন্নত অবকাঠামো থাকলে কাজের ভেতরেই গবেষণার সুযোগ নেওয়া যায়’

  পার্থ শঙ্কর সাহা

২১ মে ২০২২, ১৩:২৪ | আপডেট : ২১ মে ২০২২, ১৩:৪৪ | অনলাইন সংস্করণ

বিজ্ঞানী ডা. আলিয়া নাহিদ। ছবি: দীপু মালাকার।
ডা. আলিয়া নাহিদ; আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) বিজ্ঞানী।  বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমির ডা. সুলতান আহমেদ চৌধুরী স্বর্ণপদকের জন্য সম্প্রতি মনোনীত হয়েছেন তিনি।  বাংলাদেশের নারী বিজ্ঞানীদের অবস্থা, নিজের কাজ, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন পার্থ শঙ্কর সাহা। সাক্ষাৎকারটি এবিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল-


প্রশ্ন : কোন ক্ষেত্রটি নিয়ে আপনি কাজ করছেন?

ডা. আলিয়া নাহিদ : কর্মজীবনের প্রথম ১৫ বছর আমি সংক্রামক ব্যাধি যেমন কলেরা, নিউমোনিয়া ও টাইফয়েড নিয়ে কাজ করেছি। ১২ বছর ধরে কাজ করছি অসংক্রামক রোগ যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও হৃদ্‌রোগ নিয়ে। সচরাচর প্রাপ্তবয়স্ক ও বয়স্ক মানুষেরা এসব সমস্যায় বেশি আক্রান্ত হন। দীর্ঘমেয়াদি অসংক্রামক রোগের কারণে আমাদের দেশে অনেক মানুষের অকালমৃত্যুও হয়। তাই এসব রোগ আগেভাগে নির্ণয়, ঝুঁকি প্রতিরোধে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা কীভাবে আরও উন্নত করা যায়, তা নিয়েই আমার কাজ।

প্রশ্ন : গবেষণার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা কতটা প্রয়োজন?

ডা. আলিয়া নাহিদ : কোনো মানুষ বিজ্ঞানী হয়ে জন্মান না, ধীরে ধীরে তাকে তৈরি করতে হয়। এ জন্য প্রয়োজনীয় মেধা থাকা গুরুত্বপূর্ণ। সেই সঙ্গে দরকার পরিশ্রম ও কাজের প্রতি সততা। গবেষণার জন্য পরীক্ষাগার, দক্ষ জনবল, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও উন্নত ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। একজন বিজ্ঞানীর পক্ষে ব্যক্তিগতভাবে তার ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অপরিসীম। তরুণ বিজ্ঞানীরা জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠেন। কোনো প্রতিষ্ঠানে জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের জন্য সহায়ক পরিবেশ থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য দক্ষ বিজ্ঞানী তৈরি করা সহজ হয়। আমাদের প্রতিষ্ঠান (আইসিডিডিআরবি) বিজ্ঞান গবেষণার জন্য উন্নত পরিবেশ নিশ্চিত করেছে। আগের চেয়ে এখন নবীনদের কাজ করার ক্ষেত্র আরও সহজ ও বিস্তৃত হয়েছে।

প্রশ্ন : বিজ্ঞান গবেষণায় বাংলাদেশের নারীদের অংশগ্রহণ কম।

ডা. আলিয়া নাহিদ : নারীদের কিছু আলাদা সামাজিক দায়বদ্ধতা আছে। সেটা করপোরেট প্রতিষ্ঠানের প্রধান হোন আর পোশাকশিল্পের কর্মীই হোন। প্রতিষ্ঠান ও পরিবারে তাঁদের ভিন্ন ভূমিকা পালন করতে হয়। আমাদের দিনের শুরু যেমন হয় পরিবার থেকে, শেষ ভাগও কাটে পরিবারের সঙ্গে। তাই পরিবারে নারীকে দায়িত্ব পালন করতেই হয়।

এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ নারীর জন্য কতটুকু নমনীয় বা সহনশীল, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। যেমন সন্তান হওয়ার পর এক থেকে দেড় বছর নারীদের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ সময় সন্তান লালন–পালনের পাশাপাশি গবেষণার কাজ করা দুরূহ হয়ে পড়ে। যার কারণে অনেকে পিছিয়ে পড়েন। এ সময় তাঁদের জন্য নমনীয় কর্মঘণ্টা ও সন্তান কর্মক্ষেত্রে রাখার ব্যবস্থা থাকা দরকার। আমাদের প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের পরিবেশ আছে।

নারীদের জন্য বিজ্ঞান বা প্রযুক্তি নয়, তাদের জন্য ইতিহাস বা সাহিত্য বেশি উপযোগী—এমন ধারণা আমাদের সমাজে আজও রয়ে গেছে। এসব ধ্যানধারণা ভাঙছে, তবে তা অনেকাংশে নির্ভর করছে পারিবারিক পছন্দের ওপর। এর পরের বিষয় হলো, শুধু নারী নয়, সার্বিকভাবে বিজ্ঞান গবেষণার প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ খুব সীমিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স বা চিকিৎসকদের ক্ষেত্রে এমপিএইচ করার সুযোগ থাকে, যেখানে গবেষণা নিছক ডিগ্রি পাওয়ার জন্য করা হয়। সেই জ্ঞান কাজে লাগিয়ে প্রকৃত গবেষণার ক্ষেত্র খুব সীমিত। এ ক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগ দরকার। একজন চিকিৎসক, তিনি নারী হোন বা পুরুষ—গবেষণার কতটুকু সুযোগ পান আমাদের দেশে? তাঁকে রোগীর পরিষেবা দিতেই বেশি সময় পার করতে হয়। অথচ আমাদের হাসপাতালগুলো গবেষণার একেকটি খনির মতো। উন্নত বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডের জন্য উন্নত অবকাঠামো থাকলে চিকিৎসকেরা কাজের ভেতরেই গবেষণার সুযোগ নিতে পারেন।

বিজ্ঞানশিক্ষা যেসব জায়গায় আছে, সেখানে নিরন্তর প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বাড়ানোর সুযোগ দিতে হবে। দেশের প্রয়োজনের সঙ্গে সংগতি রেখে গবেষণাকে উদ্দীপ্ত করতে হবে। এ জন্য যথেষ্ট অর্থ দরকার, যার দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত করার জন্য সরকারের নীতিনির্ধারণী স্তরের সদিচ্ছা থাকা জরুরি। 

নারী বিজ্ঞানীদের জন্য বলতে চাই, নিজের কাজকে সম্মান করতে হবে। নিজেকে মূল্য দিতে হবে। তার কাজের গুরুত্ব সহজ করে সবাইকে বোঝাতে হবে। সেটা পরিবার ও কর্মক্ষেত্র—উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আরেকটি বিষয় হলো, দেশের ভেতরে ও বাইরে দক্ষ গবেষকদের সঙ্গে কোলাবোরেশনের মাধ্যমে কাজ করার মনোভাব থাকতে হবে।

প্রশ্ন : কাজের ক্ষেত্রে কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন?

ডা. আলিয়া নাহিদ : আমি ইন্টার্নশিপ শেষ করার সময়ই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম জনস্বাস্থ্য বিষয়ে কাজ করব। সেটা ১৯৯৪ সালের কথা। তখন জনস্বাস্থ্য খুব উপেক্ষিত একটি বিষয়। তখন আমার পরিবার থেকেই আপত্তি উঠল। আমি আমার অবস্থানে দৃঢ় ছিলাম।  নবীন কর্মী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে দেখলাম, যেসব উপাত্ত আমি সংগ্রহ করেছি, তার বিশ্লেষণে আমার ভূমিকা নেই। জানলাম, এমপিএইচ (মাস্টার অব পাবলিক হেলথ) না থাকলে এটি সম্ভব নয়। আমি জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটি থেকে এমপিএইচ করলাম। প্রধান গবেষক হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেলাম। কিন্তু গবেষণার জন্য নিজেকেই তহবিল সংগ্রহ করতে হতো। পিএইচডি থাকলে তাতে অনেক সুবিধা হয়। তখন পিএইচডিও করলাম। এভাবেই যখন যে দক্ষতার প্রয়োজন হয়েছে, অর্জন করার চেষ্টা করেছি। যার জন্য অসীম ধৈর্য ও আত্মবিশ্বাসের দরকার ছিল। যা একজন নারী কিংবা পুরুষের পক্ষে পরিবার ও প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নয়। তবে আমি বেশি শিখেছি আমার জ্যেষ্ঠ সহকর্মীদের কাছে।

প্রশ্ন : ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

ডা. আলিয়া নাহিদ : দেশে নবজাতক থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুদের স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ আছে। কিন্তু স্কুলগামী শিশু ও তরুণদের স্বাস্থ্য নিয়ে তা অনুপস্থিত। আবার আমাদের স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য কিছুটা সহজ হলেও প্রবীণদের ক্ষেত্রে খুবই অবহেলিত। আমি এই দুই ভিন্ন বয়সী গোষ্ঠীর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে গবেষণা করছি। তাঁদের জন্য সার্বিক স্বাস্থ্যসেবা সহজ ও সাশ্রয়ী করার জন্য মডেল তৈরি করছি। এ ছাড়া পুরো এশিয়া অঞ্চলে গবেষণার মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করার জন্য একটি অবকাঠামো তৈরির পরিকল্পনা করছি, যা বিভিন্ন দেশে নতুন মহামারিসহ গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য সমস্যায় অগ্রিম আভাস এবং তার দ্রুত সমাধানের নির্দেশনা দিতে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এ জন্য অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির সঙ্গে পাঁচ বছরের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি, যা বাস্তবায়নের কাজ খুব দ্রুত শুরু হবে। সেই সঙ্গে উপকূলীয় এলাকায় উচ্চ রক্তচাপসহ অসংক্রামক ব্যাধির কার্যকরী প্রাথমিক চিকিৎসাব্যবস্থা প্রণয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে পানির লবণাক্ততার প্রভাব নিরসনের জন্য দীর্ঘমেয়াদি আরও একটি গবেষণার কাজও এ বছর শুরু করতে যাচ্ছি।


সৌজন্যে : দৈনিক প্রথম আলো।

এবিএন/জনি/জসিম/জেডি

এই বিভাগের আরো সংবাদ