আজকের শিরোনাম :

বিশেষ সাক্ষাৎকার: মার্ক লিওনার্ড

‘রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার ফলাফল সুদূরপ্রসারী’

  প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

১৮ মে ২০২২, ১৬:৪৭ | অনলাইন সংস্করণ

মার্ক লিওনার্ড। ছবি : সংগৃহিত
মার্ক লিওনার্ড ব্রিটিশ রাজনৈতিক বিজ্ঞানী ও লেখক। ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের পরিচালক। প্রজেক্ট সিন্ডিকেট সম্প্রতি তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা ও আগামী দিনের বিশ্ব নিয়ে কথা বলেছেন তিনি।  সংক্ষেপিত অনুবাদ মনোজ দে।

প্রশ্ন : গত ডিসেম্বরে আপনি বলেছিলেন, ‘একুশ শতকের যুদ্ধ হবে বিশ্বব্যবস্থা কার হাতে থাকবে’ সেটি ফয়সালার জন্য। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন আপনার দূরদৃষ্টির প্রমাণ দিচ্ছে। রাশিয়ার ওপর যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলো, সেটি কি পশ্চিমাদের নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থার দ্রুত অবসান ঘটাবে?

মার্ক লিওনার্ড: আমার কাছে মনে হয়, রাশিয়া ইউক্রেনের ওপর যে আগ্রাসন চালাচ্ছে, তার প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিমারা দেশটির ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এর পরও নিষেধাজ্ঞার দীর্ঘমেয়াদি যে প্রভাব, সেটি নিয়ে আমাদের উদ্বিগ্ন হতেই হবে।

শীতল যুদ্ধের পরিসমাপ্তির পর পশ্চিমা পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠান ও ব্যবস্থা বাকি বিশ্বের কাছে ব্যাপক পরিসরে পৌঁছে যায়। বিশ্বায়নের বদৌলতে সেটি সম্ভব হয়। ঊনবিংশ শতকের শেষ ভাগ ছাড়া পুঁজিবাদের এতটা বিকাশ কখনোই দেখা যায়নি। তথ্য এবং যোগাযোগ প্রযুক্তির বিপ্লব এবং পারস্পরিক নির্ভরশীলতা এ সময়কালে নতুন উচ্চতায় পৌঁছায়। বর্তমান বিশ্ব পরস্পরের সঙ্গে অতি মাত্রায় যুক্ত। এ ব্যবস্থায় ‘জয়ী’ ফেসবুক, গুগল, আলিবাবা ও টেনসেন্টের মতো কোম্পানিগুলো বিপুল মুনাফা ঘরে তুলতে পারছে।

বিশ্বব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমারা নিয়ন্ত্রণ করে আসছে; কিন্তু বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় কিছু অপশ্চিমা কোম্পানিও সাফল্য লাভ করছে। প্রকৃতপক্ষে পশ্চিমারা নিজেদের কোম্পানি, প্রতিষ্ঠান এবং মূল্যবোধগুলোকে বিশ্বজনীন করে তুলতে পেরেছে। এগুলো এখন বৈশ্বিক জনসম্পত্তি। এ প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার ওপর যেসব নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে (আর্থিক লেনদেনের বার্তা আদান-প্রদানকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান সুইফট পেমেন্ট নেটওয়ার্ক থেকে রাশিয়ার কিছু ব্যাংকগুলোকে বিচ্ছিন্ন করা, আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট প্ল্যাটফর্ম থেকে রাশিয়ার সংবাদমাধ্যমগুলোকে বের করে দেওয়া, ডলারে লেনদেন থেকে রাশিয়াকে বাদ দেওয়া) সেগুলো পশ্চিমা এই বয়ানের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এখন পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো জনসম্পত্তি হিসেবে নয়; বরং পশ্চিমাশক্তির হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। এর ফলাফল সুদূরপ্রসারী।

প্রশ্ন : গত মাসে আপনি সতর্ক করেছিলেন, বিশ্ব একটি চলমান অসন্তোষ ও বিশৃঙ্খলার নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। যেটিকে আপনি ‘অশান্তির যুগ’ বলে অভিহিত করেছেন। আপনি আপনার সাম্প্রতিক বইতে বলেছেন, ইউরোপীয় নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই চার গুচ্ছ প্রশ্নের মীমাংসা করতে হবে। ন্যাটোর সীমানা নির্ধারণ এবং ইউরোপ আঞ্চলিক নাকি বৈশ্বিক—সে ধরনের প্রশ্নও সেখানে রয়েছে। আপনার এসব প্রশ্নের মধ্যে এখন কোনগুলোর উত্তর ইউরোপের দেওয়া উচিত বলে মনে করেন?

মার্ক লিওনার্ড: ২৪ ফেব্রুয়ারি ছিল ইউরোপীয়দের জন্য ভূ–রাজনৈতিকভাবে জেগে ওঠার গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা শুরু করার পর ইউরোপের মানুষেরা উপলব্ধি করতে পেরেছে, বৈশ্বিক শান্তি, পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও জাতিগত সীমানা মুছে দেওয়ার যে যুগে তারা এত দিন বাস করছিলেন, সেটির অবসান হয়েছে। একটি চিরস্থায়ী সংঘাতের যুগে তারা প্রবেশ করেছে। আর যে মৈত্রীর বন্ধন এত দিন তাদের পরস্পরের সঙ্গে বেঁধে রেখেছিল, সেটিকেই এখন খুব সহজেই অস্ত্রে পরিণত করা যাচ্ছে।

এই উপলব্ধি থেকে ইউক্রেনকে মারণাস্ত্র দিতে এবং মলদোভার মতো দেশগুলোর নিরাপত্তাব্যবস্থা নতুন করে সাজাতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন সম্মত হয়েছে। জার্মানি এবং ডেনমার্ক প্রতিরক্ষা খাতে জিডিপির ২ শতাংশ ব্যয় বাড়াতে সম্মত হয়েছে। ফিনল্যান্ড ও সুইডেন ন্যাটোর সদস্যপদের জন্য আবেদন করেছে।

এসব ঘটনা ইউরোপের সামনে যে তাৎক্ষণিক প্রশ্নটি হাজির করেছে, সেটি হলো—রাশিয়ার গ্যাস ও তেলের ওপর নির্ভরতা তারা কীভাবে কমিয়ে আনতে পারবে। দীর্ঘ মেয়াদে ইউরোপকে চীনের ওপর নির্ভরশীলতা এবং আমেরিকার প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীলতার বিষয়টিও খুব সতর্কতার সঙ্গে ভাবতে হবে।

প্রশ্ন : ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ চলাকালে আপনি মন্তব্য করেছেন, এ যুদ্ধ ইউরোপ ও ইউরেশিয়াকে পেছনের দিকে ঠেলে দেবে। ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। গত সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার নিরাপত্তা ও প্রযুক্তিগত আদান–প্রদানের বিষয়টিকে আপনি সমালোচনা করেছিলেন। আপনার বিশ্লেষণ ছিল, নতুন এই ‘অকাস’ জোট চীনকে ‘কৌশলগতভাবে বিজয়ী’ করবে। আপনি কি মনে করেন, ইউক্রেন যুদ্ধে চীন একইভাবে লাভবান হবে? ইউক্রেন যুদ্ধ ইন্দো-প্যাসিফিকে নতুন কোনো বিন্যাস ঘটাবে কি?

মার্ক লিওনার্ড: ইউক্রেন যুদ্ধে চীন তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে। চীন আশা করছে, পূর্ব ইউরোপের এই যুদ্ধ ইন্দো-প্যাসিফিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগ সরিয়ে নেবে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসী হামলার পর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যুদ্ধ পরিচালনা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ইন্দো-প্যাসিফিক থেকে নজর সরিয়ে রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্র। চীন আরও আশা করছে, ইউক্রেনকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ব্যর্থ হবে যুক্তরাষ্ট্র, তাতে মিত্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে। চীনের এই আশাগুলো যদি বাস্তবে রূপ পায় এবং পূর্ব ইউরোপ যদি যুক্তরাষ্ট্রের সব মনোযোগের কেন্দ্র হয়ে ওঠে, তাহলে এশিয়ায় আমেরিকার মিত্রদের মধ্যে সন্দেহ বাড়তে থাকবে। ইন্দো–প্যাসিফিকের মিত্রদের কাছে যে প্রতিশ্রুতি যুক্তরাষ্ট্র করেছে, তাতে চ্যালেঞ্জ জানাতে শুরু করবে চীন।

রাশিয়ার বিরুদ্ধে কী ধরনের অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, সেটি খুব মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে চীন। ধরা যাক, চীন ভবিষ্যতে তাইওয়ানে আগ্রাসন চালাল, তাতে একই ধরনের নিষেধাজ্ঞার কবলে তাদের পড়তে হবে। সেটি কীভাবে মোকাবিলা করা যাবে, তা নিয়ে আগাম প্রস্তুতি নিতে পারছে চীন।

প্রশ্ন : এই ‘অশান্তির যুগে’ যুক্তরাজ্য কি কৌশলগতভাবে নিজেদের অবস্থান পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারবে?

মার্ক লিওনার্ড: অশান্তির এ যুগে যুক্তরাজ্যের হাতে অনেক কার্যকর হাতিয়ার রয়েছে। যুক্তরাজ্যের হাতিয়ারগুলো ইউক্রেনের জন্য খুব সহায়ক হচ্ছে। যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দা ও সাইবার সামর্থ্যও মূল্যবান বলে প্রমাণিত হয়েছে। লন্ডন নগরের বৈশ্বিক মর্যাদার কারণে বৈশ্বিক আর্থিক নেটওয়ার্কের ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যের প্রতিপত্তিও বজায় রয়েছে।

যুক্তরাজ্য বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে। যুক্তরাজ্য নিজেদের স্বার্থে নীতি প্রণয়নকারী না হয়ে এখন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন অথবা চীনের নীতি গ্রহণকারী হয়ে উঠেছে। বন্ধনমুক্ত ভূ–রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে যুক্তরাজ্য কিছু কৌশলগত সুবিধা আদায় করে নিতে পারছে; কিন্তু এর বিনিময়ে বড় মূল্য চুকাতে হচ্ছে তাদের। সেটি হলো, নিজেদের কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ অধিকার ভাগ্যের হাতে সঁপে দিতে হচ্ছে যুক্তরাজ্যকে। 

প্রশ্ন : শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যতের কোনো আশা কি দেখতে পান? এর অর্জনই বা আমরা কীভাবে করতে পারি?

মার্ক লিওনার্ড: অনিয়ন্ত্রিত কানেকটিভিটির যে অনেক ধরনের বিপদ রয়েছে, সেটির বোঝাপড়া বিশ্বে তৈরি হচ্ছে। বিশ্বের অনেক অংশে ভূ–রাজনৈতিকের জাগরণ হচ্ছে। ফলে অতি-সংযোগশীলতা যে ঝুঁকি তৈরি করছিল, সেটি প্রশমনের একটি পথ সৃষ্টি হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে ‘বিল্ড ব্যাক বেটার ওয়ার্ল্ড’ (বৈশ্বিক অবকাঠামোগত পরিকল্পনা), চীনে ‘ডুয়াল সার্কুলেশন স্ট্র্যাটেজি (অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও বৈশ্বিক চাহিদা দুটিকে সমান গুরুত্ব দেওয়া) এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘কৌশলগত সার্বভৌমত্ব’—এসব ধারণার মধ্য দিয়ে বিষয়টি প্রতিফলিত হচ্ছে।

জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজের সাম্প্রতিক ভাষণে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, এই বিষয় ইউরোপীয় নেতাদের মধ্যে কতটা প্রভাব তৈরি করেছে। আজকের বাস্তবতায় আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান অর্জনটা ভঙ্গুরতার মুখোমুখি। আমাদের সেসব অর্জন রক্ষা করার জন্য, আমাদের অর্থনৈতিক মডেল, আমাদের নির্ভরতার ধরন এবং আমাদের নিরাপত্তার নীতিগুলো বদলাতে হচ্ছে।

সৌজন্যে : দৈনিক প্রথম আলো।

এবিএন/জনি/জসিম/জেডি

এই বিভাগের আরো সংবাদ