আজকের শিরোনাম :

‘পানি বণ্টনের ভূত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে’

  শেখ রোকন

১২ ডিসেম্বর ২০২১, ১২:৫৪ | অনলাইন সংস্করণ

প্রশ্ন : বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির আপনি ছিলেন নেপথ্য কারিগরদের একজন। এ চুক্তির মেয়াদ শেষ হতে যাচ্ছে ২০২৬ সালে।
আইনুন নিশাত : ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর বেলা ১১টা ৩২ মিনিটে বর্তমান চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ভারতের পক্ষে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এইচডি দেবগৌড়া এবং বাংলাদেশের পক্ষে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাতে স্বাক্ষর করেন। এ চুক্তির মেয়াদ ৩০ বছর নির্ধারণ করা হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই ২০২৬ সালে এর মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। শুধু এই চুক্তি নয়; গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে আগে আরও তিনটি দলিলে দুই দেশ স্বাক্ষর করেছিল। ১৯৭৭ সালে গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে পাঁচ বছর মেয়াদি সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ১৯৮২ সালে স্বাক্ষরিত হয়েছিল দেড় বছর মেয়াদি সমঝোতা স্মারক। ১৯৮৫ সালে ৩ বছর মেয়াদি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছিল। সেগুলোর মেয়াদও নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়েছিল। সেদিক থেকে ১৯৯৬ সালের চুক্তি বরং দীর্ঘতম মেয়াদের।

প্রশ্ন : এসব ক্ষেত্রে সাধারণত স্থায়ী চুক্তি হয়। তার বদলে ১৯৯৬ সালে মেয়াদি চুক্তি হয়েছিল কেন?
আইনুন নিশাত : প্রশ্নটি যৌক্তিক। কারণ, প্রাকৃতিক বিষয় নিয়ে দুটি দেশের মধ্যে মেয়াদি চুক্তি হতে পারে না। কিন্তু আপনি যদি গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তিটি ভালো করে পড়েন, তাহলে দেখবেন গঙ্গা নদীর পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে এই মেয়াদকালে আরও কিছু কাজ করার কথা বলা হয়েছিল। চুক্তি স্বাক্ষরের সময় ধরে নেওয়া হয়েছিল, ৩০ বছর সময়ের মধ্যে ওই কাজগুলো সম্পন্ন হবে এবং তারপর একটি মেয়াদহীন স্থায়ী চুক্তি হবে।

প্রশ্ন : যেমন-
আইনুন নিশাত : যেমন চুক্তিটির ৮ নম্বর অনুচ্ছেদে আপনি দেখবেন, সেখানে বলা হয়েছে, শুকনো মৌসুমে গঙ্গার প্রবাহ বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে এর জন্য দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের খোঁজে দুই পক্ষ পরস্পর সহযোগিতা করবে। যেমন ৯ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির ন্যায্যতা, স্বচ্ছতা ও কারও ক্ষতি না করার নীতির ভিত্তিতে দুই সরকার অন্যান্য অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন চুক্তি বা সমঝোতা সম্পন্ন করবে। দুর্ভাগ্যবশত, এর কোনোটিই গত আড়াই দশকে সম্পন্ন করা যায়নি। গঙ্গা নদীর প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং তার ভিত্তিতে অন্যান্য অভিন্ন নদীর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি অগ্রসর হয়নি।

প্রশ্ন : চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর গত আড়াই দশকে এই বিষয়গুলো কেন অগ্রসর হয়নি?
আইনুন নিশাত : আমি বলব, না হওয়ার পেছনের একটি মৌলিক ত্রুটি হলো পানি বণ্টনের ধারণা। আসলে নদীর সুফল ভাগাভাগি করার চুক্তি হওয়া উচিত ছিল। এই বিষয়টিতে কারিগরি নীতিনির্ধারকদের বোঝার ভুল ছিল। আর ভুলের ধারাটা শুরু হয় ১৯৭৭ সালের চুক্তির মধ্য দিয়ে। তখন ভারতের দিক থেকে বলা হয়েছিল, গঙ্গায় যে পানি আছে তা দুই দেশের প্রয়োজনের তুলনায় পর্যাপ্ত নয়। '৭৭ সালের চুক্তির আগে এ দাবিটি বাংলাদেশের পক্ষে ভালোভাবে তলিয়ে দেখা হয়নি।

প্রশ্ন : বিষয়টি আরেকটু ব্যাখ্যা করবেন-
আইনুন নিশাত : দেখুন, ১৯৭৭ সালের চুক্তির শিরোনামেই ছিল 'অন শেয়ারিং অব দ্য গ্যাঞ্জেস ওয়াটারস অ্যাট ফারাক্কা অ্যান্ড অন অগমেন্টিং ইটস ফ্লোজ'। তার মানে চুক্তিটা কেবল গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে নয়। গঙ্গায় কীভাবে প্রবাহ বৃদ্ধি করা যায়, সেটা নিয়েও। ১৯৭৭ সালের চুক্তিতে আরেকটি অনুচ্ছেদ ছিল যে, তিন বছর ধরে পানির প্রবাহ নিয়ে আলোচনা হবে। তারপর ১৯৮০ সালে পর্যালোচনা এবং পর্যালোচনায় ইতিবাচক অগ্রগতি দেখা দিলে ১৯৮২ সালে নবায়ন হবে। একটি নদীর পানি বণ্টন নিয়ে স্থায়ী চুক্তির জন্য এটা খুবই কম সময়। আলোচনায় বসতে বসতেই তো তিন বছর চলে যাওয়ার কথা। তারপর আলোচনা হতে হতেই দুই বছর পর চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। বাস্তবে সেটাই ঘটেছিল। আমি মনে করি, ১৯৭৭ সালের চুক্তি ছিল খুবই অদূরদর্শী।

প্রশ্ন : কিন্তু অনেক বিশেষজ্ঞ বলে থাকেন যে, ১৯৭৭ সালের চুক্তিটি সবচেয়ে ভালো ছিল। কারণ এতে 'গ্যারান্টি ক্লজ' ছিল।
আইনুন নিশাত : চুক্তির মেয়াদই যেখানে মাত্র পাঁচ বছর, যে চুক্তির শিরোনামেই বলা হচ্ছে যে বাস্তবায়ন করতে হলে প্রবাহ বৃদ্ধি করতে হবে, তাতে গ্যারান্টি ক্লজ দিয়ে কী আসে যায়? বাস্তবে যে কারণে ১৯৮০ সালে কোনো ধরনের সাফল্য ছাড়াই চুক্তিটির মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল এবং পরিস্থিতি সামাল দিতে পরবর্তীকালে ১৯৮২ ও ১৯৮৫ সালে আরও দুটি খুবই স্বল্পমেয়াদি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করতে হয়েছিল। সেই তুলনায় ১৯৯৬ সালের চুক্তি দীর্ঘমেয়াদি। ওই চুক্তিতে গ্যারান্টি ক্লজের কাছাকাছি একটি ক্লজ ফেরত আনা হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছে, ভারত পানির প্রবাহ নিশ্চিত করবে এবং কতটা নিশ্চিত করবে সেটা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।

প্রশ্ন : ১৯৭৭ ও ১৯৯৬ সালের চুক্তির মধ্যে তুলনা করতে বলি যদি, কোনটা বেশি কার্যকর?
আইনুন নিশাত : আপনাকে বুঝতে হবে ১৯৯৬ সালের চুক্তিটি ছিল 'ট্রিটি'। তার মানে আইনগত দলিলের দিক থেকে সর্বোচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন। দুই দেশ 'ট্রিটি' মানতে বাধ্য। আর ১৯৭৭ সালের চুক্তিটি ছিল 'এগ্রিমেন্ট'। তার মানে, মাঝারি গোছের; স্বাক্ষরকারী দুই দেশ এর বিধিবিধান মানতে বাধ্য নয়। ১৯৭৭ সালের চুক্তি আইনগত মানের দিক থেকে স্পষ্টতই ১৯৯৬ সালের চুক্তির তুলনায় দুর্বল ছিল।

প্রশ্ন : ১৯৯৬ সালের চুক্তিতেও তো গঙ্গার পানিপ্রবাহ বৃদ্ধির কথা রয়েছে।
আইনুন নিশাত : এটা আসলে '৭৭ সালের চুক্তিতে আমরা যে ভুল করেছিলাম, তারই ধারাবাহিকতা। কিন্তু আপনি দেখবেন, বিষয়টি আর চুক্তির শিরোনামে ছিল না। এছাড়া পানির বণ্টন ও প্রবাহ বৃদ্ধির বিষয় দুটি আলাদা করে ফেলা হয়। অর্থাৎ চুক্তির বাস্তবায়ন প্রবাহ বৃদ্ধিতে আটকে থাকল না।

প্রশ্ন : কিন্তু দুই চুক্তিরই আরেকটি দুর্বল দিক হচ্ছে, এগুলো দ্বিপক্ষীয়; বহুপক্ষীয় নয়। গঙ্গা অববাহিকার আরেকটি দেশ নেপালকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
আইনুন নিশাত : দেখুন, ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যেও বিষয়টি আলোচনা হয়েছিল। পরবর্তীকালে কারিগরি কমিটির মিটিংয়ে ভারতের দিক থেকে যেমন প্রবাহ বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছিল; বাংলাদেশের দিক থেকে বলা হয়েছিল, এতে নেপালকে চুক্তির পক্ষভুক্ত করতে হবে। ভারত বাংলাদেশের প্রস্তাবে রাজি হয়নি। বাংলাদেশও ভারতের প্রস্তাবে রাজি হয়নি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এসে ভারত বাংলাদেশের প্রস্তাবে নিমরাজি হচ্ছে। নেপালকে সঙ্গে নিয়ে অববাহিকাভিত্তিক বা বেসিনওয়াইড ব্যবস্থাপনার কথা বলছে।

প্রশ্ন : এখন তো বিশ্বজুড়েই পানি ভাগাভাগির বদলে সুফল ভাগাভাগির ধারণা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
আইনুন নিশাত : আমি সেই আশির দশক থেকে এই কথা বলে আসছি। কারণ, প্রবাহ বৃদ্ধির প্রস্তাব যেমন গলার ফাঁস, তেমনই পানি বণ্টনের বিষয় হলো ঘাড়ে চেপে বসা সিন্দাবাদের ভূত। কিন্তু কারিগরি নেতৃত্বে যারা ছিলেন, তাদের বোঝানো যায়নি। ফলে রাজনৈতিক নেতৃত্বও বিষয়টি নিয়ে আগ্রহী হননি। আশার কথা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনার কথা বলছেন। নদীর অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনার বিকল্প নেই। কারণ, একটি নদীতে সারা বছর সমান প্রবাহ থাকবে না। এটাকে যদি বর্ষায় ধরে রাখা যায়, তাহলে অনেক সুবিধা। জলবিদ্যুৎ পাওয়া যাবে, নৌ চলাচল ঠিক থাকবে, মৎস্যসম্পদ ও জীববৈচিত্র্য ভালো থাকবে, বন্যা নিয়ন্ত্রণ হবে, সুপেয় পানি ও সেচ পাওয়া যাবে। আমি প্রত্যাশা করি, গঙ্গা চুক্তির নবায়নের সময় পানি বণ্টনের বদলে অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।

প্রশ্ন : এ জন্য কী করতে হবে?
আইনুন নিশাত : প্রথমেই পানি বণ্টনের ভূত ঝেড়ে ফেলতে হবে। দুই দেশ একমত হয়ে বিদ্যমান চুক্তির বিধিবিধান পরিবর্তন করতে হবে। আর গঙ্গার ক্ষেত্রে নেপালকে পক্ষ হিসেবে নিতেই হবে। এজন্য বাংলাদেশকে কারিগরিভাবে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে রাজনৈতিকভাবে অগ্রসর হতে হবে। বিদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে একাধিক দেশের মধ্যে এ ধরনের নদী ব্যবস্থাপনা চুক্তি কীভাবে হয়, সেখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে তাদের সহযোগিতা নিতে হবে।

প্রশ্ন : ভারতীয় পক্ষ কি এ ব্যাপারে রাজি হবে?
আইনুন নিশাত : আমি যতদূর জানি, ভারতীয় পক্ষ কারিগরিভাবে প্রস্তুত। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত পেলেই তারা অগ্রসর হবে।

প্রশ্ন : ভারতের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত পাওয়ার জন্য আমাদের কী করণীয়?
আইনুন নিশাত : দেখুন, কূটনৈতিক সম্পর্ক মানেই লেনা-দেনার সম্পর্ক। নেবে আর দেবে মিলাবে মিলিবে। ভারতের আগ্রহ ছিল সবচেয়ে বেশি প্রটোকল রুটের দিকে। বাংলাদেশ সেই বিষয়ে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছে। দ্বিপক্ষীয় অন্যান্য বিষয়েও বাংলাদেশ যা করেছে, তা নজিরবিহীন। সে ব্যাপারে বিস্তারিত বলা যাবে অন্যত্র। এখন ভারতের উচিত পানি সংকটের সমাধানে এগিয়ে আসা। ভারত যাতে এগিয়ে আসে, সেজন্য বাংলাদেশকেও কূটনৈতিকভাবে পরিপকস্ফ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাহলে সহযোগিতা টেকসই হবে। আমি মনে করি, পানি বণ্টনের বদলে পানি ব্যবস্থাপনার মডেল নিয়ে এগিয়ে গেলে বিষয়টি ভারতের জন্যও সহজ হবে।

প্রশ্ন : পানি ব্যবস্থাপনার জন্য তো বিপুল বিনিয়োগ ও অর্থায়ন প্রয়োজন।
আইনুন নিশাত : অর্থায়ন কোনো সমস্যা নয়। এ জন্য বিশ্বব্যাংক, এডিবি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো পক্ষ প্রস্তুত। কয়েক দিন আগে অস্ট্রেলিয়ার পক্ষ থেকেও আগ্রহ দেখেছি। কিন্তু সেই অর্থায়ন চাইতে হবে বাংলাদেশ ও ভারতকে যৌথভাবে। একা চাইলে হবে না।

প্রশ্ন : সবার আগে জরুরি বোধ হয় স্থায়ী একটি চুক্তি। কারণ মেয়াদি চুক্তি মানেই নতুন করে নানা অনিশ্চয়তা।
আইনুন নিশাত : নতুন চুক্তিটি স্থায়ী চুক্তি হতেই হবে। বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে জরুরি। কারণ, প্রাকৃতিক কারণে পানির প্রাপ্যতা কমে যাচ্ছে। অববাহিকাগুলোতে জনসংখ্যা বাড়ছে, পানির ব্যবহার বাড়ছে।

প্রশ্ন : কিন্তু গঙ্গা চুক্তির নবায়ন নিয়ে এখনও কোনো আলোচনা দেখা যাচ্ছে না। এর মেয়াদ রয়েছে আর পাঁচ বছর। এর মধ্যে কি আলোচনা শেষ করা সম্ভব?
আইনুন নিশাত : অবশ্যই সম্ভব। প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও কারিগরি প্রস্তুতি। সেটা হলে এক বছরেও আলোচনা ও চুক্তি চূড়ান্ত করা সম্ভব। ১৯৯৬ সালের চুক্তি সম্পন্ন হয়েছিল মাত্র ১২ দিনের প্রস্তুতিতে।

প্রশ্ন : আমাদের সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
আইনুন নিশাত : আপনার জন্য শুভেচ্ছা।


সৌজন্যে: দৈনিক সমকাল। 

এবিএন/জনি/জসিম/জেডি

এই বিভাগের আরো সংবাদ