আজকের শিরোনাম :

‘মাতারবাড়ি হবে গোটা অঞ্চলের বন্দর’

  ভূঁইয়া নজরুল

২৯ জুন ২০২১, ১৯:৪৫ | আপডেট : ২৯ জুন ২০২১, ২০:০১ | অনলাইন সংস্করণ

নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী জনাব খালিদ মাহ্‌মুদ চৌধুরী।
যে দেশের সমুদ্রবন্দর নেই শুধু তারাই বুঝে বন্দর না থাকার দুঃখ।  ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূল রেখায় আমরা চট্টগ্রাম বন্দরের পাশাপাশি মোংলা এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছি। আগামীতে আসছে মাতারবাড়ি বন্দর। চট্টগ্রাম বন্দরের আওতায় নির্মিত হতে যাচ্ছে আরেক বন্দর বে টার্মিনাল। দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের পাশাপাশি বাড়ছে শিল্পায়ন। বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরসহ দেশে প্রায় শতাধিক ইকোনমিক জোন গড়ে উঠছে। এতে বাড়বে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম। এই কার্যক্রম নির্বিঘ্ন করতে নৌ মন্ত্রণালয়ের অধীনে নির্মিত হতে যাচ্ছে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর। বন্দর ও উন্নয়ন নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনা জানতে মাননীয় নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর সাথে কথা বলেছেন সাংবাদিক ভূঁইয়া নজরুল। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের সেই সাক্ষাৎকারটি এবিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম এর পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল:

প্রশ্ন:  প্রথম দিকে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প, পরবর্তীতে মাতারবাড়ি বাণিজ্যিক বন্দর, এখন মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প। প্রকৃতপক্ষে এই বন্দরের নাম কি?

খালিদ মাহমুদ চৌধুরী: মাতারবাড়ি আমাদের গভীর সমুদ্রবন্দর। এই সমুদ্রবন্দর বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা বিশ্বে গভীর সমুদ্রবন্দর রয়েছে এমন দেশগুলোর কাতারে প্রবেশ করব। এতে নৌ বাণিজ্য ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে যাবে। তবে একথা সত্য যে, কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আমরা এই গভীর সমুদ্রবন্দর পেয়ে গেলাম। সত্যিই আমরা জাতি হিসেবে খুব ভাগ্যবান।

প্রশ্ন:  এক সময় সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর হওয়ার কথা ছিল। মাতারবাড়ি কি সোনাদিয়ার চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে?

খালিদ মাহমুদ: আমরা দীর্ঘদিন ধরে একটি গভীর সমুদ্র বন্দরের পরিকল্পনা করছিলাম। এক্ষেত্রে সোনাদিয়া যেমন আলোচনায় এসেছে তেমনিভাবে পায়রাও এসেছে। সোনাদিয়া নিয়ে পরিবেশবাদীদের আপত্তিও ছিল। পরবর্তীতে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য চ্যানেল নির্মাণ করতে গিয়ে জাইকার স্টাডিতে যখন গভীর সমুদ্র বন্দরের সুবিধাগুলো পাওয়া যাচ্ছিল। তখন কিন্তু বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে মাতারবাড়িকেই বেছে নেয়া হয়েছে।

প্রশ্ন:  অনেকে বলছেন ভূ-রাজনৈতিক ইস্যুর কারণে সরকার সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ থেকে সরে এসেছেন। আপনি কী মনে করছেন ?

খালিদ মাহমুদ : দেশবিরোধী রাজনৈতিক গ্রুপ সবসময় বিতর্ক রাখতে চায়। তারা নেতিবাচক কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চায়। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে কোনো কাজ করেন না। পদ্মা সেতু এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তাই ভূ-রাজনৈতিক কোনো বিষয় নয়, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ এবং দেশের জন্য যেখানে বাস্তবসম্মত মনে করা হয়েছে সেখানেই হচ্ছে গভীর সমুদ্রবন্দর। আর মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্র বন্দরের বিষয়টি সবার আগে আমি প্রধানমন্ত্রীর মুখেই শুনেছি।

প্রশ্ন:  মাতারবাড়ি কি সিঙ্গাপুর ও কলম্বোর বিকল্প বন্দর হিসেবে গড়ে উঠবে?

খালিদ মাহমুদ: আমরা কারো বিকল্প হতে চাই না। আমরা আমাদের প্রয়োজনে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছি। এখানে বড় আকারের জাহাজগুলো ভিড়তে পারবে। আর সেখান থেকে অন্য জাহাজে করে পণ্য আমাদের চট্টগ্রাম বন্দরসহ অন্যান্য বন্দরে পরিবহন করা যাবে।

প্রশ্ন:  মাতারবাড়ি থেকে কি আমাদের পাশ্ববর্তী দেশসমূহ সুবিধা নিতে পারবে?

খালিদ মাহমুদ : আমরা কাউকে সুবিধা দিতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছি না। নিজেদের প্রয়োজনে তা গড়ে তুলছি। তবে হ্যাঁ, পাশ্ববর্তী কোনো দেশ যদি সহযোগিতা চায় তাহলে আমরা হয়তো তা দেব। মাতারবাড়ি হবে একটি আঞ্চলিক বন্দর।

প্রশ্ন: মাতারবাড়িতে বন্দর নির্মাণে দাতা সংস্থা ও সরকারের পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ অর্থায়ন করছে। এটি কি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের আওতায় থাকবে?

খালিদ মাহমুদ : মাতারবাড়ি কোনো পৃথক বন্দর নয়, এটি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের আওতাধীন একটি বন্দর। আর এতে যেন কোনো প্রশ্নের সৃষ্টি না হয় সেজন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের পোর্ট লিমিট উত্তরে ফেনী নদীর মোহনা এবং দক্ষিণে কক্সবাজারের কুতুবদিয়া, মাতারবাড়ি ও মহেশখালী পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। তাই এই লিমিটের মধ্যে যা নির্মিত হবে সবকিছু চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের আওতাধীন।

প্রশ্ন:  মাতারবাড়ি নিয়ে জাইকা স্টাডি করার পর দেশের সমুদ্রবন্দরগুলোকে এক ছাতার নিচে আনতে (একটি পোর্ট অথরিটির আওতায়) সুপারিশ করেছিল-

খালিদ মাহমুদ : আমরা এখনো এবিষয়টি নিয়ে চিন্তা করিনি। বর্তমানে যে অবস্থায় রয়েছে সেই অবস্থায় বন্দরগুলো পরিচালিত হবে।

প্রশ্ন:  মিরসরাইতে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে একটি বন্দর গড়ে তোলার কথা শুনা যাচ্ছে। এর সত্যতা কতটুকু?

খালিদ মাহমুদ : মিরসরাইয়ে বন্দর হওয়ার মতো কোনো পরিকল্পনা বা প্রস্তাবনা আমার দপ্তর পর্যন্ত এখনো আসেনি। তবে চট্টগ্রাম বন্দরের ২০ কিলোমিটারের মধ্যে আরেকটি বন্দর হওয়ার কথা নয়। যদি হয় তাহলে হয়তো জেটি হতে পারে।

প্রশ্ন: অনেকের মতে মাতারবাড়ির চেয়ে বে টার্মিনাল বেশি গুরুত্বপূর্র্ণ। কিন্তু বে টার্মিনাল বাস্তবায়নে সরকার ধীরে চলো নীতিতে এগুচ্ছে। এর কারণ কী?

খালিদ মাহমুদ : মাতারবাড়ি ও বে টার্মিনাল দুটি ভিন্ন প্রকল্প। মাতারবাড়িতে দাতা সংস্থার সাথে চুক্তি স্বাক্ষরের পর দ্রুতগতিতে তা এগিয়েছে এবং পরামর্শক প্রতিষ্ঠানও নিয়োগ হয়ে গেছে। বে টার্মিনালের ক্ষেত্রে এখনো কোনো চুক্তি স্বাক্ষর হয়নি। যেহেতু এটি পিপিপি (পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ) পদ্ধতিতে হবে তাই যারা বিনিয়োগ করবে তারা যেমন তাদের স্বার্থ দেখবে তেমনিভাবে আমরাও আমাদের দিক দেখবো। সব মিলিয়ে চুক্তি স্বাক্ষরের পর তা এগিয়ে যাবে। এছাড়া বে টার্মিনালের স্টাডিও হয়নি, স্টাডির জন্য পরামর্শক নিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।

প্রশ্ন: যেহেতু মহেশখালী ঘিরে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং গভীর সমুদ্রবন্দর ছাড়াও আরো প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে, তাই এই এলাকার উন্নয়নে সরকারের পরিকল্পনা কি?

খালিদ মাহমুদ : মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের সমগ্র এলাকার উন্নয়ন নিয়ে চিন্তা করেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন প্রথম ক্ষমতায় এসেছিল তখনই এই এলাকার উন্নয়ন নিয়ে পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। কিন্তু অন্যান্য সরকার সবাই নিজেদের লাভের কথা চিন্তা করেছেন, দেশের লাভের কথা চিন্তা করেনি। আর তাই এলাকার উন্নয়ন হয়নি। বিপরীতে আওয়ামী লীগ সরকার শুধু দেশের কথাই চিন্তা করে। এই এলাকা ঘিরে ব্যাপক উন্নয়ন পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। একইসাথে সড়ক ও রেল যোগাযোগও স্থাপিত হচ্ছে। এলাকার অর্থনৈতিক উন্নয়ন যেমন হবে তেমনিভাবে জীবনমানেরও উন্নয়ন ঘটবে।

প্রশ্ন:  চট্টগ্রাম বন্দর ও মাতারবাড়ি বন্দরের মধ্যবর্তী এলাকা নিয়ে কি কোনো পরিকল্পনা রয়েছে?

খালিদ মাহমুদ : কর্ণফুলী নদী ও সাঙ্গু নদীর মধ্যবর্তী এলাকাটি হতে পারে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এক আধুনিক শহর। এই এলাকায় কর্ণফুলীর তলদেশ দিয়ে একটি টানেল হচ্ছে এবং আগামীতে হয়তো আরো একাধিক টানেল গড়ে উঠবে। তাই এলাকাটিতে একটি নতুন শহর গড়ে উঠার অপার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া মহেশখালী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত পর্যটন শিল্পের বিকাশে উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া হচ্ছে।

প্রশ্ন:  ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত যেহেতু বন্দরকেন্দ্রিক যানবাহন বেশি চলাচল করবে, তাই পণ্যবাহী যানবাহনের জন্য এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে থাকবে কি-না?

খালিদ মাহমুদ : সড়ক ও জনপথের আওতায় ঢাকা-চট্টগ্রাম একটি এক্সপ্রেসওয়ে নির্মিত হচ্ছে। এছাড়া কক্সবাজার পর্যন্ত চার লেনের সড়ক এবং রেললাইনও বসছে। সবমিলিয়ে পণ্য চলাচলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এছাড়া মিরসরাই থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সাগরের উপকূল ঘেঁষে একটি মেরিন ড্রাইভ হচ্ছে। সবমিলিয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আসছে।

প্রশ্ন:  বন্দরকেন্দ্রিক যানবাহনের কারণে চট্টগ্রামের মানুষের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এটি নিরসনে বিশেষ কোনো পরিকল্পনা রয়েছে কি-না?

খালিদ মাহমুদ:  চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের গেটওয়ে। চট্টগ্রাম বন্দর সচল থাকলে দেশের অর্থনীতি সচল থাকবে। এখন এই গেটওয়ের সুবিধা পাচ্ছে সমগ্র বাংলাদেশ। আগামীতে এই গেটওয়ের পরিধি আরো বাড়াতে বে টার্মিনাল ও পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ কার্যক্রম চলছে।

এই বন্দরকেন্দ্রিক যানবাহনের কারণে চট্টগ্রামের মানুষের দুর্ভোগ হচ্ছে। তবে এই দুর্ভোগ থেকে পরিত্রাণ দিতে আমরা সড়ক ও জনপথের অধীনে থাকা পোর্ট এক্সেস রোডটি (টোল রোড) বন্দরের আওতায় দিয়ে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছি। একইসাথে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন পোর্ট কানেকটিং রোডটিও যদি পরিচালনার দায়িত্ব চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে দিয়ে দেয়া হয় তাহলে আমরা সঠিকভাবে তা রক্ষণাবেক্ষণ করবো। এতে চট্টগ্রামের মানুষের আর দুর্ভোগ হবে না। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রামের মানুষের পাশে আছে এবং আগামীতেও থাকবে।

মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

খালিদ মাহমুদ : আপনাকেও ধন্যবাদ।

 

 

সৌজন্যে: সুপ্রভাত বাংলাদেশ

এবিএন/জনি/জসিম/জেডি

এই বিভাগের আরো সংবাদ