আজকের শিরোনাম :

‘প্রযুক্তিতে এনসিসি দেশের সেরা ব্যাংকের কাতারে উন্নীত হবে’

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৭ মে ২০২১, ১০:৪৮ | আপডেট : ১৭ মে ২০২১, ১০:৫০

এনসিসি ব্যাংক লিমিটেডের এমডি ও সিইও মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ।
মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ। সম্প্রতি এনসিসি ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) পদে যোগদান করেছেন তিনি। দীর্ঘ ৩১ বছরের ক্যারিয়ারে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও ভারতের বিভিন্ন ব্যাংক ছাড়াও দেশের একাধিক ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। শীর্ষ নির্বাহী হিসেবে এনসিসি ব্যাংক নিয়ে তার স্বপ্ন, পরিকল্পনা ও দেশ-বিদেশের ব্যাংকিংয়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে সম্প্রতি তিনি কথা বলেছেন একটি জাতীয় দৈনিকের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হাছান আদনান। 

প্রশ্ন: কর্মজীবনের শুরুটা সমুদ্রগামী জাহাজের নাবিক হিসেবে। এরপর কিছুদিন যুক্ত ছিলেন শিক্ষকতায়। শেষ পর্যন্ত ক্যারিয়ার গড়লেন ব্যাংকিংয়ে। এত বৈচিত্র্য কেন?

মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ: সমুদ্রের বিস্তৃত জলরাশি আমাকে খুব টানত। পাশাপাশি দ্রুততম সময়ে কর্মজীবন শুরু করার তাড়নাও ছিল। এ দুই মিলিয়ে বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি থেকে পড়াশোনা শেষ করেই জাহাজে উঠলাম। সেটি ১৯৮৫ সালের কথা। কিন্তু বছর দেড়েক পরই সিদ্ধান্ত পাল্টালাম। উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে (আইবিএ)। ফাইন্যান্সে এমবিএ ডিগ্রি নেয়ার পর আইবিএতেই প্রভাষক হিসেবে যোগ দিই। কিছুদিন পর মনে হলো, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বিতার উপযোগী হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলা দরকার। এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের ব্র্যান্ডাইস বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। সেখানে আন্তর্জাতিক অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নেয়ার পর বহুজাতিক সিটিব্যাংক এনএতে যোগ দিই। এভাবেই ক্যারিয়ারের নানা বাঁক পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত ব্যাংকিং পেশায় স্থির হলাম। আমি নিজেকে যোগ্য করে তোলার চেষ্টা করেছি। সময় আমাকে উপযুক্ত স্থানের সন্ধান দিয়েছে।

প্রশ্ন: দেশের বাইরে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এছাড়া বহু দেশ  ঘুরেছেন। উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যাংকিং কার্যক্রমের তফাৎ কী দেখলেন?

মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ: শিল্পোন্নত দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের দেশের ব্যাংকিংয়ের মৌলিক পার্থক্য প্রযুক্তিগত। উন্নত ব্যাংকিং ব্যবস্থার দেশে গ্রাহকদের ছোটখাটো কাজের জন্য ব্যাংকে যেতে হয় না। ঘরে বসে কিংবা হাতে রাখা সেলফোনেই সব ব্যাংকিং সেবার সমাধান পাওয়া যায়। উন্নত দেশগুলোর সরকারও তার সব অবকাঠামো ডিজিটালে রূপান্তর করেছে। ফলে ওইসব দেশের নাগরিকদের পকেটে রাখার জন্য নগদ টাকার প্রয়োজন হচ্ছে না। কিন্তু আমাদের দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা কিছুটা ডিজিটালাইজ হলেও অর্থনীতির সব কাঠামো ক্যাশনির্ভর। তবে আশার কথা হলো, ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারণে পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টাচ্ছে। আমাদের দেশে একটি প্রজন্ম তৈরি হয়েছে, যারা পুরোপুরি সেলফোন-কম্পিউটারনির্ভর। এ তরুণরা চায়, তার হাতে থাকা মোবাইলেই সবকিছুর সমাধান থাকতে হবে। ব্যাংকে গিয়ে, লাইনে দাঁড়িয়ে সেবা গ্রহণের সময় ফুরিয়ে এসেছে। এজন্য ব্যাংকগুলোকে বাধ্য হয়ে প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ হতে হচ্ছে। যে ব্যাংক প্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকবে, সে ব্যাংক বাজারে অবস্থান হারাবে।

প্রশ্ন: দেশী-বিদেশী বিভিন্ন ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা নিয়ে এনসিসি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীর দায়িত্ব নিলেন। দায়িত্ব নেয়ার পর গত পাঁচ মাসের অভিজ্ঞতা কী? এনসিসি ব্যাংক কতটুকু প্রযুক্তিসমৃদ্ধ?

মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ: সম্পদের আকারের বিচারে এনসিসি দেশের বেসরকারি খাতের মধ্যম সারির একটি ব্যাংক। বাজারে আমাদের চেয়ে বড় ব্যাংক আছে। আবার সমসাময়িক সময়ে যাত্রা করা অনেক ছোট ব্যাংকও আছে। তবে করপোরেট সুশাসন ও ব্র্যান্ড ভ্যালুর দিক থেকে এনসিসির অবস্থান সামনের সারিতে। এ ব্যাংকের বিরুদ্ধে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কিংবা অন্য কোনো দিক থেকে গুরুতর কোনো অভিযোগ নেই। আমাদের কাছে আমানত রেখে গ্রাহকরা নিশ্চিন্ত থাকেন। ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদে শৃঙ্খলা ও কার্যকর সুশাসন আছে। এগুলো এনসিসি ব্যাংকের জন্য অনেক বড় অর্জন বলে মনে হয়েছে। অন্যদিকে প্রযুক্তিগত সমৃদ্ধির দিক থেকেও এনসিসির অবস্থান মধ্যম মানের। গত কয়েক বছরে এনসিসি ব্যাংক প্রযুক্তিগত সমৃদ্ধির মধ্যে ছিল। এ রূপান্তর সহসা থামবে না। এনসিসির কোর ব্যাংকিং সলিউশন আপগ্রেড করতে হবে। এরই মধ্যে প্রযুক্তিগত সমৃদ্ধির বিষয়ে আমরা একটি রূপরেখা তৈরি করেছি। আশা করছি, প্রযুক্তির দিক থেকে এনসিসি দেশের সেরা ব্যাংকের কাতারে উন্নীত হবে।

প্রশ্ন: ২৮ পেরিয়ে এনসিসি ব্যাংক আজ ২৯ বছরে পদার্পণ করল। ব্যাংকটির দীর্ঘ এ পথচলা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই।

মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ: ব্যাংক হিসেবে এনসিসির যাত্রা ১৯৯৩ সালের ১৭ মে। এ হিসেবে এ ব্যাংকের বয়স ২৮ বছর পূর্ণ হলো। আর আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনার সময়টি হিসাবে ধরলে এনসিসির বয়স ৩৫ বছর। দীর্ঘ এ পথযাত্রা মসৃণ না হলেও ছিল গৌরবের। গত কয়েক দশকে দেশের আর্থিক খাত উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে। বিভিন্ন সময়ে বড় বড় আর্থিক দুর্ঘটনার কথাও শোনা গেছে। কিন্তু এনসিসি ব্যাংক পথ চলেছে সুনামের সঙ্গে। এ ব্যাংক ঘিরে বড় কোনো আর্থিক অনিয়মের ঘটনা শোনা যায়নি।

এনসিসি ব্যাংক তিন দশক ধরে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির প্রতিটি ধাপে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ভারী শিল্প, গার্মেন্ট, বিদ্যুৎ, অবকাঠামো নির্মাণ থেকে শুরু করে অর্থনীতির প্রতিটি খাতে এ ব্যাংকের বিনিয়োগ আছে। গত ডিসেম্বর শেষে আমাদের কাছে গ্রাহকদের আমানত ছিল ১৯ হাজার ৭০২ কোটি টাকা। একই সময়ে আমরা ১৭ হাজার ৮১৫ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছি। করোনার প্রভাবে বিদায়ী বছরে দেশের আমদানি-রফতানিসহ অর্থনীতির প্রতিটি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার মধ্যেও ২০২০ সালে এ ব্যাংকের মাধ্যমে ৯৬১ কোটি টাকার পণ্য আমদানি, ৫৮৩ কোটি টাকার পণ্য রফতানি এবং ৪৪৬ কোটি টাকার রেমিট্যান্স এসেছে। মূলধন সক্ষমতা ও সম্পদের গুণগত মানের বিচারে এনসিসি ব্যাংকের অবস্থান সুদৃঢ়।

এনসিসি ব্যাংকের ঋণ পোর্টফোলিওতে বৈচিত্র্য আছে। বৃহৎ শিল্পের পাশাপাশি এসএমই, কৃষি ও রিটেইলে বিনিয়োগ আছে এ ব্যাংকের। তবে আগামীতে রিটেইলের সম্প্রসারণে আমরা আরো বেশি জোর দিতে চাই। রিটেইলের পাশাপাশি আমরা অন্য সব খাতে নতুন নতুন প্রডাক্ট নিয়ে আসার পরিকল্পনা নিয়েছি।

প্রশ্ন: এনসিসি ব্যাংকের সম্প্রসারণে কী পরিকল্পনা নিয়েছেন?

মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ: আগেই বলেছি, আধুনিক প্রযুক্তি ছাড়া আগামীর ব্যাংকিং ব্যবস্থা চলবে না। এজন্য প্রযুক্তিগত সমৃদ্ধির জন্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়েছি। ধাপে ধাপে এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে। ঋণপত্র খোলার জন্যও গ্রাহকদের ব্যাংকে আসতে হবে না, এমন প্রযুক্তি সংযুক্তির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অবয়বের তুলনায় এনসিসি ব্যাংকের গ্রাহক সংখ্যা কম। এজন্য আমরা গ্রাহকদের ব্যাপকতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছি। বিশ্বের ৩৩৫টি ব্যাংকের সঙ্গে এনসিসি ব্যাংকের করেসপন্ডিং সম্পর্ক আছে। বিদ্যমান বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য এ সংখ্যা যথেষ্ট। তবে আমরা আরো বেশি বিদেশী ব্যাংকের সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক তৈরি করতে চাই। এ সংখ্যা যত বাড়বে, ঋণপত্রের কমিশন তত কমে আসবে। গ্রাহকবান্ধব বিভিন্ন প্রডাক্ট নিয়ে আসার মাধ্যমে আমরা সর্বোত্কৃষ্ট ব্যাংকিং সেবা দিতে চাই। এনসিসিকে সেরাদের সেরা ব্যাংকে উন্নীত করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি।

প্রশ্ন: বিদেশী ব্যাংকের সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক আরো বাড়ানোর পরিকল্পনার কথা বলছেন। অথচ বিদেশের স্বনামধন্য অনেক ব্যাংক বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় কী?

মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ: আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রধানতম শর্তই হলো নির্দিষ্ট সময়ে ঋণপত্রের দায় সমন্বয় করা। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে যথাসময়ে ঋণপত্রের পেমেন্ট হয়নি। হাতে গোনা দু-চারটি ব্যাংকের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের কারণে অনেক বিদেশী বড় ব্যাংক আমাদের দেশের ব্যাংকগুলোর সঙ্গে করেসপন্ডিং সম্পর্ক স্থগিত করছে। এ কারণে পাকিস্তান ও শ্রীলংকার তুলনায় আমাদের কনফার্মেশন চার্জ বেশি। অথচ এ দুটি দেশেরই ক্রেডিট রেটিং বাংলাদেশের তুলনায় খারাপ।

বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের সুনাম ও মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য সব ব্যাংককে এগিয়ে আসা দরকার। নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক দফায় দফায় চিঠি দিয়ে অপরিশোধিত এলসির দায় সমন্বয়ের তাগিদ দেয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনাগুলো সবাই মেনে চললে দেশের এলসি কমিশন কমে আসবে। একই সঙ্গে দেশের ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের মধ্যে কার্যকর সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা দরকার। নেতিবাচক সংবাদ কমলে দেশের ব্যাংক খাতের ভাবমূর্তি বাড়বে। বিশ্বের স্বনামধন্য ব্যাংকগুলোও বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর সঙ্গে করেসপন্ডিং সম্পর্ক স্থাপন করতে আগ্রহী হবে।

সৌজন্যে: দৈনিক বণিক বার্তা

এবিএন/জনি/জসিম/জেডি

এই বিভাগের আরো সংবাদ