আজকের শিরোনাম :

‘সংক্রমণ দূর করায় প্রভাব না রাখলেও মৃত্যুর হার কমাবে টিকা’

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৫ এপ্রিল ২০২১, ১২:৪৪

ডা. মুশতাক হোসেন
ডা. মুশতাক হোসেন। ইনস্টিটিউট অব এপিডেমিওলজি, ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চের (আইইডিসিআর) অন্যতম পরামর্শক। এর আগে এই প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসা সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ছিলেন। সম্প্রতি নতুন করে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি, এর সম্ভাব্য কারণ, এখনকার করণীয় ও স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া। এবিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি নিচে তুলে ধরা হল:

প্রশ্ন: সংক্রমণ হঠাৎ এই মাত্রায় বাড়ল কেন?

মুশতাক হোসেন: আমরা দেখছি যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দ্রুত বাড়ছে। তবে এটা শুধু আমাদের দেশ নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী বিশ্বের ছয়টি অঞ্চলে সংক্রমণ আগের তুলনায় ১৫ ভাগ বেড়েছে। বিশ্বজুড়ে টিকা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার একটি কারণ, হয়তো টিকা নেওয়ার পর অনেকেই নিজেকে নিরাপদ ভাবতে শুরু করেছেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা বাদ দিয়েছেন। বাংলাদেশে সংক্রমণ ৫ ভাগের নিচে নেমে এসেছিল। মৃত্যুও কমে এসেছিল। বাংলাদেশে টিকা কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর আমরা দেখছি, পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে আমাদের অংশগ্রহণ বেড়ে গেছে। একই সঙ্গে গরম চলে এসেছে। ঘরে বা বদ্ধ রুমে যখন আমরা মিলিত হচ্ছি, তখন ফ্যান বা এসি ছাড়তে হচ্ছে। ঘরের বাতাস যেহেতু ঘরের মধ্যেই চলাচল করছে, তাই সংক্রমণের মাত্রাও বেড়ে যাচ্ছে। টিকা নেওয়ার কারণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে শিথিলতা, সামাজিক ও পারিবারিক জমায়েত বেড়ে যাওয়া এবং গরমে বদ্ধ রুমে ফ্যান এসি চালানোর কারণে সংক্রমণ বেড়েছে বলে মনে হয়।

প্রশ্ন: সংক্রমণ বাড়ার পেছনে করোনাভাইরাসের নতুন ধরনের কথা বলা হয়। বিশেষ করে যুক্তরাজ্য ধরনের সংক্রমণক্ষমতা বেশি এমন কথা শোনা গেছে। এর কোনো ভূমিকা নেই?

মুশতাক হোসেন: এখনো আমাদের কাছে এমন কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই যাতে করে বলা যায়, করোনাভাইরাসের নতুন কোনো ধরনের কারণে সংক্রমণ বেড়েছে। আমাদের দেশে জানুয়ারি মাসে যুক্তরাজ্যের ধরনটি পাওয়া গেছে। এরপর এমন কোনো অস্বাভাবিক কিছু চিহ্নিত হয়নি, যাতে বলা যাবে এই ধরন সংক্রমণ বৃদ্ধির জন্য দায়ী। তা ছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিল ধরনও পাওয়া গেছে। যথাযথ গবেষণা ছাড়া রোগতাত্ত্বিকভাবে এটা বলা কঠিন যে বিশেষ কোনো ধরনের কারণে সংক্রমণ বেড়েছে।

প্রশ্ন: এই সময়ে সংক্রমণ বাড়তে পারে, এমন কোনো আভাস কি বিশেষজ্ঞদের তরফে ছিল?

মুশতাক হোসেন: সময় নির্ধারণ করে এটা হয়তো বলা হয়নি, কিন্তু সংক্রমণের হার যে বাড়তে পারে, সেই ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের তরফে সতর্কতা ছিল। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে যে ধরনের উদ্যোগ প্রয়োজন, সেখানে শিথিলতা দেখা দিলে সংক্রমণ বাড়বে, তা সবারই জানা ছিল। আমরা দেখেছি যে থাইল্যান্ড, জাপান, চীন, ভিয়েতনাম, অস্ট্রেলিয়া বা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলো সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট সাফল্য দেখিয়েছে। এরপরও বাইরে থেকে আসা ভাইরাসের কারণে বিভিন্ন সময়ে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা সব সময় বলে আসছি যে অসতর্ক থাকলে সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে।

প্রশ্ন: যুক্তরাজ্য ধরনের কথা জানার পর বিশ্বের অনেক দেশ বিমান চলাচলসহ যোগাযোগ বন্ধ করেছে। বাংলাদেশের তরফে তেমন কিছু করা হয়নি। যুক্তরাজ্যফেরতদের কোয়ারেন্টিনে রাখার কথা বলা হলেও বাস্তবে তা ঠিকভাবে মানা হচ্ছে না। এই বিষয়গুলো কীভাবে দেখছেন?

মুশতাক হোসেন: দেখুন, মহামারি শুরুর দিকে অনেক বিষয়ে আমাদের অজানা ছিল। ফলে শুরুতে অনেক কিছুই আমরা বন্ধ করে দিয়েছি। সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া বিজ্ঞানসম্মত নয়। বিষয়টিকে আমাদের জনস্বাস্থ্য ও সামাজিক বিবেচনা দিয়ে দেখতে হবে। আমরা দেখেছি যে এর মধ্যেই করোনাভাইরাসের যুক্তরাজ্য ধরন বিশ্বের প্রায় ১৫০টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন আপনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করলেও কোনো লাভ হবে না। অন্য দেশ থেকে একই ভাইরাস দেশে ঢুকবে। সেটা বন্ধ করতে হলে সব দেশ থেকে লোকজনের আসা ও সব ধরনের প্রবেশের পথ বন্ধ করতে হবে। সব দেশ থেকে লোক আসছে আর আপনি শুধু যুক্তরাজ্য থেকে আসা লোকজনকে কোয়ারেন্টিনে নিলেন, তাহলে তো সেটা বৈষম্যমূলক হলো। সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে সর্বশেষ পথ।

প্রশ্ন: জনগণ যাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বাধ্য হয়, সে জন্য কী করা যেতে পারে?

মুশতাক হোসেন: পুরো বিষয়টি হতে হবে সহায়তামূলক। একসময় সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। সেটা এখন করা কঠিন। কাজ বন্ধ করলে অনেকের চলার সংগতি থাকবে না। ফলে সচেতনতা সৃষ্টির বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকাও হতে হবে সচেতনতামূলক। দৃষ্টান্তমূলক হিসেবে কিছু ক্ষেত্রে শাস্তি দেওয়া যেতে পারে। রাস্তাঘাটে দরিদ্র মানুষজনকে মাস্ক ছাড়া পাওয়া গেলে প্রয়োজনে তাদের মাস্ক সরবরাহের উদ্যোগ নিতে হবে। কম দামি ও ধুয়ে ব্যবহার করা যায় এমন কাপড়ের মাস্ক সরবরাহ করা যায়। রাস্তা দিয়ে যখন কেউ চলাচল করে, সে হয়তো দূরত্ব বাজায় রাখে বা তখন হয়তো সংক্রমণ ছড়ানোর বিপদ কম, কিন্তু সেই ব্যক্তির নিশ্চয়ই কোনো গন্তব্য আছে, সেখানে কিন্তু মাস্ক লাগবে। তাই সবার মাস্ক পরা নিশ্চিত করাটা জরুরি। আবারও বলছি, উদ্বুদ্ধ করা ও সচেতনতা সৃষ্টির জায়গা থেকে কাজটি করতে হবে।

প্রশ্ন: বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় কী গাইডলাইন মেনে চলা দরকার? কোন কোন বিষয়ে সবার সতর্ক থাকা উচিত?

মুশতাক হোসেন: প্রথমত, কোভিড সংক্রমিতদের স্বাস্থ্য বিভাগের তরফ থেকে খোঁজখবর নেওয়া হয়। তাদের তরফে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়। সবাইকে তা মেনে চলতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তির আইসোলেশন নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তিনি অন্য কাউকে সংক্রমিত করতে না পারেন। দ্বিতীয়ত, লক্ষণ আছে এমন অনেকে পরীক্ষা করাচ্ছেন না এবং স্বাভাবিকভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ফলে অজানা উৎস থেকে লোকজন সংক্রমিত হচ্ছে। তাই কোনো লক্ষণ থাকলে পরীক্ষা করাতে হবে, সংক্রমিত হলে আইসোলেশনে যেতে হবে। তৃতীয়ত, বন্ধ ঘরে একসঙ্গে জমায়েত হওয়া যাবে না। চিকিৎসাসেবাসহ যেকোনো ধরনের সেবা গ্রহণের প্রয়োজনে বা অন্য কোনো কারণে যদি একান্তই তা করতে হয়, তবে অবশ্যই দরজা–জানালা খোলা রাখতে হবে। সবার মাস্ক পরা থাকতে হবে। সাধারণভাবে যা ধারণক্ষমতা, তার ৩ ভাগের ১ ভাগ লোক রাখতে হবে এবং ব্যবস্থাপনা এমনভাবে করতে হবে, যাতে কাউকে সেসব স্থানে ১৫ মিনিটের বেশি থাকতে না হয়। এসব স্থানের দরজার হাতল বা সাধারণভাবে স্পর্শ লাগে এমন স্থানগুলো নিয়মিত স্যানিটাইজ করতে হবে। চতুর্থত, গণপরিবহনে সব আসন ভরে যাত্রী নেওয়া যাবে না। প্রয়োজনে পরিবহনমালিকদের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে। সব যাত্রীকে মাস্ক পরতে হবে।

প্রশ্ন: দেশে টিকা কার্যক্রম চলছে, সংক্রমণ রোধে এর ভূমিকা কতটুকু?

মুশতাক হোসেন: টিকা গ্রহণ এখনই হয়তো সংক্রমণ দূর করায় প্রভাব রাখবে না। কিন্তু টিকা মৃত্যুর হার কমাবে। ফলে সবাইকে টিকা নিতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। দেশের ৭০-৮০ ভাগ লোক টিকার আওতায় এলে সংক্রমণ বিস্তার রোধে ভূমিকা রাখতে পারবে। এই পর্যন্ত দেশের ৩ শতাংশের কম মানুষ টিকার আওতায় এসেছে। একই সঙ্গে আমাদের সংক্রমণ কমাতে হবে এবং টিকার আওতা বাড়াতে হবে। সংক্রমণ বাড়তে থাকা মানে মৃত্যু বাড়তে থাকা। আগে যে স্বাস্থ্যবিধির কথা বললাম, তার সঙ্গে টিকার আওতা বৃদ্ধি-এগুলো সমন্বিতভাবে ও পাশাপাশি চলতে হবে।

প্রশ্ন: একটা বিপদের কথা হচ্ছে, সংক্রমণ বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে ভাইরাস শক্তিশালী হতে পারে। বাংলাদেশ ধরন হিসেবে নতুন ভাইরাস তৈরি হতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে বর্তমান টিকা না–ও কাজ করতে পারে। এই ঝুঁকিকে কীভাবে দেখছেন?

মুশতাক হোসেন: এটা অবশ্যই চিন্তার বিষয়। এখন পর্যন্ত ভাইরাসের যেসব ধরন পাওয়া গেছে, তার ওপর বর্তমানে ব্যবহৃত টিকার কার্যকারিতা রয়েছে। তবে সংক্রমণ অব্যাহত থাকলে ভাইরাস মিউটেটেড হয়ে শক্তিশালী হতে পারে। তৈরি হতে পারে নতুন ধরন। তখন টিকার কার্যকারিতা না–ও থাকতে পারে। টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এসব বিবেচনায় রেখে নতুন প্রজন্মের টিকা নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। এমন একটি পরিস্থিতিতে আমাদের দেশে জিনোম সিকোয়েন্সিং বাড়াতে হবে। সেটা করা না গেলে আমরা বুঝতেই পারব না যে আমাদের দেশে নতুন ধরন তৈরি হচ্ছে কি না বা সেটার শক্তি-সামর্থ্য কেমন।

প্রশ্ন: আপনাকে ধন্যবাদ।

মুশতাক হোসেন: ধন্যবাদ।

সৌজন্যে :  দৈনিক প্রথম আলো।

এবিএন/জনি/জসিম/জেডি

এই বিভাগের আরো সংবাদ