আজকের শিরোনাম :

‘এখন পর্যন্ত কোভিশিল্ডের খারাপ কোনো দিক পাওয়া যায়নি’

  আতাউর রহমান কাবুল

১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১২:০৭ | অনলাইন সংস্করণ

অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত
অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম; ভাইরোলজিস্ট ও সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়। সম্প্রতি করোনাভাইরাস ও ভ্যাকসিন সহ বিভিন্ন বিষয় কথা বলেছেন একটি জাতীয় দৈনিকের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আতাউর রহমান কাবুল। সাক্ষাৎকারটি এবিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম পাঠকদের জন্য নিচে হুবহু তুলে ধরা হল:

টিকা আসলে কিভাবে কাজ করে?

টিকার কাজ হলো দেহের জীবাণু তথা ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস সংক্রমণের ক্ষমতাকে নিষ্ক্রিয় করে দেহে শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি করা। সক্রিয় জীবাণু মানুষকে অসুস্থ করতে পারে; জীবাণু নিষ্ক্রিয় থাকলে মানুষ সাধারণত অসুস্থ হয় না।

দেহের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো অ্যান্টিবডি ও সেলুলার ইমিউন রেসপন্স। তবে এগুলো সব মানুষের সমান থাকে না। টিকার মাধ্যমে অ্যান্টিবডি ও সেলুলার ইমিউন রেসপন্স তৈরি হয় এবং তা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে আগের চেয়ে শক্তিশালী করে। বিশেষ করে ভাইরাল ইনফেকশনে সেলুলার ইমিউন রেসপন্স খুব জরুরি বিষয়। তখন ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস কাউকে আক্রমণ করলেও দেহে থাকা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ওই জীবাণুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। যুদ্ধে সেসব জীবাণু হেরে যায়। তখন আক্রান্ত হলেও মানুষ অসুস্থ হয় না।

কখন টিকার অনুমোদন দেওয়া হয়?

যথেষ্ট নিরাপদ এবং রোগ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর প্রমাণ করতে যেকোনো টিকাকেই বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং কয়েক দফা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কঠোর সুরক্ষা এবং কার্যকারিতার মান পূরণ করলেই তখন প্রয়োজনীয় আইনগত অনুমোদন দেওয়া হয়। বিষয়টি কিছু আন্তর্জাতিক জার্নালেও প্রকাশ করা হয়। কভিড-১৯-এর চলমান ভ্যাকসিনগুলো খুব অল্প সময়ে তৈরি হলেও সেগুলো মানবদেহে প্রয়োগের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দ্বারা অনুমোদিত।

বিসিজি টিকা নেওয়ার কারণে আমাদের করোনা সংক্রমণ কম-কথাটি কতটুকু সত্য?

মনে হয় না কথাটা সঠিক। বিসিজি টিকা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে; কিন্তু এ রকম তথ্য আমরা কোথাও পাইনি। গবেষণা ছাড়া আন্দাজে এসব বলা ঠিক নয়। এর সত্যতা জানতে হলে যাঁরা বিসিজি টিকা নিয়েছেন এবং যাঁরা নেননি উভয় গ্রুপের অবস্থা কী, সেটি পরীক্ষা করে বের করতে হবে।

টিকার উদ্দেশ্য কি হার্ড ইমিউনিটি ডেভেলপ করা?

জি। হার্ড (herd) মানে হলো পাল। ভেড়ার পালকেও হার্ড বলে। হার্ড ইমিউনিটি হলে একক ব্যক্তির ইনফেকশন হতে পারে; কিন্তু তা মহামারি পর্যায়ে যাবে না। সংক্রমিত ওই ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির মধ্যে ছড়াতে পারবে না। চারপাশে ইমুনাইজ লোকজন তাকে ঘিরে ধরবে। এটি অনেকটা প্রতিরক্ষা ব্যূহের মতো কাজ করবে।

টিকার উদ্দেশ্য হলো দুটি। যিনি টিকা নিলেন তিনি ইমিউন হলেন বা সুরক্ষা পেলেন। দ্বিতীয়ত, তিনি মহামারি প্রতিরোধের ব্যাপারেও ভূমিকা রাখলেন। তবে হার্ড ইমিউনিটির জন্য কমপক্ষে ৮০ শতাংশ লোককে সংক্রমিত হতে হবে।

করোনাভাইরাস তো আরএনএ ভাইরাস। এই আরএনএ ভাইরাসের টিকা কি দেহের ডিএনএকে কোনোভাবে প্রভাবিত করতে পারে?

না, প্রভাবিত করবে না। মেসেঞ্জার ডিএনএ দ্বারা আরএনএ প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা খুব কম। তারা কোনোভাবেই ডিএনএকে (জিনগত উপাদান) প্রভাবিত বা ইন্টার-অ্যাক্ট করে না। আরএনএ কখনোই কোষের নিউক্লিয়াসে প্রবেশ করে না, যেখানে আমাদের ডিএনএ রাখা হয়।

এখন পর্যন্ত কোভিশিল্ড নামক টিকাটির খারাপ কোনো দিক পাওয়া যায়নি। বহু দেশে ট্রায়ালও দেওয়া হয়েছে। এডিনো ভাইরাসকে কোভিশিল্ডের ক্যারিয়ার হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। এই এডিনো ভাইরাস মানুষের কোনো ক্ষতি করে না।

টিকা নেওয়ার পর জ্বরের উপসর্গ কি টিকার কার্যকারিতাকে নির্দেশ করে?

হ্যাঁ, এটি সত্যি। দেহে যখন ইমিউন রেসপন্স হয় অর্থাৎ এক, দুই ও তিন এভাবে বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে। অনেকটা চেইনের মতো। সাত দিনের মধ্যে ইমিউন রেসপন্স হয়। এর মধ্যে একটি অংশকে বলে ইনফ্লামেশন। তখন জ্বর বা ব্যথা হতে পারে। টিকা নেওয়ার পর সাধারণ জ্বরকে পজিটিভই ধরে নিতে হবে। তবে প্রবল জ্বর হলে চিন্তার কারণ আছে বৈকি।

অ্যান্টিবডি ডেভেলপ করছে কি না, এটি কিভাবে জানা যাবে?

এটি জানা সম্ভব পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা গবেষণার মাধ্যমে। এই টিকাদান কর্মসূচির মধ্যেই কিছু গবেষণা রাখা উচিত। অ্যান্টিবডি নেগেটিভ এমন কিছু লোককে টিকা দিয়ে ঠিক তার ১৫ দিন পর আবার অ্যান্টিবডি পরীক্ষা বা টাইটার করা উচিত। এরপর এক মাস পর আবার টিকা দিয়ে টাইটার দেখা উচিত। ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সী এ রকম ২০ জন, ৪০ থেকে ৫০ বছর বয়সী ২০ জন—এভাবে লোক বাছাই করা যেতে পারে গবেষণার জন্য।

আমাদের দেশে অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করে টিকা দেওয়া হচ্ছে না। তবে অ্যান্টিবডি পজিটিভ এমন ২০ জনকে টিকা দিয়ে ১৫ দিন পর আবার অ্যান্টিবডি দেখা উচিত যে ফলাফল কী দাঁড়াচ্ছে। এরপর ভ্যাকসিন দিয়ে আবার এক মাস পর দেখা দরকার। এ রকম প্রতি বয়সভিত্তিক গ্রুপ থেকে ২০ জন করে পরীক্ষাটি করে ভবিষ্যৎ ফলাফলের জন্য গবেষণা করা উচিত।

তাহলে কি গবেষণার পরই টিকাদান কার্যক্রম চালানো ভালো হবে?

না, ঠিক তা নয়। চলমান টিকা কার্যক্রমের মধ্যেই এ ধরনের গবেষণা চলতে পারে। মোটকথা, যাঁরা টিকা দিচ্ছেন তাঁদের সঙ্গে আরেকটি গ্রুপ থাকবে গবেষণার কাজে। আমি এই বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা করতে চাই। এসব গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী সময়ে টিকাদান কার্যক্রম আমরা নতুনভাবে সাজাতে পারব। এ ধরনের গবেষণা হলে ভবিষ্যতে আমাদের এবং অন্য দেশের মানুষেরও উপকার হবে।

আমাদের দেশে অন্য ভাইরাসগুলোর সংক্রমণ বেশি হওয়ায় কি করোনার সংক্রমণ কম?

হ্যাঁ, কথাটি সঠিক। আমাদের দেশীয় ভাইরাসগুলোর সংক্রমণ বেশি হওয়ায় তারা করোনাকে দেহে ঢুকতে দেয়নি। ঢুকতে দিলেও বের করে দিয়েছে। কেননা আমরা সঠিকভাবে মাস্ক পরছি না, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখছি না, হাট-বাজার সবাই করছি। তবু আমাদের দেশে সংক্রমণের হার বেশ কমে গেছে। আবার সংক্রমণ হলেও অসুখ কিন্তু হয়নি। 

বাংলাদেশে কি এই টিকা আবিষ্কার করা সম্ভব? বঙ্গভ্যাক্সের ব্যাপারে কিছু বলুন।

অবশ্যই সম্ভব। আমরা নিজেরাই টিকা তৈরি করতে পারি। আমাদের ওষুধ বিশ্ববাজারে রপ্তানি হচ্ছে। আমাদের মেধা অনেক। সমস্যা হলো আমরা ভালো কাজে মেধাকে ব্যবহার না করে খারাপ কাজে বেশি ব্যবহার করি। এটি অবশ্য নেতৃত্বের ব্যর্থতা।

টিকা তৈরির জন্য দরকার প্রচুর গবেষণা এবং এ খাতে বরাদ্দ। ভারতের সেরামের মতো প্রতিষ্ঠান আমাদের নেই বলে সে কৃতিত্বটি তারা পাচ্ছে। কিন্তু এ ধরনের প্রতিষ্ঠান ভবিষ্যতে করার জন্য প্রচুর বাজেট ও গবেষণা দরকার। বঙ্গভ্যাক্স নামে টিকা তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করেছে একটি দেশীয় প্রতিষ্ঠান। আমি বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখি। তবে টিকার এই ডামাডোলের মধ্যে তাদের খোঁজখবর সেভাবে নেওয়া হচ্ছে না হয়তো। সরকারের উচিত তাদের প্রচুর উৎসাহ দেওয়া এবং সব ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা করা।  এতে জীবন রক্ষা হবে আবার ফরেন রেভিনিউও আসবে।

সৌজন্যে: দৈনিক কালের কণ্ঠ

এবিএন/জনি/জসিম/জেডি

এই বিভাগের আরো সংবাদ