আজকের শিরোনাম :

‘মানুষ ক্রমান্বয়ে বইয়ের দিক থেকে সরে যাচ্ছে’

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১২:৫৫

হাবীবুল্লাহ সিরাজী বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক। একুশের গ্রন্থমেলা পিছিয়ে যাওয়া, বাংলা একাডেমির দায়িত্ব, বাংলা ভাষার বর্তমান অবস্থা, বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রদানের প্রক্রিয়া প্রভৃতি বিষয়ে একটি জাতীয় দৈনিকের কথা বলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মশিউল আলম। এবিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি হুবহু নিচে তুলে ধরা হলঃ

প্রশ্ন: ভাষার মাস শুরু হয়ে গেছে, কিন্তু বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বইমেলা হচ্ছে না-কেমন লাগছে আপনার?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী: কোভিড-১৯ মহামারির কারণে সারা দুনিয়ায় বইমেলা বন্ধ, কেউ কেউ ভার্চ্যুয়ালি করার চেষ্টা করেছে; কিন্তু আমরা তা করতে চাইনি, কারণ তাতে সাধারণ পাঠক বা প্রকাশকের তেমন উপকার হবে না। তাই সবকিছু বিবেচনা করে আমরা এ বছর পয়লা ফেব্রুয়ারির পরিবর্তে মার্চের ১৮ তারিখে শুরু করার পরিকল্পনা করেছি। আমরা মহামারির বিষয়টি বিবেচনায় রেখে পাঠক, প্রকাশকসহ মেলায় যাঁরা আসবেন, তাঁদের সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে মেনে চলার অনুরোধ রাখব।

প্রশ্ন: জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলা একাডেমির কাজ কী? বছরে একটা বইমেলা করা?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী: না। এখন যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়, সেটি বইমেলা। কিন্তু বইমেলার সঙ্গে যে অনুষ্ঠানমালা, বাংলা একাডেমির নিজস্ব প্রকাশনা, পুরস্কার এবং আরও আরও বিষয় যে জড়িত আছে, তা নিয়ে কিন্তু খুব কম কথা বলা হয়। বাংলা একাডেমি যে বইমেলা করে, সেই অর্থে সেটার রাষ্ট্রীয় কোনো স্বীকৃতি নেই। এই বইমেলার জন্য নির্দিষ্টভাবে রাষ্ট্রীয় কোনো অর্থ বরাদ্দ করা হয় না। বাংলা একাডেমি এই বইমেলা করে প্রকাশকদের নিয়ে এবং স্পনসর গোষ্ঠীকে নিয়ে।

প্রশ্ন: বছরের বাকি ১১ মাস বাংলা একাডেমি কী কাজ করে?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী: বাংলা একাডেমির আটটা বিভাগ। কোনো বিভাগেরই কিন্তু সরাসরি কোনো দায়িত্ব নেই বইমেলা করার। বিক্রয় ও বিপণন বিভাগের পরিচালক মহোদয় কিংবা অন্য কোনো বিভাগের পরিচালক মহোদয়কে সদস্যসচিব করে বইমেলার দায়িত্ব দেওয়া হয়। বইমেলা বাংলা একাডেমির মূল কাঠামোর বাইরের একটা অংশ। কিন্তু আমরা এটাকে কাঠামোর সঙ্গে এমনভাবে যুক্ত করে ফেলেছি, যা সংগত নয়। বাংলা একাডেমির মূল কাজগুলো সম্পাদিত হয় এর আটটি বিভাগের মাধ্যমে। ফোকলোর বিভাগের কথা প্রথমে বলি। এই বিভাগ ফোকলোর সংগ্রহ করে; পুঁথি থেকে শুরু করে আমাদের সংগ্রহ সমৃদ্ধ—ফোকলোর জাদুঘর, একুশে জাদুঘর, লেখক জাদুঘর এসব রয়েছে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হলো গ্রন্থাগার; আমরা এটির আধুনিকায়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি।

প্রশ্ন: কিন্তু গ্রন্থাগারের ব্যবহার কি দ্রুত কমে যাচ্ছে না?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী: দুঃখজনক হলেও সত্য যে মানুষ ক্রমান্বয়ে বইয়ের দিক থেকে সরে যাচ্ছে; বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম। এই সরে যাওয়ার প্রতিফলন দেশের প্রতিটি গ্রন্থাগারেই আপনি লক্ষ করবেন। আর একটি বিষয় লক্ষ করবেন, আগে পাবলিক লাইব্রেরিতে গেলে দেখা যেত মানুষ নানা ধরনের বই পড়ছে- সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, বিজ্ঞান প্রভৃতি। কিন্তু এখন দেখা যায় অধিকাংশই পড়ছে বিসিএসের গাইড। বাংলা একাডেমির গ্রন্থাগার নিয়ে আমাদের গৌরব ছিল যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ এসে এখানে বই পড়ে কিংবা বই ও পত্রপত্রিকা থেকে তথ্য নেয়। দুঃখের বিষয়, এখন সেই ব্যবহার অনেক কমে গেছে।

প্রশ্ন: বইমেলার সময় প্রচুর বই প্রকাশিত হয়। বইয়ের মান সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী: গত বছর বইমেলার সময় প্রায় পাঁচ হাজার বই বেরিয়েছে; সেগুলোর মধ্যে এক হাজারের মতো বই আমরা খুব কষ্টে বাছাই করতে পেরেছি, যেগুলোকে মোটামুটি পাঠের যোগ্য বলা যায়। তা-ও মান সে রকম নয়। মানের কথা বিবেচনা করে এখন বই প্রকাশ করা হচ্ছে না, করা হচ্ছে বাণিজ্যের কথা ভেবে। বইমেলায় প্রতিবছর যেসব বই বের হয়, সেগুলোর অধিকাংশেরই একমাত্র উদ্দেশ্য বাণিজ্য।

প্রশ্ন: বইবাণিজ্য তো ভালো।

হাবীবুল্লাহ সিরাজী: হ্যাঁ, সেটা যদি হতো বইয়ের সাধারণ পাঠকের কাছে বই বিক্রি করা। কিন্তু বাংলাদেশে বইয়ের বাণিজ্য হয় সাপ্লাইতে। বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বই কেনে। যেমন মুজিব বর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে প্রচুর বই কেনার উদ্যোগ নিয়েছে। এই সুযোগে কিছু প্রকাশক, কিছু অপ্রকাশক প্রকাশক সেজে এমন সব বই বের করেন, যেগুলোকে আমরা কোনোমতেই পাঠযোগ্য বলে মনে করি না।

প্রশ্ন: এর জন্য তো সরকারকেই দায়ী করতে হয়। সরকার কেন এসব মানহীন বই কেনে? এভাবে জনগণের অর্থের অপচয় হচ্ছে।

হাবীবুল্লাহ সিরাজী: আমি সরকারকে সেভাবে দোষ দেব না, কারণ সরকারি যন্ত্রের সঙ্গে আমিও যুক্ত। অতএব যদি দায় নিতে হয়, আমাকেও নিতে হবে। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় বই বাছাই করা এবং কেনা উচিত, যেকোনো কারণেই হোক আমরা তা সেভাবে করতে পারি না।

প্রশ্ন: কেন পারেন না?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী: কারণ, আমাদের লোভের অংশগুলো নানাভাবে নানা ঘাটে আমরা জমা রেখে দিয়েছি। শুধু এখানে নয়, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে সরকারের প্রণীত বইগুলোর মান দেখুন। সেখানেও তো একই ব্যাপার।

প্রশ্ন: আমরা তো বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদার দাবিতে আন্দোলন করেছিলাম; ভাষাশহীদেরা আত্মদান করেছিলেন। পাকিস্তান আমলেই বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা মিলেছে। স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা বাংলা ভাষাকে কতটা মর্যাদা দিতে পেরেছি?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী: স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। সে হিসেবে বাংলায় আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা, বিচারকার্য পরিচালনা করা, শাসনকার্য পরিচালনা করা থেকে সব কাজ বাংলা ভাষায় করতে আমরা আইন অনুযায়ী বাধ্য। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেটির প্রয়োগ হচ্ছে না। এর প্রথম ক্ষেত্র হচ্ছে আমার ঘর। আমি যত দিন পর্যন্ত যুবক, তত দিন বাংলার পক্ষে; যেই আমার সন্তান হলো, তখন থেকে বাংলা ভাষা আমার অবহেলার শিকার হতে লাগল। তখন আমি আমার মাতৃভাষাকে ঊন ভাবি, দর ভাবি। এই ভাষায় যদি আমি আমার সন্তানকে শেখাই, পড়াই, তাহলে তার ভবিষ্যৎ নেই। এই হলো আমাদের গড় মানসিকতা। তার মানে, ভাষার সঙ্গে অর্থনীতি জড়িত। ভাষা শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে উপার্জনের বিষয়টি নিশ্চিত করা গেলে এত ব্যত্যয় ঘটত না বলে আমার মনে হয়।

প্রশ্ন: প্রতিবছর বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেওয়া হয়। অভিযোগ আছে, এই পুরস্কার প্রদানের প্রক্রিয়া পক্ষপাতদুষ্ট। দিনে দিনে এই পুরস্কারের মর্যাদা কমে গেছে। আপনি কী বলেন?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী: পুরস্কার কখনো বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকে না, যে ধরনের পুরস্কারই হোক না কেন। কারণ, এখানে বাছাইয়ের একটা ব্যাপার থাকে। কোনো সৃজনশীল বা মননশীল সৃষ্টিকে দাঁড়িপাল্লায় মেপে মূল্যায়ন করা যায় না। এখানে ভুলভ্রান্তি হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে। তবে আমি বলব, বাংলা একাডেমি চেষ্টা করে পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে যেন কোনো ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা কিংবা অন্যায় বিচার ইত্যাদি না হয়। পুরস্কার প্রদানের কমিটিতে যাঁরা থাকেন, তাঁরা সর্বান্তঃকরণে সৎ থেকে সিদ্ধান্তগুলো নেন বলে আমার মনে হয়।

প্রশ্ন: কোনো রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করে না?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী: কোনো রাজনৈতিক প্রভাব বাংলা একাডেমি পুরস্কারে নেই।

প্রশ্ন: এরশাদের স্বৈরশাসনের আট বছর যাঁরা বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন, তাঁদের তালিকা বের করলে দেখা যাবে, আওয়ামী লীগপন্থী, বিএনপিপন্থী, খোদ এরশাদবিরোধী হিসেবে পরিচিত লোকজনও তালিকায় আছেন। কিন্তু ১৯৯০ সালের পরের গত ৩০ বছরে বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগপন্থী আর আওয়ামী লীগ আমলে বিএনপিপন্থী হিসেবে পরিচিত ব্যক্তিরা পুরস্কার পাননি। এটা কি রাজনৈতিক প্রভাবের ফল নয়?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী: আমি আপনার প্রশ্ন বুঝতে পেরেছি। এ বিষয়ে আমি বেশি কথা বলব না, শুধু এটুকু বলব, এখন যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রদান করা হয়, সেখানে এসব রাজনৈতিক পক্ষ-বিপক্ষের স্থান নেই। এরশাদের আমলের পর বিএনপির হাত দিয়ে যেটা শুরু হয়েছে, তার ফল আমরা বিগত বছরগুলোতে কিছু পেয়েছি এবং সেই কুফল আমরা এখনো টের পাচ্ছি। তবে আমরা আশা করছি, এ থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারব।

প্রশ্ন: আপনাকে ধন্যবাদ।

হাবীবুল্লাহ সিরাজী: আপনাকেও ধন্যবাদ।

সৌজন্যে: দৈনিক প্রথম আলো।

এবিএন/জনি/জসিম/জেডি

এই বিভাগের আরো সংবাদ