ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণ ঠেকাতে রাশিয়ার প্রস্তুতি

২৩ মে ২০২৩, ০৯:৩৭ | অনলাইন সংস্করণ

সমুদ্র সৈকতের একটি অবকাশ কেন্দ্রে গড়ে তোলা হয়েছে সুরক্ষিত রুশ প্রতিরক্ষা দুর্গ। প্রতিপক্ষের অগ্রসরমান ট্যাঙ্ক ঠেকাতে প্রধান একটি সড়ক ধরে খনন করা হয়েছে পরিখা। স্যাটেলাইট থেকে তোলা কিছু ছবি বিশ্লেষণ করে বিবিসির ভ্যারিফাই বিভাগ বলছে যে ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণ ঠেকাতে রাশিয়া এ ধরনের ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে।
কয়েক মাসের অচলাবস্থার পর ধারণা করা হচ্ছে যে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পরিকল্পিত এই আক্রমণ ইউক্রেনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হয়ে উঠতে পারে। কারণ এই পাল্টা আক্রমণের মাধ্যমে কিয়েভ প্রমাণ করতে চাইছে যে পশ্চিমাদের কাছ থেকে পাওয়া অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে তারা রণক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য রকমের বিজয় অর্জন করতে সক্ষম।
স্যাটেলাইট থেকে তোলা এরকম শত শত ছবি পরীক্ষা করে বিবিসি ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থান চিহ্নিত করেছে যেখানে রাশিয়া পরিখা খনন করাসহ অন্যান্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে।
এরকম চারটি স্থান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে ইউক্রেন কী ধরনের পাল্টা আক্রমণ চালাতে পারে বলে রাশিয়া ধারণা করছে এবং এসব ইউক্রেনীয় বাহিনী কী ধরনের প্রতিরোধের মুখে পড়তে পারে।
১. ক্রিমিয়ার পশ্চিম উপকূল
রাশিয়া ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল করে নেয়, যা এক সময় সমুদ্র সৈকতে গড়ে ওঠা অবকাশ কেন্দ্রের জন্য সুপরিচিত ছিল।
এখন এই দ্বীপের ১৫ মাইল দীর্ঘ উপকূলে রোদ-নিবারক ছাতা যেমন নেই, তেমনি নেই সূর্যস্নান করতে যাওয়া লোকজনও। তার পরিবর্তে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে রুশ সৈন্যদের স্থাপিত প্রতিরক্ষা স্থাপনা।
ক্রিমিয়ার পশ্চিম উপকূলে বালির একমাত্র খোলা সৈকতটি দেখা যাচ্ছে, যেখানে পাহাড় অথবা উঁচু খাঁড়া পর্বতের মতো প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেই।
প্রথমত সৈকতের তটরেখা ধরে আছে “ড্রাগন্স টিথ।” ড্রাগন্স টিথ হচ্ছে পিরামিড আকৃতির কংক্রিটের ব্লক। ট্যাঙ্কসহ অন্যান্য সামরিক যানের অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেওয়ার জন্য এসব ব্লক ব্যবহার করা হয়।
তার পেছনেই আছে এক সারি পরিখা যা প্রতিপক্ষের আক্রমণ থেকে সৈন্যদের রক্ষা করবে। দীর্ঘ এই পরিখার বিভিন্ন স্থানে কিছু বাঙ্কারও দেখা যায়।
এছাড়াও আছে কাঠের স্তূপ, খনন করার যান এবং ড্রাগন্স টিথের মজুত। এসব দেখে ধারণা করা যায় যে উপকূলজুড়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজ এখনও চলছে।
স্যাটেলাইট থেকে এসব ছবি তোলা হয়েছে গত মার্চ মাসে।
কোনো কোনো সামরিক বিশেষজ্ঞ বলছেন রাশিয়া সতর্কতা হিসেবেই সেখানে এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলছে বলে তারা ধারণা করছেন। এর অর্থ এই নয় যে রাশিয়া সমুদ্রপথে আসা কোনো আক্রমণ প্রতিহত করতে সেখানে এসব স্থাপনা বসিয়েছে। কারণ ইউক্রেনের নৌ ক্ষমতা খুবই সীমিত।
তবে গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষক লায়লা গেস্ট বলছেন, “স্থলপথে নয় বরং সমুদ্রপথে ক্রিমিয়ায় ইউক্রেনের আক্রমণ প্রতিহত করতেই সম্ভবত এসব প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করা হয়েছে।”
ক্রিমিয়ার সমুদ্র সৈকতে এরকম প্রতিরক্ষা দুর্গ আসলে রাশিয়ার বিস্তৃত এক পরিখা নেটওয়ার্কের অংশ।
বিবিসি ভেরিফাই বিভাগ এরকম আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থান চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে যেখানে রাশিয়া প্রতিরক্ষা স্থাপনা গড়ে তুলেছে। সোশাল মিডিয়াতে পোস্ট করা ভিডিও থেকে এ ধরনের পরিখার অবস্থান চিহ্নিত করা হয়েছে।
যেসব ক্ষেত্রে পরিখার সুনির্দিষ্ট অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে সেসব ক্ষেত্রে স্যাটেলাইটের ছবি ব্যবহার করে পরিখার পুরো নেটওয়ার্ক খুঁজে বের করা সম্ভব হয়েছে।
২. টকমাক
ইউক্রেনের ছোট্ট একটি শহর টকমাক যা দেশটির দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ একটি পথের মধ্যে পড়ে। রাশিয়ার দখল করে নেওয়া অন্যান্য অঞ্চল থেকে ক্রিমিয়াকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য ইউক্রেনীয় সৈন্যরা এই শহরটিকে ব্যবহার করতে পারে।
খবরে জানা যাচ্ছে এই শহরটিকে একটি সামরিক দুর্গে পরিণত করার লক্ষ্যে সেখান থেকে বেসামরিক ইউক্রেনীয় নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
এর ফলে সৈন্যদের কাছে রসদ সরবরাহ করা যাবে এবং একইসাথে প্রয়োজনের সময় সৈন্যরা পিছু হটে এই ঘাঁটিতে এসে অবস্থান নিতে পারবে।
স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবিতে দেখা যাচ্ছে যে টকমাক শহরের উত্তরে দু’টি রেখায় পরিখা নেটওয়ার্ক খনন করা হয়েছে। ইউক্রেনীয় বাহিনী এই দিক থেকে রুশ সৈন্যদের ওপর আক্রমণ চালাতে পারে।
এসব পরিখার পেছনে এই শহরের চারপাশ ঘিরে আরও কিছু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে।
এসব প্রতিরক্ষার ব্যূহের রয়েছে তিনটি স্তর যা নিচের ক্লোজ-আপ স্যাটেলাইট ছবিতে পরিষ্কারভাবে দেখা যায়।
এই স্যাটেলাইট ছবির ওপরের দিকে দেখা যাচ্ছে ট্যাঙ্ক-প্রতিরোধী পরিখা। এগুলো সাধারণত আড়াই মিটার গভীর। শত্রুপক্ষের কোনো ট্যাঙ্ক এগুলো পার হয়ে আসার চেষ্টা করলে এসব পরিখার মাধ্যমে ট্যাঙ্কগুলোকে আটকে দেওয়া হয়।
এই পরিখার পেছনে আছে ড্রাগন্স টিথের আরও কয়েকটি সারি। তারপরে পরিখার আরও একটি নেটওয়ার্ক।
কিন্তু ইউক্রেনীয় বাহিনীকে আরও কিছু ফাঁদের মুখে পড়তে হতে পারে।
টকমাক শহরের তিনটি প্রতিরক্ষা স্তরের মধ্যবর্তী স্থানে স্থল-মাইন লুকিয়ে রাখার সম্ভাবনাও অনেক বেশি- বলছেন সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের মার্ক ক্যানসিয়ান।
তিনি বলছেন, “প্রত্যেক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মধ্যেই সাধারণত মাইনফিল্ড থাকে, আর রাশিয়া তো পুরো যুদ্ধজুড়েই ব্যাপকভাবে মাইন ব্যবহার করে আসছে।”
“এখানে মাইনফিল্ড আরও বড় হবে এবং এগুলো হয়তো আরেও বেশি গোপন। তাদের উদ্দেশ্য ইউক্রেনীয় সৈন্যদের আক্রমণের গতি শ্লথ করে দেওয়া যাতে রাশিয়ার পদাতিক ও গোলন্দাজ বাহিনী আক্রমণকারী বাহিনীর ওপর হামলা চালাতে পারে,” বলেন তিনি।
বিবিসি ভেরিফাই বিভাগ টকমাক শহরের কাছে এরকম আরও তিনটি ছোট ছোট শহর চিহ্নিত করেছে যেগুলোতে একইভাবে প্রতিরক্ষা ব্যূহ গড়ে তোলা হয়েছে।
৩. ই-১০৫ মহাসড়ক
স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবিতে টকমাক শহরের পশ্চিম দিকে ই-১০৫ প্রধান মহাসড়কের পাশ দিয়ে ২২ মাইল দীর্ঘ ট্যাঙ্ক-প্রতিরোধী পরিখা দেখা যাচ্ছে।
