আজকের শিরোনাম :

পশ্চিমাদের যে চোখে দেখেন পুতিন

  ইমরান খান

২১ নভেম্বর ২০২১, ১২:৪২ | অনলাইন সংস্করণ

সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে পরমাণুবিজ্ঞানী ও মানবাধিকারকর্মী হিসেবে বেশ পরিচিত ছিলেন আন্দ্রে দিমিত্রিভিচ শাখারভ। সোভিয়েত ঘরানার ভাবনা হিসাবে নিলে তিনি ছিলেন ভিন্নমতাবলম্বী। পরমাণু অস্ত্র তৈরি-ব্যবহার ও রাজনৈতিক মতাদর্শে বিরোধী হওয়ায় তৎকালীন নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ ছিল। ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ১৯৮০ সালের ২২ জানুয়ারি জনসমক্ষে তীব্র প্রতিবাদ করলে তাঁকে গোর্কি শহরে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছিল। পরে ১৯৮৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ নেতা মিখাইল গর্বাচেভ গ্লাসনস্তের নীতির অধীন শাখারভকে মুক্তি দেন। তবে গর্বাচেভের এই সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতায় রাশিয়ায় দমনপীড়ন স্তিমিত হওয়ার কোনো লক্ষণ এত দিনেও দেখা যায়নি; বরং আরও প্রকট হচ্ছে।

আন্দ্রে শাখারভ প্রায়ই যুক্তি দিতেন এই বলে যে, কোনো দেশে দমনপীড়ন চললে দেশটির অবস্থান বিদেশে অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। মৃত্যুর তিন দশক পর এসেও রাশিয়ায় তাঁর এই যুক্তির প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। মেমোরিয়াল নামের একটি মানবাধিকার গোষ্ঠীর বরাত দিয়ে লন্ডনভিত্তিক সাপ্তাহিক সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদন বলছে, বর্তমান রাশিয়ায় সোভিয়েত-যুগের শেষ দিকের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি রাজনৈতিক বন্দী রয়েছে। এই মেমোরিয়ালকে এরই মধ্যে সরকার-সমর্থকেরা ‘বিদেশি এজেন্ট’ তকমা দিয়েছেন।

রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের সম্পর্কের নিক্তিতে মেমোরিয়ালের এসব তথ্য আর শাখারভের যুক্তি আজ যেন এক পাল্লায় হাজির। ইকোনমিস্ট বলছে, পশ্চিমের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক অন্ধকার সময়ে ঢুকে গেছে। দেশে দমনপীড়নকে ন্যায্যতা দিতে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন জনগণকে বলছেন, রাশিয়ান জীবনধারাকে ধ্বংস করতে পশ্চিমা নীতি বিশেষভাবে নকশা করা। এভাবে জাতীয়তাবাদকে কাজে লাগিয়ে পুতিন ক্ষমতায় টেকার চেষ্টা চালালেও পশ্চিমের সঙ্গে তাঁর দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক প্রতিনিয়তই গাঢ় হচ্ছে। এর ভবিষ্যৎ যে কোথায় ঠেকবে, তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।

শাখারভ পুরস্কার বিজয়ী আলেক্সি নাভালনি রাশিয়ায় নিপীড়নের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী। জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের প্রতিবেদন বলছে, প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সমালোচনা করায় ৪৪ বছর বয়সী বিরোধীদলীয় নেতা ও আইনজীবী নাভালনিকে গত বছরের আগস্টে বিষপ্রয়োগে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। অভিযোগের আঙুল উঠছে পুতিন ও তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন গোয়েন্দা সংস্থা এফএসবির দিকে। প্রায় পাঁচ মাস জার্মানিতে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরলে গত ১৭ জানুয়ারি মস্কো বিমানবন্দর থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। কারাবন্দী আলেক্সি নাভালনির শারীরিক অবস্থা ‘নাটকীয়ভাবে খারাপ হচ্ছে’ বলে চিকিৎসকেরা খোলা চিঠি দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির পক্ষ থেকে তাঁর শারীরিক অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ জানানোর পাশাপাশি উন্নত চিকিৎসা ও মুক্তির দাবি তোলা হয়েছে। তাঁর মুক্তির দাবিতে দেশজুড়ে বিক্ষোভ হলেও তাঁকে মুক্তি না দিয়ে রাখা হয়েছে দেশের অন্যতম কুখ্যাত কারাগার ‘পেনাল কলোনি নম্বর ২’-এ।

নাভালনিকে গ্রেপ্তার করেই থেমে থাকেনি পুতিন সরকার। ২০১১ সালে তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংগঠন ‘অ্যান্টি করাপশন ফাউন্ডেশন’-কে বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছে। নাভালনির বেশির ভাগ কর্মী-সমর্থককে দেশছাড়া করা হয়েছে। সমর্থকদের মধ্যে যাঁরা দেশে আছেন, তাঁদেরও খোঁজা হচ্ছে। নাভালনির পক্ষে কাজ করার জন্য ৯ নভেম্বর অধিকারকর্মী লিলিয়া চানিসেভাকে গ্রেপ্তার করে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। নিপীড়নের এই জাল ছড়িয়ে পড়েছে রাজনীতির বাইরেও। চানিসেভাকে গ্রেপ্তারের দিনই রাশিয়ার শীর্ষ উদারনৈতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী সের্গেই জুয়েভকে (৬৭) কারাগারে নেওয়া হয়। হৃদ্‌রোগের চিকিৎসা নিয়ে সদ্য সুস্থ হয়ে ওঠা এই প্রশাসককে গৃহবন্দী অবস্থা থেকে কারাগারে নিয়ে একটি বানোয়াট মামলায় মিথ্যা স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করা হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।

অন্যদিকে রাশিয়ার বাজেট হিসাব বলছে, ২০২০ সালে রাশিয়ার মোট বাজেট ছিল ১ হাজার ১১৬ বিলিয়ন রুবল। এর মধ্যে নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা খাতের জন্য নির্ধারিত ছিল ৩৩৪ বিলিয়ন রুবল। অর্থাৎ মোট বাজেটের এক-তৃতীয়াংশ ব্যয় করা হয় এই খাতে। ইকোনমিস্ট বলছে, এই খাতের জন্য নির্ধারিত বাজেটের বেশির ভাগই খরচ করা হয়েছে অভ্যন্তরীণভাবে। ২০১৪ সালের তুলনায় এ বছর পুলিশ এবং নিরাপত্তা খাতে ১০ শতাংশ বেশি লোক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এতে কর্মরত সেনার চেয়ে পুলিশ সদস্যের সংখ্যা বেড়ে গেছে। একই সঙ্গে দুর্নীতি করে রাশিয়ার বহু পুলিশ ও নিরাপত্তা খাতের লোক সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। বিনিময়ে এরা পুতিনের শাসন, দুর্নীতির, আয় কমার প্রতিবাদে রাজপথে নামা নাগরিকদের নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে।

যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান দ্য গভর্নমেন্ট ফিন্যান্স অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিবেদন ‘অ্যানাটমি অব আ প্রায়োরিটি ড্রাইভেন বাজেট প্রসেস’-এ বলা হয়েছে, কোন খাতে সরকার কী পরিমাণ বাজেট দেবে, তা নির্ভর করে ওই খাত থেকে কতটা পরিষেবা প্রত্যাশা করে তার ওপর। এ ক্ষেত্রে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য মূল বিষয়। এভাবে গুরুত্বসহকারে খাত তালিকাবদ্ধ করে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বাজেট বণ্টন করা হয়। যে খাত থেকে সবচেয়ে বেশি সুবিধা নেওয়ার ইচ্ছে, প্রবণতা থাকে ওই খাতে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সর্বোচ্চ বাজেট দেওয়ার।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভ্লাদিমির পুতিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রথম দশকে রাশিয়ায় ব্যাপক সমৃদ্ধি হয়। তবে তাঁর দমনপীড়ন বর্তমানে যে অবস্থানে পৌঁছেছে, তা থেকে ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করা তাঁর জন্য এক রকম অসম্ভব। অবশ্য জ্বালানির উচ্চমূল্য, নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেও ক্রেমলিন ২০১৪ সালে অর্থনীতিতে ভালো একটি জায়গায় পৌঁছেছে, যা রাশিয়ার জন্য কিছুটা হলেও আশার সঞ্চার করতে পারে। তবে চীনের মতো টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনের কোনো চেষ্টা আপাতত রাশিয়া দেখাতে পারছে না।

রাশিয়ায় পুতিনপন্থীরা জোর দিয়ে বলছেন, সেখানকার পরিবার, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ পশ্চিমা বিশ্বের কারণে কলুষিত হচ্ছে। এ থেকে নিজেদের রক্ষা করার বিষয়েও তাঁরা সোচ্চার। পশ্চিমের বিরুদ্ধে ‘লড়াই করা’ ক্রেমলিনের কোনো নীতির বিরোধিতা করলেই তকমা দেওয়া হচ্ছে ‘বিদেশি এজেন্ট’। এই তকমার মূল শিকার হচ্ছেন সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবীরা।

ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, স্বৈরশাসকেরা তাঁদের সব কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দিতে ‘সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন’-কে সব সময় ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। আর সেই ঢাল ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিপীড়নকে মূল হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এভাবে সৃষ্ট সহিংসতা প্রায়ই দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। বেলারুশের স্বৈরশাসক আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কোকেও এ পথেই হাঁটতে দেখা গেছে। সেখানেও ভিন্নমতাবলম্বীদের হত্যার ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি রাশিয়া একটি যাত্রীবাহী উড়োজাহাজকে গুলি করে নামিয়েছে এবং বেলারুশ এক স্থানীয় ভিন্নমতাবলম্বীকে গ্রেপ্তারের উদ্দেশ্যে ছিনতাই করেছে। স্বনির্বাসিত হয়ে বেলারুশের সরকারবিরোধী অনেকে পোল্যান্ড ও লিথুয়ানিয়ায় আশ্রয় নিচ্ছেন।

বড় পরিসরে বিবেচনা করলে দেখা যায়, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের বিপক্ষে পশ্চিমা নির্বাচনে হস্তক্ষেপের অভিযোগ ওঠে। তিনি কখনো কখনো টিকাবিরোধী প্রচারণা চালান, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধে লিপ্ত হন বা সৈন্য জমায়েত করেন ইউক্রেন সীমান্তে। তিনি গ্যাসের অতিরিক্ত সরবরাহের প্রতিশ্রুতিকে কাজে লাগিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইউক্রেন ও মলদোভার মতো দেশগুলোর সম্পর্কে ফাটল ধরানোর চেষ্টাও চালান।

তবে সুখবর হলো, রাশিয়ার সব মানুষ কিন্তু পুতিনে বুঁদ নয়। মোট জনগণের অধিকাংশই বেশির ভাগ সংঘর্ষের সুবিধায় বিশ্বাসী নন। পুতিনের নানাবিধ প্রচারের মাঝেও দেশের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের পশ্চিম সম্পর্কে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ বলছেন, রাশিয়ার উচিত পশ্চিমকে অংশীদার ও বন্ধু হিসেবে বিবেচনা করা। এরই মধ্যে তরুণদের মধ্যে সরকারি সহিংসতা প্রত্যাখ্যান করে মানবাধিকারের পক্ষে থাকার কথা সবচেয়ে বেশি শোনা যায়।

ক্রেমলিন ও রুশ জনগণের মধ্যে এই বিভেদ কাজে লাগানোর একটি বড় সুযোগ রয়েছে পশ্চিমের হাতে। বিশ্লেষকদের মতে, রাশিয়ার অভ্যন্তরে চলমান মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে এখনই কথা বলা উচিত পশ্চিমের। আশ্বাস পেলে রাশিয়ার ছাত্র, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের উন্নত জীবনের আশা বাড়বে। পশ্চিমা সরকারের উচিত তাঁদের জায়গা দেওয়া; রুশ শিক্ষার্থীদের পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাগত জানানো। তাহলে শুধু পুতিনের দমনপীড়নের শিকারদেরই নয়, নিজেদেরও সাহায্য করা হবে।

এই বিভাগের আরো সংবাদ