রামেকের ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মবিরতিতে অচল হাসপাতাল

প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০২২, ১৬:৪০

টানা ৭২ ঘণ্টার কর্মবিরতি শুরু করেছেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা। আজ শনিবার দুপুরে হাসপাতালের সামনে এক মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে এ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এরপর দুপুর আড়াইটা থেকে কর্মবিরতি পালন করছেন তাঁরা।
জানা গেছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার্থী গোলাম মোস্তফা শাহরিয়ারের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে হাসপাতালে ভাঙচুর, ইন্টার্ন চিকিৎসকদের মারধর করার ঘটনায় মামলা রেকর্ড না করা ও এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার না করায় এ কর্মসূচি পালন করছেন ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা। এতে প্রায় অচল হয়ে পড়েছে উত্তরাঞ্চলের বৃহৎ এই হাসপাতালটি। হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ), বিভিন্ন কেবিনসহ ৫৭টি ওয়ার্ডে দিনরাত রোগীদের ভরসা ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা। পুরো হাসপাতালে প্রায় ২৫০ ইন্টার্ন চিকিৎসক দায়িত্ব পালন করেন। জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকেরা শুধু সকালে একবার ওয়ার্ডে রাউন্ড দেন। বাকি সময় ইন্টার্ন চিকিৎসকেরাই হাসপাতাল চালান। এখন ইন্টার্নদের কর্মবিরতির কারণে কোনো চিকিৎসক থাকছেন না।
গত বুধবার রাতে রাবির হবিবুর রহমান হলের তৃতীয় ব্লকের ছাদ থেকে পড়ে গুরুতর আহত হন মার্কেটিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার। ওই রাতে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক শাহরিয়ারকে মৃত ঘোষণা করেন। এ সময় আইসিইউ না চেয়ে না পাওয়া এবং সঠিক সময় চিকিৎসা না হওয়ার অভিযোগ তুলে রাবি শিক্ষার্থীরা হাসপাতালে ব্যাপক ভাঙচুর চালান। ইন্টার্ন চিকিৎসকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মারধরের ঘটনাও ঘটে। এরপর রাবি শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করতে থাকেন। পরবর্তীতে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাসে রাত ২টার দিকে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ফিরে যান।
ওই দিন রাত সাড়ে ১১টা থেকে হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসকরাও কর্মবিরতি শুরু করেন। তারা রাবি শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান। পরে গত বৃহস্পতিবার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অজ্ঞাতনামা ৩০০ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দেয়। পরদিন শুক্রবার সকাল থেকে ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা কাজে ফেরেন এবং অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারে তাঁরা ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেন। আল্টিমেটামের সময়ের মধ্যে মামলা রেকর্ড না হওয়া এবং কেউ গ্রেপ্তার না হওয়ায় আজ দুপুরে হাসপাতালের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। সমাবেশে টানা ৭২ ঘণ্টার কর্মবিরতির ঘোষণা দেন। এ ঘোষণার পর দুপুর আড়াইটা থেকে ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা কর্মবিরতি শুরু করেন।
হাসপাতালে চিকিৎসক না থাকায় দুর্ভোগ নিয়ে ৮ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা রোগী রোমানা খাতুনের বাবা উম্মর আলী বলেন, ‘নার্সেরা কয়েকটা ইনজেকশন লিখে দিয়েছে। কোনো ডাক্তার নাই। এখন এই ইনজেকশন লাগবে কি না তা দেখার মতোও কাউকে পাচ্ছি না। আজ সকালে শুধু বড় ডাক্তারেরা একবার রোগী দেখে গেছেন। এখন আর কাউকে পাচ্ছি না।’
রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার আমগাছি গ্রামের ইদ্রিস আলী হাসপাতালে গত কয়েক দিন থেকেই ভর্তি আছেন। তাঁর ভাতিজা মাসুদ রানা বলেন, ‘হাসপাতালে একজন ডাক্তারকেও দেখা পাচ্ছি না। ওয়ার্ডে শুধু নার্সেরা আছেন। ওষুধ কিনে এনে তাঁদেরও দুই, চার-পাঁচবার করে ডাকতে হচ্ছে। এখন ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা কর্মবিরতিতে যাওয়ায় অবস্থা খুবই খারাপ।’
মানববন্ধনে রামেক হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি ইমরান হোসেন ৭২ ঘণ্টার কর্মবিরতির ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, ‘আমরা হামলাকারীদের গ্রেপ্তারে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে কাজে ফিরেছিলাম। কিন্তু এখন পর্যন্ত মামলা রেকর্ড হয়নি। এমনকি কাউকে গ্রেপ্তারও করা হয়নি। তাই পূর্বঘোষণা অনুযায়ী আজ এই মানববন্ধন থেকেই আমরা আগামী ৭২ ঘণ্টার জন্য কর্মবিরতিতে যাচ্ছি। এই তিন দিনের প্রতিদিন আমরা আমাদের দাবি নিয়ে হাসপাতালের প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করব।’
হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, ‘ইন্টার্নরা তাঁদের দাবি নিয়ে কর্মবিরতিতে গেছে। সিনিয়র ডাক্তাররা দায়িত্ব পালন করছেন। তবে ইন্টার্নরা না থাকলে সমস্যা হবেই।’
শামীম ইয়াজদানী আরও বলেন, ‘রাবি শিক্ষার্থী শাহরিয়ারের মৃত্যুর পর হাসপাতালে যে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছিল তার জন্য আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। আমরা লিখিত অভিযোগ দিলেও মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়নি। আমরাও ইন্টার্নদের দাবি যৌক্তিক মনে করছি।’
হাসপাতালের সামনে করা বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে-বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ), স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বচিপ) ও রামেক হাসপাতাল ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদ। হাসপাতাল ভাঙচুর, প্রশাসনিক কাজে বাধা দেওয়া, সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা সেবা ব্যাহত করা ও কর্তব্যরত চিকিৎসকদের ওপর হামলার প্রতিবাদে এই কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। এতে অংশ নেন হাসপাতাল পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও রাজশাহী সদর আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা, হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী, রাজশাহী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. নওশাদ আলী, ডা. খলিলুর রহমান, ডা. আজিজুল হক আজাদ প্রমুখ। এর আগে ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা মিছিল করেন।
অপরদিকে, রাবি শিক্ষার্থীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে অন্য শিক্ষার্থীদের মারধরের অভিযোগে রাবি কর্তৃপক্ষও আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গতকাল বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তারের সভাপতিত্বে এক জরুরি সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ বিষয়ে রাবির সহ-উপাচার্য অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম জানান, ঘটনাটি রাজপাড়া থানা এলাকায় তাই সেখানে অভিযোগ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
এ বিষয়ে রাজপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এএসএম সিদ্দিকুর রহমান বলেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যে অভিযোগ দিয়েছে তার তদন্ত চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়ও অভিযোগ দেবে বলে শুনছি। তারা অভিযোগ দিলে সেটাও নিয়ে তদন্ত করে দেখা হবে। তারপরই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এবিএন/জনি/জসিম/জেডি
এবিএন/জনি/জসিম/জেডি
এই বিভাগের আরো সংবাদ