দুটো হাসপাতালে কিডনি ডায়ালাইসিস বন্ধ হওয়ার নেপথ্যে কারা
প্রকাশ: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ২০:৪১
বাংলাদেশের ঢাকায় জাতীয় কিডনি ইন্সটিটিউট অ্যান্ড ইউরোলজি এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কিডনি রোগীদের ডায়ালাইসিস কার্যক্রম একযোগে বন্ধ হয়েছিলো বুধবার, যার জের ধরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ পদস্থ কর্মকর্তারা আজ শনিবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
বুধবার ঢাকা ও চট্টগ্রামে কিডনি ডায়ালাইসিস বন্ধ হয়ে গেলে ভয়াবহ সংকটে পড়ে যায় ডায়ালাইসিসের জন্য সেদিন হাসপাতালে যাওয়া রোগী ও তাদের স্বজনরা। এক পর্যায়ে রোগীর আত্মীয় স্বজনরা ঢাকায় বিক্ষোভ শুরু করেন।
নিশিতা ইসলাম নামে একজন গৃহিণী তার শ্বশুরকে ডায়ালাইসিসের জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন সেদিন।
"অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে দেখলাম যে ডায়ালাইসিস বন্ধ। আমার শ্বশুরকে অনেকদিন ধরেই ডায়ালাইসিস দিতে হচ্ছে। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম," বলছিলেন তিনি। কয়েক বছর ধরেই হাসপাতালে গিয়ে ডায়ালাইসিস করাতে হয় স্কুল শিক্ষক নাসিমা আক্তারের বাবাকে।
"ডায়ালাইসিস ঠিক মতো না হলে কেমন সমস্যা হয় সেটা আমরা ভুক্তভোগীরাই জানি। আর হাসপাতালে এ সেবা ঘোষণা ছাড়াই বন্ধ করার কথা তো চিন্তাই করতে পারি না," বলছিলেন তিনি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ শারমিন ইয়াসমীন বলছেন ডায়ালাইসিসের মতো সেবা হুট করে বন্ধ করে দেয়া মোটেও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
"যান্ত্রিক কারণে সেবাদান বিঘ্ন হলে কিছু করার থাকে না। কিন্তু কর্তৃপক্ষ বা প্রতিষ্ঠানের মধ্যকার কোন বিষয়ের জন্য ডায়ালাইসিস দেয়া হুট করে বন্ধ করে দেয়ার সুযোগ নেই। সাময়িক বন্ধ করলে সেটা আগে থেকেই জানানো উচিত। তাহলে রোগীরা বিকল্প চিন্তা করতে পারতো," বলছিলেন তিনি।
সংকটের কারণ কী?
কিডনি ইন্সটিটিউটের পরিচালক মিজানুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেছেন বকেয়া টাকা আদায়ের জন্য ভারতীয় প্রতিষ্ঠান 'স্যানডোর ডায়ালাইসিস সার্ভিসেস' হুট করে ডায়ালাইসিস বন্ধ করে দিয়েছিলো।
"তারা চরম অন্যায় কাজ করেছে। আমরা তাদের সাথে কথা বলছি। চুক্তি রিভিউ করছি। প্রয়োজন হলে আইনি ব্যবস্থা নিবো। তবে সেবাটি আবার চালু হয়েছে। এখন আর সংকট নেই।"
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক মুহাম্মদ আফতাবুল ইসলাম বলছেন সমস্যাটির আপাতত সমাধান হলেও তারা আশা করছেন যে দ্রুত একটি স্থায়ী সমাধান হবে।
"এখানে অনেক গরীব রোগীদের ডায়ালাইসিস হয়। এভাবে বন্ধ করলে তো মারাত্মক সমস্যা হয়। আশা করছি এর একটি স্থায়ী সমাধান হবে যাতে রোগীদের ভোগান্তি আর না হয়," বলছিলেন তিনি।
২০১৫ সালে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাথে ১০ বছরের চুক্তিতে সরকারি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস সেবা দেওয়া শুরু করে স্যানডোর।
চুক্তি মতো প্রতি ডায়ালাইসিসে মাত্র ৪৮৩ টাকা দিতে হয় রোগীদের। বাকি টাকা দেয় বাংলাদেশ সরকার। এই সুবিধায় বছরে ২৯ হাজার ৬০৯টি সেশন (৪ ঘণ্টায় এক সেশন ধরে) দেয়ার কথা প্রতিষ্ঠানটির। তবে করোনার কারণে গত দু'বছর প্রতিষ্ঠানটি থেকে বেশি সেশন নেয়া হয়েছে ঢাকা ও চট্টগ্রামের দুই হাসপাতালে।
গত বছর ৫৯ হাজার সেশন নেয়া হয়েছে এ প্রতিষ্ঠানটির কাজ থেকে এবং এ টাকা আদায়ের জন্য চাপ সৃষ্টি করতেই প্রতিষ্ঠানটি সেবা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছিলো বলে অভিযোগ করেন মি. রহমান
"অনেক হাসপাতালে কোভিডের কারণে ডায়ালাইসিসের সুবিধা বন্ধ হয়ে গেলে আমাদের হাসপাতালে চাপ বেড়ে যায়। সে কারণেই অতিরিক্ত সেশন নিতে হয়েছে," বলছিলেন তিনি
কর্মকর্তারা বলছেন ঢাকা ও চট্টগ্রামের জন্য তাদের অতিরিক্ত ১৪/১৫ কোটি টাকা বিল হয়েছিলো এবং এর মধ্যে আট কোটি টাকার মতো পরিশোধও করা হয়েছে।
"কিন্তু বাকি টাকার জন্য তারা এভাবে হুট করে ডায়ালাইসিস সেবাই বন্ধ করে ভয়াবহ অন্যায় করেছে," বলছিলেন তিনি।
কিডনি রোগীর ডায়ালাইসিস কতটা সুলভ
কিডনি ফাউন্ডেশন নামের একটি বেসরকারি সংস্থার জরিপ থেকে পাওয়া পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে প্রায় দুই কোটি মানুষ কোন না কোনভাবে কিডনি রোগে ভুগছে। আর আক্রান্তদের মধ্যে ৪০ হাজারের কিডনি পুরোপুরি অকেজো হচ্ছে প্রতিবছর।
এ ধরনের রোগীর জন্য মাত্র দু'রকম চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে। একটি হচ্ছে ডায়ালাইসিস অর্থাৎ যন্ত্রের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে কিডনির কাজ করানো, এবং দ্বিতীয়টি কিডনি প্রতিস্থাপন।
বর্তমানে কিডনি রোগের চিকিৎসার জাতীয় প্রতিষ্ঠান হলো ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি।
প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মিজানুর রহমান বলছেন এক সাথে দু'শোর মতো রোগীকে ডায়ালাইসিস সেবা দেয়ার সক্ষমতা আছে হাসপাতালটির এবং এখন অন্তত ৭০০/৮০০ জন আবেদন করে রেখেছেন।
ডায়ালাইসিসের ব্যয় সরকারিভাবে নির্ধারিত হয় না। সরকারি হাসপাতালগুলোর তুলনায় বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে এই ব্যয় অনেক বেশি।
হাসপাতালগুলো নিজেদের মতো করে তা নির্ধারণ করে থাকে। এসব হাসপাতালে একবার ডায়ালাইসিস করাতে ৩,৫০০ টাকা থেকে ৮,০০০ টাকা পর্যন্ত ব্যয় হয়।
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মাত্র ১০০টি ডায়ালাইসিস সেন্টার রয়েছে।
ডায়ালাইসিস রোগীর ক্ষেত্রে প্রতি সপ্তাহে তিনটা ডোজ দিতে হয়। এখন দেশের হাসপাতালগুলোর যে সক্ষমতা, তাতে ১৫ হাজার রোগীকে ডায়ালাইসিস দেওয়া যায়। কিন্তু রোগী আছে ৬০ হাজারের মতো। বাকি রোগীদের চিকিৎসার কোনও ব্যবস্থা নেই।
এবিএন/মমিন/জসিম